টেলিভিশন নাটক ও টেলিছবিতে শিল্পী নির্বাচনে স্বাধীনতা নেই পরিচালকের

মোশাররফ করিম, জাকিয়া বারী মম, চঞ্চল চৌধুরী ও মেহ্‌জাবীন চৌধুরীরা ভালো অভিনয় করেন। কিন্তু চাহিদা থাকায় ঘুরেফিরে তাঁদেরই দেখা যায় টেলিভিশন নাটকে। ছবি: প্রথম আলো
মোশাররফ করিম, জাকিয়া বারী মম, চঞ্চল চৌধুরী ও মেহ্‌জাবীন চৌধুরীরা ভালো অভিনয় করেন। কিন্তু চাহিদা থাকায় ঘুরেফিরে তাঁদেরই দেখা যায় টেলিভিশন নাটকে। ছবি: প্রথম আলো

টেলিভিশন নাটকে ঘুরেফিরে হাতে গোনা কয়েকটি মুখই দেখা যায়। কারণ, পরিচালকের শিল্পী পছন্দ করার স্বাধীনতা নেই। এজেন্সি ও টেলিভিশন কর্তৃপক্ষের চাপে পড়ে অভিনয়শিল্পী চূড়ান্ত করতে হয় এখনকার বেশির ভাগ পরিচালককে—এমনটাই জানিয়েছেন পরিচালক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। কয়েক বছর ধরে এ সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে।

কয়েকজন পরিচালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইদানীং সব নাটক ও টেলিছবিতে যেসব অভিনয়শিল্পীকে নিতে বাধ্য তাঁরা, তাঁদের মধ্যে আছেন মোশাররফ করিম, চঞ্চল চৌধুরী, অপূর্ব, আফরান নিশো, মম, মেহ্জাবীন, শবনম ফারিয়া, তানজিন তিশা। তাঁরা যে সবাই ভালো মাপের শিল্পী এতে কেউ দ্বিমত পোষণ করেননি। তবে চাপের কারণে পর্যাপ্ত সময় দিতে না পারায় মনের মতো কাজ করতে পারেন না এই শিল্পীরা।

কয়েক বছর আগেও বেছে বেছে অভিনয়শিল্পী নিতে পারতেন পরিচালকেরা। থাকত একাধিক বিকল্প। চরিত্র উপযোগী অভিনয়শিল্পীকে বের করে নিতে পারতেন পরিচালকেরা। এখন সেই সুযোগ নেই বললেই চলে। পরিচালকের কাছে যে শিল্পীর ব্যাপারে নির্দেশনা আসে, তাঁকে নিয়েই কাজ করতে হয়। ডিরেক্টরস গিল্ডের সভাপতি সালাউদ্দিন লাভলু বলেন, ‘ঘুরেফিরে একই মুখ দেখতে দেখতে দর্শকেরা কয়েক বছর ধরে ত্যক্ত–বিরক্ত। শুটিংয়ের জন্য বাংলাদেশের আনাচকানাচে যেখানে যাই, বিরক্তির কারণটা উপলব্ধি করতে পারি। গ্রামীণ পটভূমি, শহুরে গল্প, কমেডি এবং প্রেম—সব ধরনের নাটকে ঘুরেফিরে তিন–চারটা ছেলে কাজ করছে। বাংলাদেশে কিন্তু প্রচুর অভিনয়শিল্পী আছেন, তারপরও পরিচালকদের স্বাধীনতা না থাকায় এই চক্র থেকে বের হওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ জন্য টেলিভিশনের অনুষ্ঠান বিভাগ ও বিপণন বিভাগ দোহাই দেয় পৃষ্ঠপোষক ও এজেন্সির। সব মিলিয়ে “স্পন্সররা চায়” এই দোহাই দিয়েই কাজগুলো হচ্ছে।’

কয়েকজন টিভি নাটকের পরিচালকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁরা টেলিভিশনের চাঙ্ক বিক্রি করা নিয়ে বিরক্ত। ঈদের সময় বেশির ভাগ টিভি চ্যানেলেরই চাঙ্ক কিনে নিয়েছিল এজেন্সি। এজেন্সিই ঠিক করে দিয়েছে তারা নাটকে কোন শিল্পীদের চায় এবং কোন সময় সে নাটক প্রচার হবে। এতে প্রশ্ন উঠেছে, যদি সবকিছু এজেন্সির হাতেই ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে চ্যানেলের বিপণন বিভাগ কী কাজ করে?

