গিনেসের ওয়ার্ল্ড মিউজিক ট্যুরে বাংলাদেশের সুদর্শন

সুদর্শন দাশ। ছবি: প্রথম আলো
সুদর্শন দাশ। ছবি: প্রথম আলো

ছোটবেলা থেকেই তবলার নেশায় পেয়েছে সুদর্শন দাশকে। চট্টগ্রামের আলাউদ্দিন ললিত কলা একাডেমিতে তিন-চার বছর বয়স থেকে আসা–যাওয়া। পড়ালেখার পাশাপাশি তবলার বোলের ঘোরে সুদর্শন দাশের দিনকাল চলছে তখন। তবলায় উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য একসময় শান্তিনিকেতনে চলে গেলেন তিনি। মিলল তবলা বিশারদ উপাধি।

কিন্তু বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতায় একজন তবলাবাদকের ক্যারিয়ার আর কত দূর যেতে পারে। এই বাস্তবতা যতটুকু তিনি বুঝেছিলেন তার চেয়ে বেশি বুঝেছিলেন অভিভাবকেরা। তাঁদেরই চাপে আইন বিষয়ে উচ্চশিক্ষা লাভের চেষ্টা। অতঃপর ব্যারিস্টার হওয়ার বাসনায় লন্ডনে। একদিকে আইন বিষয়ে লেখাপড়া, অন্যদিকে শিল্পসাধনা। পরস্পরবিরোধী দুই ধারাকে সমন্বয় করে সুদর্শনের শিল্পী সত্তাই জয়ী হয়। তিনি শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠলেন তবলার একজন।

তবলাসহ চার ধরনের বাদ্যযন্ত্রে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ড করলেন যুক্তরাজ্যপ্রবাসী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সুদর্শন দাশ। শুধু তা–ই নয়, প্রতিষ্ঠা করেছেন তবলা অ্যান্ড ঢোল একাডেমি নামে একটি প্রতিষ্ঠান। তার শাখা রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও চট্টগ্রামে।

এই শিল্পী সম্প্রতি শিশুমেলা নামে একটি সংগঠনের আমন্ত্রণে জন্মভূমিতে আসেন। শিশুমেলার আয়োজনে থিয়েটার ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে গত বৃহস্পতিবার একটি অনুষ্ঠানে চারটি বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে দর্শকদের মুগ্ধ করেন তিনি। অনুষ্ঠানের পরদিন প্রথম আলোর সঙ্গে কথামালায় সুদর্শন দাশ হয়ে ওঠার পেছনের সব গল্প তুলে ধরেন তিনি। একটা কথা সুদর্শন বারবার বলতে থাকেন, ‘অধ্যবসায় সাফল্যের চাবিকাঠি। পরিকল্পনা এবং অদম্য ইচ্ছা ছিল বলেই আমি গিনেস রেকর্ড করতে পেরেছি।’

কথায় কথায় জানা গেল চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় পৈতৃক বাড়ি তাঁর। অমূল্য রঞ্জন দাশ ও বুলবুল রানী দাশের ছেলে সুদর্শনের জন্ম চট্টগ্রাম নগরের ফিরিঙ্গীবাজার এলাকায়। মিউনিসিপ্যাল মডেল উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৯০ সালে তিনি এসএসসি পাস করেন। এরপর ১৯৯২ সালে সরকারি সিটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। তারপর শান্তিনিকেতনে তবলা নিয়ে পড়তে চলে যান সুদর্শন।

সুদর্শন বলেন, ছোটবেলা থেকেই তবলার প্রতি আকর্ষণ। এ জন্য মা-বাবার অবদান বেশি। তাঁরা আলাউদ্দিন ললিতকলায় ভর্তি করিয়ে না দিলে এটা হতো না। মা–বাবা সংগীত অনুরাগী ছিলেন। এরপর শান্তিনিকেতনে তবলায় মনোনিবেশ করি। আসা–যাওয়ার মধ্যে ছিলাম।

