পুরোনো দলের নতুন নাটক নতুন দলের পুরোনো নাটক

এখন আর শীতের অপেক্ষায় থাকে না ঢাকার নাট্যাঙ্গন। আশ্বিনেই নাটকের মৌসুম জমে গেছে। নতুন নতুন নাটকের খবর আসছে। প্রতি সন্ধ্যায় নতুন–পুরোনো নাটকের মঞ্চায়ন হচ্ছে। ঘটা করে অনুষ্ঠিত হচ্ছে উৎসবও। দর্শকেরও দেখা মিলছে এসব আয়োজনে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় এসব আয়োজনের স্থির ও ভিডিও চিত্র দেখা যাচ্ছে। নতুন নাটক, নতুন দল নিয়ে চলতি সপ্তাহে ঢাকার মঞ্চপাড়া কেমন ছিল, সে খবরই দিচ্ছেন মাসুম আলী
মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে মঞ্চস্থ নতুন নাটক পুলসিরাত-এর একটি দৃশ্য। ছবি: প্রাচ্যনাটের সৌজন্যে
মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে মঞ্চস্থ নতুন নাটক পুলসিরাত-এর একটি দৃশ্য। ছবি: প্রাচ্যনাটের সৌজন্যে

নতুন ধারার গল্প নিয়ে ‘পুলসিরাত’
দুটি নতুন নাটকের খবর মিলেছে। একটি নতুন নাটক, অন্যটি পুরোনো।

শুরু করি নতুন নাটকটি দিয়ে। নাটকের নাম পুলসিরাত। ১৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় বেইলি রোডের বাংলাদেশ মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে উদ্বোধন হয়েছে নতুন নাটক পুলসিরাত। একই দিনে পরপর দুটি প্রদর্শনী হয়েছে এ নাটকের। প্রথমটি আমন্ত্রিত দর্শকের জন্য, দ্বিতীয় প্রদর্শনীটি দর্শক টিকিট কেটে উপভোগ করেছেন। এটি প্রাচ্যনাটের নাটক। নাটকটি দর্শকের আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল। কেননা, গল্পটি ব্যতিক্রম। এ ধরনের গল্পের নাটক নিকট অতীতে ঢাকার মঞ্চে দেখা যায়নি। ফিলিস্তিনি লেখক ঘাসান কানাফানির ম্যান ইন দ্য সান উপন্যাস অবলম্বনে পুলসিরাত-এর নাট্যরূপ দেওয়া হয়েছে। নির্দেশনা দিয়েছেন কাজী তৌফিকুল ইসলাম। উপন্যাসটির বাংলা অনুবাদ করেছেন মাসুমুল আলম। নাট্যরূপ দিয়েছেন মনিরুল ইসলাম।

ছিমছাম মঞ্চ। সেটে খুব বেশি বাড়াবাড়ি নেই। নির্দেশক নাটক পরিবেশনে আলোর সহযোগিতা বেশি নিয়েছেন বলে মনে হলো। নাটকের গল্পের কেন্দ্রে তিন মানবসন্তান—আবু কায়েস, আসাদ ও মারওয়ান। নিজেদের ভাগ্যান্বেষণের জন্য ফিলিস্তিন থেকে স্বপ্নের কুয়েতে পাড়ি জমাতে চায়। তিনজন বয়সে আর প্রজন্মে আলাদা হলেও এক জায়গায় মিল, তারা সবাই উদ্বাস্তু। এই তিনজনকে কুয়েত পৌঁছাতে আপ্রাণ চেষ্টা করে আবুল খাইজুরান নামের চতুর্থ একজন। খাইজুরান আসলে লরির ড্রাইভার, কুয়েত পর্যন্ত তাদের নিরাপদে পৌঁছে দিতে এগিয়ে আসে, এভাবেই শুরু গল্পের। এই চারজনের আশা–নৈরাশ্য, তাদের বর্তমান ও অতীতের ঘটনাপ্রবাহের মিশ্রণে এগিয়ে যায় সময়।

তিনজনেরই আলাদা গল্প আছে। আবু কায়েসের ঘরে দুই সন্তান ও স্ত্রী। তাদের রেখে বন্ধুর পরামর্শে একটু ভালো করে বাঁচা, একটু বেশি রোজগারের আশায় কুয়েত পাড়ি দিতে চায় সে। আবু কায়েসের স্বপ্ন, তার সন্তানেরা স্কুলে পড়াশোনা করতে পারবে। বয়সের কারণেই হোক বা চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যই হোক, আবু কায়েস স্বভাবে বেশ নরম ও কিছুটা ভিতু। আর তার ঠিক বিপরীত চরিত্রের আসাদ। টগবগে তরুণ। কিছুটা রাগী, স্বভাবে বেশ কৌশলী। সে এর আগেও সীমান্ত পার হয়ে অবৈধ পথে কুয়েত যেতে চেষ্টা করেছিল। নিশ্চিত ও উন্নত ভবিষ্যৎ, চাচাতো বোনকে বিয়ে করার স্বপ্ন তার। অন্যদিকে ১৬ বছরের মারওয়ান স্কুলের পড়াশোনা ছেড়ে নিজের পরিবারের দায়িত্বের চাপে পাড়ি দিতে চায় স্বপ্নের কুয়েতে। মারওয়ানের বড় ভাই কুয়েত থাকে। সেখানে সে কাজ করে দেশে পরিবারের জন্য টাকা পাঠাত। কিন্তু বিয়ে করে টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেয় সে। মারওয়ানের বাবা সন্তানদের ভরণপোষণে অপারগ হয়ে নিজের সচ্ছল জীবনের স্বপ্নপূরণে এক পঙ্গু মহিলাকে বিয়ে করে আলাদা হয়ে যায়। মারওয়ান তাই পরিবারকে বাঁচাতে অর্থ উপার্জনের স্বপ্ন নিয়ে পাড়ি দিতে চায় কুয়েত।