প্রযোজনা ও এজেন্সি আলফা কমিউনিকেশনের ব্যবস্থাপন পরিচালক শাহরিয়ার শাকিল বলেন, ‘সাধারণত একটি গল্প থেকে চিত্রনাট্য হয়, সেই চিত্রনাট্য ধরে পরিচালক তাঁর নাটক বা টেলিছবিটি তৈরি করেন। যদি ধারাবাহিকভাবে কাজ এগিয়ে নিতে হয়, তাহলে কাস্টিং ডিরেক্টরের কাজ হলো কোন চরিত্রে কাকে নেওয়া হবে, সেটা ঠিক করা। কিন্তু আমাদের দেশে কাস্টিং ডিরেক্টরের ব্যাপারটাই সেভাবে নেই। পরিচালকই সে ক্ষেত্রে চরিত্র অনুযায়ী শিল্পী নির্বাচন করবেন। কিন্তু এখানে পরিচালকের হাত–পা বাঁধা। এজেন্সির দাপটে তাঁরা সেভাবে দাঁড়াতে পারেন না। বড় সমস্যা দেখা দেয়, যখন শিল্পী নির্বাচন করার পর নাটক নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এতে নাটকের মান পড়ে যায়। পরিচালকেরও তাঁদের অবস্থানে অনড় থাকতে হবে।’

জানা গেল, ডিরেক্টর গিল্ডের সদস্যসংখ্যা ৫৬৪। এর মধ্যে ২০-৩০ জন নিয়মিত কাজ করছেন। বাকিদের দিন কাটছে অনিশ্চয়তার মধ্যে। চরিত্রাভিনয়শিল্পীসহ দেশে অভিনয়শিল্পী রয়েছেন ৭০০–র বেশি। অথচ নিয়মিত অভিনয় করছেন ৪০-৫০ জন!

প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান দৃকের সৈয়দ ইরফান উল্লাহকে হস্তক্ষেপের বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘হস্তক্ষেপের বিষয়টা আমরাও শুনেছি। কিন্তু এটা মোটেও ঠিক না। আমি মনে করি, প্রযোজক ও পরিচালক মিলে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, এই নাটকের জন্য কোন শিল্পীদের নিলে ভালো হয়।’

চ্যানেল আইয়ের বিপণন বিভাগের প্রধান ইবনে হাসান খান বলেন, ‘আমরা পরিচালকদের বলি, ভালো গল্প অনুযায়ী উপযুক্ত শিল্পী নির্বাচন করুন। আমি বিরক্ত হই বরং এই ভেবে, কোনো পরিচালক পরিকল্পনা জমা দেওয়ার কিছুদিন পর বলেন, অমুক শিল্পীর তো শিডিউল নাই। তমুককে নিয়ে করে ফেলি। তখন বলি, আপনি গল্পটা তৈরি করেছেন একজন শিল্পীকে কেন্দ্র করে, এখন আরেকজনকে নিলে তো গল্প বদলাতে হবে। অপেক্ষা করেন।’

ইবনে হাসান এও বলেন, ‘এখন বেশির ভাগ টেলিভিশন চ্যানেল বিনিয়োগ করে নাটক বানাতে পারছে না। এজেন্সির কাছে ধরনা দিয়ে নাটক নিচ্ছে। এজেন্সি যা সরবরাহ করে, সেটাই সম্প্রচার করতে হয়। তাই এই ধরনের সমস্যা তৈরি হয়। আমরা কিন্তু সজ্ঞানে কোনো অবস্থায় ঈদের মতো বড় উৎসবেও একজন তারকার সর্বোচ্চ দুটোর বেশি নাটক প্রচার করি না। এর মধ্যে একটি টেলিছবি। দর্শককে বৈচিত্র্য দেওয়াটাই আমাদের প্রধান টার্গেট থাকে।’

ডিরেক্টর গিল্ডের সাধারণ সম্পাদক এস এ হক অলিক বলেন, ‘আগে আমরা গল্প পাওয়ার পর কয়েকজনের নাম দিতাম। ইদানীং নির্মাতাদের বলে দেওয়া হচ্ছে, অমুক অমুক শিল্পীকে নেন। টেলিভিশন খুললেই তাঁদের দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে শিল্পীদের ওপরও চাপ পড়ছে। যে কাজের জন্য যতটা সময় দরকার, ততটা সময় তাঁরাও দিতে পারছেন না।

অভিনয় শিল্পী সংঘের সভাপতি শহীদুজ্জামান সেলিম বলেন, ‘আমাকে কখনো এসবের মধ্য দিয়ে যেতে হয়নি। তবে এখন তো শুনি স্বাধীনতা নেই। এটাও নির্ভর করে কে নাটক বা টেলিছবি বানাচ্ছে।’