এই ফাঁকে চট্টগ্রাম আইন কলেজেও পড়ালেখা চালিয়ে যান সুদর্শন। সেখান থেকে ডিগ্রি নেন। অন্যদিকে ১৯৯৮-৯৯ সালে সুদর্শন শান্তিনিকেতন থেকে পাস করে বের হন। সেখান থেকে তবলা বিশারদ উপাধি পান।

চট্টগ্রামের অনুষ্ঠানে তবলা পরিবেশন করছেন সুদর্শন দাশ। ছবি: প্রথম আলো
চট্টগ্রামের অনুষ্ঠানে তবলা পরিবেশন করছেন সুদর্শন দাশ। ছবি: প্রথম আলো

চার ভাইয়ের মধ্যে চতুর্থ সুদর্শন। বাবার ইচ্ছা ছিল ছেলেকে ব্যারিস্টার হতে হবে। সুদর্শন বলেন, অন্য তিন ভাইয়েরা প্রকৌশলী, চিকিৎসক ও কম্পিউটার নিয়ে পড়েছেন। তাই আমাকে ব্যারিস্টার হওয়ার তাগিদ দিতে থাকেন। বাবার টাকায় ১৯৯৯ সালে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমাই। যুক্তরাজ্যে ইউনিভার্সিটি অব গ্রিনিচে গ্র্যাজুয়েশন করার পর ২০০৭ সালে নর্দাম্বিরয়া ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেন। এর আগে আইনের পাশাপাশি ২০০৫ সালে সংগীত নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা শুরু করেন সেখানে। ২০১০ সালে তিনি বার অ্যাট ল পাস করেন। প্রথমদিকে ব্রিটেনে খরচ জোগাতে দিনে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত বিভিন্ন দোকানে কাজ করেন সুদর্শন। কষ্টের জীবন। তবু তিনি তবলা ভোলেননি। ‘একদিন কৃষ্ণাদি নামে একজন আমাকে বললেন, তুমি তো তবলা বাজাতে পারো। নেহেরু সেন্টারে একটা অনুষ্ঠানে বাজালে আমি ব্যবস্থা করে দেব। আমি রাজি হয়ে যাই। এরপর আমার তবলা সবার ভালো লাগল। পরে আমাকে তাদের একটা বিদ্যালয়ে (প্রতিবন্ধীদের) তবলা শেখানোর জন্য নিয়োগের প্রস্তাব দিল। প্রথমে তিন ঘণ্টা। পরে তা ফুলটাইম করা হয়।’ সুদর্শন বললেন।

তবলা শেখানোর দায়িত্ব পেয়ে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। একপর্যায়ে দুই বছরের মধ্যে সুদর্শনের ভিসা শেষ হয়ে যাচ্ছিল। তখন স্কুল কর্তৃপক্ষ যুক্তরাজ্য সরকারের কাছে সুদর্শনকে তাঁদের বিদ্যালয়ে তবলা শিক্ষক হিসেবে দরকার বলে আবেদন করেন। সুদর্শন বলেন, ‘এটা আমার কাছে অনেক বড় পাওয়া। বিদ্যালয়ের আবেদনের পর আমাকে সেখানে থাকার অনুমতি দেওয়া হলো। তিন বছরের মধ্যে আমাকে ব্রিটিশ পাসপোর্টও দেওয়া হলো।’

২০০৪ সালে তিনি লন্ডনে টম ওয়াটস নামে একজনের সঙ্গে মিলে গড়ে তোলেন তবলা অ্যান্ড ঢোল একাডেমি। প্রথমে টমের ছেলেই ছিল একমাত্র শিক্ষার্থী। বর্তমানে শিক্ষার্থী ৩৬৫ জন। এর মধ্যে নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, ভারত বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীরা রয়েছে।

গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড: যুক্তরাজ্য থেকে ২০০৯ সালে ভারতের চেন্নাইতে একটি অনুষ্ঠান করতে যান সুদর্শন। সেখানে শুনতে পান কুঝালামানাম জি রামাকৃষ্ণান নামে একজন টানা অনেকক্ষণ মৃদঙ্গ বাজিয়ে গিনেস বুকে নাম লিখিয়েছেন। সুদর্শন ওই লোকের সঙ্গে দেখা করতে চেন্নাই থেকে প্রায় ৮০ মাইল দূরে এটিতে ছুটলেন।

‘প্রথমে তিনি আমাকে পাত্তা দিতে চাইলেন না। পরে অনেক কথাবার্তা বললেন। পরামর্শ দিলেন। এরপর আমি গিনেস ওয়ার্ল্ড বুক রেকর্ডের নিয়মকানুনগুলো জেনে নিই। তারপর নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকি।’ বলতে থাকেন সুদর্শন।

গিনেস রেকর্ডের নেশা পেয়ে বসে সুদর্শনকে। ২০১২ সালে তিনি গিনেস কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেন। এ সময় প্রথমে ডেমো দেখাতে খরচ হয় পাঁচ হাজার পাউন্ড। এরপর মূল সেশনের জন্য তাঁকে জমা দিতে হয়েছিল ৩৫ হাজার পাউন্ড। ১৫ হাজার পাউন্ড স্পনসরের কাছে পেলেও বাকিটা নিজেকে জোগাড় করতে হয়েছিল।

‘যখন টাকা চাইতে যাই তখন অনেকে বলেছেন, দেশ থেকে শিল্পী এনে এখানে অনুষ্ঠান করেন। টাকা আসবে। গিনেস রেকর্ড বাদ দেন। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি।’ সুদর্শনের একাগ্রতা।

২০১৬ সালে টানা ৫৫৭ ঘণ্টা ১১ মিনিট তবলা বাজিয়ে করে ফেলেন রেকর্ড। ১৮ দিন টানা বাজানোর পর বিভিন্ন মিডিয়া আসতে শুরু করেছিল। এর আগে কেউ বিশ্বাস করেনি তা। সুদর্শন বলেন, ‘প্রতি ঘণ্টায় ৫ মিনিট বিরতি পাওয়া যায়। যদি টানা ১০ ঘণ্টা বাজাই তাহলে ৫০ মিনিট বিরতি। ওই সময়ে খাওয়া, একটু বিশ্রাম এভাবে রেকর্ড করেছি।’

চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় পৈতৃক বাড়ি সুদর্শন দাশের। ছবি: প্রথম আলো
চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় পৈতৃক বাড়ি সুদর্শন দাশের। ছবি: প্রথম আলো

এর পরের বছর টানা ২৭ ঘণ্টা ঢোল বাজিয়ে আরেকটি গিনেস রেকর্ড করেন। ২০১৮ সালে টানা ১৪ ঘণ্টা ড্রাম রোল বাজান সুদর্শন। তাঁর তৃতীয় গিনেস রেকর্ড। সর্বশেষ ২০১৯ সালে একটানা ১৪০ ঘণ্টা ৫ মিনিট ড্রাম সেট বাজিয়ে সর্বশেষ গিনেস ওয়ার্ল্ড বুক রেকর্ডের অধিকারী হন।

সুদর্শন বলেন, ‘গিনেস রেকর্ড করে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পেরে খুব ভালো লাগছে। আমার সাফল্য মা-বাবার পাশাপাশি রোহিঙ্গা এবং শরণার্থী শিশুদের উৎসর্গ করেছিলাম।

তবলায় সুদর্শন প্রচলিত ঘরানার বাইরে টেমস নদীর টেমস ঘরানা নামে একটি ঘরানা তৈরি করেন। তিনি বলেন, ১২৮ বিটের এই ঘরানাটি লন্ডনের বিভিন্ন সংগীত সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

ভবিষ্যৎ ইচ্ছার কথা জানতে চাইতেই সুদর্শন বলেন, আপাতত ওয়ার্ল্ড মিউজিক ট্যুর করছি। এটাই নিকটতম ইচ্ছা। বাকিটা পরের চিন্তা।

গিনেসে বুক রেকর্ডধারী এই শিল্পী এখন গিনেসের ওয়ার্ল্ড মিউজিক ট্যুরে বের হয়েছেন। সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠানের ফাঁকে বাংলাদেশে আসেন। তাঁর সহশিল্পী হিসেবে রয়েছেন কিবোর্ড বাদক মাইকেল ব্রড।