আগস্ট মাসের প্রচণ্ড গরমে, রোদে পুড়ে মরুভূমির পথে লরিটি এগিয়ে যায়। তিনটি হতভাগ্য জীবন ছুটে চলে স্বপ্নময় এক নতুন সচ্ছল জীবনের প্রত্যাশায়। নির্দেশক কাজী তৌফিকুল ইসলাম বলেন, কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে দায়ী করে নয়, ঘটনা পরম্পরার মধ্য দিয়ে রূঢ় বাস্তবতার শিকার এক জনগোষ্ঠী। এই চারজন হতভাগ্য মানুষের ভবিষ্যৎ নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ আখ্যানের মাধ্যমে বিবৃত। এই মরুভূমি যেন সেই জীবনের রাস্তা, যা প্রতিটি মানুষ যাপন করে। এরা তো প্রতিনিধিত্ব করে উপমহাদেশীয় অর্থনৈতিক উদ্বাস্তুদের, যারা ক্রমাগত ভিড় করছে উন্নত বিশ্বে।

 নাটকটিতে অভিনয় করেছেন আজাদ আবুল কালাম, শাহরিয়ার ফেরদৌস, সাইফুল জার্নাল, মিতুল রহমান, জগন্ময় পাল, মনিরুল ইসলাম, চেতনা রহমান, তানজি কুন, শামীম শ্রাবণ প্রমুখ।

অনুস্বর নিয়ে আসছে ‘অনুদ্ধারণীয়’

বছরের শুরুতে দর্শকের জন্য নতুন নাটক উপহার দিয়েছিল থিয়েটার আর্ট ইউনিট। ১১ জানুয়ারি জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে দলের ৩২তম প্রযোজনা অনুদ্ধারণীয়রপ্রথম প্রদর্শনী হয়। এরপর ২০ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুরে ‘হাজার দুয়ারী নাট্যোৎসব’-এ নাটকটির দ্বিতীয় প্রদর্শনী হয়। নাটকটি নতুন করে আবার মঞ্চে আনছে নতুন নাটকের দল অনুস্বর।

শিল্পকলা একাডেমিতে চলছে অনুদ্ধারণীয় নাটকটির মহড়া। ছবি: আনন্দ
শিল্পকলা একাডেমিতে চলছে অনুদ্ধারণীয় নাটকটির মহড়া। ছবি: আনন্দ

অল্প কিছুদিনের ব্যবধানে পুরোনো নাটকের নতুন করে মঞ্চে আসার কারণ একটাই, দলত্যাগ। নতুন নাটক আর পুরোনো নাটকের একের পর এক সফল মঞ্চায়নে বেশ চলছিল থিয়েটার আর্ট ইউনিটের যাত্রা। এর মধ্যে হুট করেই ৭ জুলাই থিয়েটার আর্ট ইউনিটের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য মোহাম্মদ বারী ঘোষণা দিয়ে দল ছেড়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তিনি দলত্যাগের ঘোষণা দেন। কাছাকাছি সময়ে দলের জ্যেষ্ঠ সদস্য সাইফ সুমন, প্রশান্ত হালদার ও সাথী রঞ্জন দে দল ছাড়ার ঘোষণা দেন। একে একে সব মিলিয়ে থিয়েটার আর্ট ইউনিটের ২৭ সদস্যসহ মোট ২৮ জন নিয়ে নতুন দল গঠনের ঘোষণা দেন মোহাম্মদ বারী। সে সময় তিনি সেপ্টেম্বরে অনুদ্ধারণীয় নাটকটি মঞ্চে আনার ঘোষণা দেন।

কথা রেখেছে অনুস্বর। আনছে দলের প্রথম প্রযোজনা, বুদ্ধদেব বসুর ছোটগল্প অবলম্বনে নাটক অনুদ্ধারণীয়। মোহাম্মদ বারীর নির্দেশনায় ২১ সেপ্টেম্বর শনিবার সন্ধ্যা ৭টায় মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে নাটকটির উদ্বোধনী প্রদর্শনী হবে। মোহাম্মদ বারী বলেন, ‘আমরা নিয়মিত মহড়া করছি। এতে বেশির ভাগ চরিত্রই পুরোনো। মাত্র তিনটি নতুন মুখ আসবে। সেট এবং সংগীত পরিবর্তন হবে।’ নাটকটি থিয়েটার আর্ট ইউনিটের নতুন নাটক, তারা এটি নতুন দল নিয়ে করতে পারবে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ বারী বলেন, ‘নাটকটি আমার নিজের লেখা এবং নির্দেশনা দেওয়া। নিয়ম অনুযায়ী এর কপিরাইটও আমার। কাজেই চাইলে আমি নতুন উদ্যোগে নাটকটি করতে পারি। চাইলে ওরাও (থিয়েটার আর্ট ইউনিট) নাটকটি চালিয়ে যেতে পারে। ঢাকার মঞ্চে তো একই নাটক একাধিক দল করেই থাকে।’

অনুদ্ধারণীয় মূলত প্রতিষ্ঠানবিরোধী তারুণ্যের রোমান্টিসিজমের গল্প। দুটি চরিত্র—কবি ও কবিভক্ত অমিতের চূড়ান্ত দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায় কাহিনি। এ গল্পই নতুন নাটকের দল অনুস্বরের পরিবেশনায় আসছে শনিবার দেখা যাবে, নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে।