ফেলুদার কাছাকাছি

সব্যসাচী চক্রবর্তী। ছবি: খালেদ সরকার
সব্যসাচী চক্রবর্তী। ছবি: খালেদ সরকার

প্রথমেই উঠে এল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কথা। শটের ফাঁকে এসে সোফায় বসে সব্যসাচী চক্রবর্তী বললেন, ‘সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আমার জীবনের একজন আইডল। কারণ, তাঁর ফেলুদা দেখে আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি, ভেবেছি, আমিও ফেলুদা করতে চাই। আমার জীবনের প্রথম টিভি সিরিয়াল বাংলা গল্পবিচিত্রা, যেখানে ছোটগল্প নিয়ে একটা সিরিজ হয়েছিল। সেখানে আমার বাবা ছিলেন সৌমিত্র, মা তৃপ্তি মিত্র। আমি তো নার্ভাস। আমার প্রথম চলচ্চিত্র অন্তর্ধান–এও ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। অভিনয়জগতে আমার জীবনটা এমনভাবে শুরু হয়েছে, যেখানে আমার আইডল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আমাকে খুব স্নেহ করেন। আমি তাঁকে অনুসরণ করার চেষ্টা করি। আরেকটা হলো, তাঁর বামপন্থা। তাঁর যে আদর্শ, আমিও সেটাতেই বিশ্বাসী। কোনো সমাজের উন্নতি যদি করতে হয়, আমি বিশ্বাস করি, বামপন্থাই তার একমাত্র উপায়।’

উত্তরার শুটিংবাড়ির এই ঘরটাতেই শুধু এসি চলছিল। ছবির নাম গণ্ডি। ফাখরুল আরেফীন খানের পরিচালনায় এ ছবিতে অভিনয় করতে এসেছেন তিনি। একেকটা শট দিয়ে এখানে এসে বসছিলেন। কখনো ছেলের সঙ্গে, কখনো নাতির সঙ্গে ছিল শট, তাই পাঞ্জাবি পরিবর্তন করতে হচ্ছিল বারবার। আমরা বলছিলাম, ‘আপনার কষ্ট হচ্ছে না তো? অস্বস্তি বোধ করছেন না তো?’ তিনি যেন ধৈর্যের অবতার। অবসরে কথা না বললে যেন তাঁর ভালোই লাগে না।

মঞ্চে ফেলুদা

আমাদের মনে হলো, মঞ্চে ফেলুদার বিষয়টি শুনে ফেলি। বইয়ের পাতায়, টেলিভিশনে, সিনেমাতে দেখা গেছে ফেলুদাকে, সেই ফেলুদাই আবার মঞ্চ মাতিয়েছে! ফেলুদাকে নিয়ে মঞ্চনাটক করার বিষয়টি সব্যসাচী জানালেন এভাবে, ‘আমরা যখন ভাবছিলাম, এরপর মঞ্চে কোন নাটক করব, তখন অরিন্দম গাঙ্গুলি বলল, একটা ফেলুদার নাটক করা যাবে। কোনটা? আমরা দেখলাম, ফেলুদার তো বেশির ভাগই ট্রাভেলগ। অরিন্দমকে বললাম, তুমি পড়ে দেখ ভাই। তোমার যে গল্পটা মনে হবে, সেটা নিয়েই আমরা কাজ করব। থিয়েটার–সংক্রান্ত একটা গল্প পাওয়া গেল। “অপ্সরা থিয়েটারের মামলা”। সত্যজিৎ রায়, সন্দীপ রায় বলেছেন, ওইটা ফেলুদার সবচেয়ে দুর্বল গল্প। ওটা দিয়ে সিনেমা বা টেলিভিশনে সিরিয়াল করা যাবে না। আমরা সে গল্পের রাইটস পেয়ে গেলাম। অরিন্দম গাঙ্গুলি লিখলেন। আমরা ১০২টি শো করেছি এই নাটকের। আমার বড় ছেলে করত তোপসে, সুবীর রায় চৌধুরী করতেন জটায়ু।’

যখন শুরু

এ সময় প্রথম আলো থেকে যাওয়া আমাদের চারজনের একজন, আদর রহমানের জানতে ইচ্ছে হয় সব্যসাচী চক্রবর্তীর ফেলুদার শুরুর কথা।

মনে হয় অনেকবারই এ নিয়ে কথা বলতে হয়েছে সব্যসাচীকে। তাই দ্রুত বলে গেলেন। ‘আমাকে সন্দীপ রায় ডাকেন বাক্য রহস্য–এর জন্য। আমি তাঁকে আগেই বলে রেখেছিলাম, যদি ফেলুদা করেন, তাহলে আমাকে ডাকবেন। আমি ইন্টারেস্টেড। তো মেকআপ টেস্ট হলো। সেদিন সে সময় থাকলেন সন্দীপদা, ললিতা রায় ও বিজয়া রায়। মেকআপ করার পর তাঁরা আমাকে এভাবে দেখলেন ওভাবে দেখলেন। তাঁরা তাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে। আমি খুব নার্ভাস হয়ে গেলাম। বিজয়া রায় বললেন, ‘ ভালোই তো লাগছে। এরপর এক মাসের মধ্যেই শুটিং শুরু হয়ে গেল। প্রথম শট ছিল হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তিনি খুব সাহায্য করলেন। এক সময় শেষ হলো। দেখানো হলো, সবাই প্রশংসা করল। বুঝলাম, ফেল করিনি। তবে সন্দীপদা বললেন, ভালোই হয়েছে, বুঝলে। কিন্তু তুমি বড় গম্ভীর হয়ে সংলাপ বলছ। বাচ্চারা তোমাকে ভয় পাচ্ছে। এরপর যতটুকু পারি, সাধ্যমতো মোলায়েম করার চেষ্টা করেছি কণ্ঠ।’

আবার কি ফেলুদা আসছেন?

সব্যসাচী চক্রবর্তী বললেন, ‘হ্যাঁ, আবার ফেলুদা হওয়ার সুযোগ আছে। তবে কবে হবে জানা নেই। কারণ, জটায়ুকে পাওয়া যাচ্ছে না। জটায়ু না থাকলে ছবি করা যায় না। ফেলুদার সব কটি গল্পই হচ্ছে হু ডান ইট। বইয়ে কে দোষী সেটা জানা যায় শেষে। কিন্তু সিনেমার ফরম্যাট উল্টো। সেটা শুরুতেই বলে দেওয়া হয় কে দোষী, ফেলুদা শেষে তাকে ধরে ফেলে। এ রকম একটা গল্পে জটায়ু থাকাটা আবশ্যিক। জটায়ু না পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তত দিনে আমি আর করতে পারব কি না, জানি না। তবে আশা রাখছি করতে পারব। ভাবছি, চুলটাকে একটু কালো করতে হবে, ভুঁড়িটাকে কমাতে হবে আর একটু মনে হয় ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করতে হবে...

আমরা সব্যসাচী চক্রবর্তীর দিকে তাকালাম। ষাট পেরুনো সব্যসাচীকে দেখে মনে হলো যেন ফেলুদাকেই দেখছি। সব্যসাচীর জন্য ২৮ বছরের ফেলুদা হওয়া কোনো ব্যাপার বলেই মনে হলো না।