জোকারকে নিয়ে হাসবেন না

‘জোকার’ ছবির ঢাকা প্রিমিয়ার শুরুর আগে হল ভর্তি দর্শক। ছবি: সিনেপ্লেক্সের সৌজন্যে
‘জোকার’ ছবির ঢাকা প্রিমিয়ার শুরুর আগে হল ভর্তি দর্শক। ছবি: সিনেপ্লেক্সের সৌজন্যে

বিশ্ব চলচ্চিত্রে এই মুহূর্তে যে নামটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে, সেটি ‘জোকার’। বাংলাদেশে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় প্রথম দেখা দেন জোকার, জোকিন ফিনিক্স। স্টার সিনেপ্লেক্সে ‘জোকার’ ছবির প্রিমিয়ার শোতে। এর আগে জোকার চরিত্রটি জীবিত হয়েছে হিথ লেজার, জ্যাক নিকলসন, জেরার লেটো, সিজার রোমেরোদের মতো মেধাবী অভিনয়শিল্পীদের শরীরে। এবার সেই তালিকায় যুক্ত হলেন জোকিন ফিনিক্স।

জোকারের মুক্তি
ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে গত ৩১ আগস্ট ‘জোকার’ ছবির ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হয়। আর ছবি শেষ হওয়ার পর করতালি যেন থামছিল না। আট মিনিট ধরে ‘স্ট্যান্ডিং অভিশন’ পায় জোকার। আর পায় ৭৮তম ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবের সেরা ছবি ‘গোল্ডেন লায়ন’ পুরস্কার। এরপর ৯ সেপ্টেম্বর টরন্টো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয় ছবিটি। আজ ৪ অক্টোবর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তি পায় ছবিটি। বাংলাদেশেও স্টার সিনেপ্লেক্সে আজ শুক্রবার থেকে দেখা যাবে ছবিটি।

চোখে জল থাকলে কী হবে, মুখে যে হাসি রাখতেই হবে। ‘জোকার’ ছবির দৃশ্য। ছবি: ছবির ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া
চোখে জল থাকলে কী হবে, মুখে যে হাসি রাখতেই হবে। ‘জোকার’ ছবির দৃশ্য। ছবি: ছবির ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

জোকিন ফিনিক্স কেমন জোকার?
এবার জোকার হয়েছেন অস্কারে মনোনয়ন পাওয়া অভিনেতা জোকিন ফিনিক্স। পরিচালনা করেছেন অস্কারে মনোনয়ন পাওয়া পরিচালক টড ফিলিপস। আর গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন অস্কারজয়ী অভিনেতা রবার্ট ডি নিরো। ‘জোকার’ ছবি নিয়ে যখন চারদিকে সমালোচনা, তখন রবার্ট ডি নিরো বললেন, এই ছবিতে দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন জোকিন ফিনিক্স। আর আরেক অভিনয়শিল্পী জ্যাজি বিৎস বলেছেন, জোকিনের সঙ্গে পর্দা ভাগ করা তাঁর জন্য অত্যন্ত সম্মানের।

কেন জোকিন জোকার হলেন?
এই চরিত্রের জন্য প্রথমে অস্কারজয়ী অভিনেতা লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিওকে ভাবা হয়। কিন্তু জোকিন ফিনিক্সকে নাকি শুরু থেকেই টানত এই ‘ডার্ক’ চরিত্র। আর্থার ফ্লেককে (জোকার) নাকি তাঁর খুব আপন বলে মনে হতো। এক সাক্ষাৎকারে ৪৪ বছর বয়সী এই অভিনেতা বলেন, ‘পড়তে পড়তে বা বড় পর্দায় দেখতে দেখতে আমার মনে হতো, আমি যেন জোকারকে বুঝতে পারছি। এরপর সে কী করবে, তা যেন আমি ধরতে পারছি।’ আবার পরিচালকও এই অভিনেতার ভেতর জোকারকে খুঁজে পেয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘জোকারকে যেমন আগে থেকে অনুমান করা যায় না, জোকিনের ক্ষেত্রেও তাই।’

খুনের পর এভাবেই নৃত্য উৎসবে মেতে ওঠে জোকার। ছবি: ছবির ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া
খুনের পর এভাবেই নৃত্য উৎসবে মেতে ওঠে জোকার। ছবি: ছবির ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

জোকিনের জোকার হয়ে ওঠা
জোকিন ফিনিক্স জোকার হওয়ার জন্য ২৪ কেজি (৫২ পাউন্ড) ওজন ঝরিয়েছেন। দ্য নিউইয়র্ক পোস্টের মতে, একদম অন্যরকম জোকার হওয়ার জন্য তিনি সম্ভব সবকিছুই করেছেন। প্যাথলজিক্যাল লাফটার বা মানসিকভাবে বিকারগ্রস্তদের মতো অস্বাভাবিক হাসি শেখার জন্য তিনি দিনের পর দিন সত্যিকারের সাইকোপ্যাথদের হাসির ভিডিও দেখেছেন। তাঁদের সঙ্গে মিশেছেন, কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। আর সিরিয়াল কিলারদের নিয়ে লেখা অসংখ্য সাহিত্য পড়েছেন। ওই চরিত্রদের মনোজগৎ কীভাবে কাজ করে, তা বুঝতে চেষ্টা করেছেন। বই অর্ধেক পড়ে বাকিটা নিজে নিজে ভেবে পরে মিলিয়ে দেখেছেন। তাঁরা কেন এই হত্যাকাণ্ডগুলো করছে, তা বোঝার চেষ্টা করেছেন।

জোকারদের মুখে হাসি না থাকলে কি আর চলে। ছবি: ছবির ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া
জোকারদের মুখে হাসি না থাকলে কি আর চলে। ছবি: ছবির ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

‘জোকার’ ছবি
দুই ঘণ্টা এক মিনিটের ছবি ‘জোকার’। ১৯৮১ সালের প্রেক্ষাপটে নির্মিত। যাকে বলে ‘ওয়ান ম্যান শো’। ‘দ্য ডার্ক নাইট’ ছবির জোকার হিথ লেজারের সঙ্গে ফিনিক্সকে মেলানো যাবে না। প্রায় প্রতিটি দৃশ্যে তাঁর উপস্থিতি। এটি একজন ব্যর্থ মাতৃভক্ত কমেডিয়ানের হিংস্র সিরিয়াল কিলার হয়ে ওঠার গল্প। এর আগে একজন সাইকোপ্যাথের এত শক্তিশালী চরিত্রায়ণ খুব কম হয়েছে। সবাই তাঁকে অগ্রাহ্য ও কমবেশি হাসাহাসি করায় নিজের অস্তিত্বের জানান দিতে পাগল হয়ে ওঠে জন্মপরিচয়হীন জোকার। তাঁর কমেডি দেখে মানুষ হাসেনি, হেসেছে তাঁকে নিয়ে। ক্ষুব্ধ, অবহেলিত জোকার একসময় শহরের সবচেয়ে ভীতিকর খুনি হয়ে ওঠে। জোকারের হত্যার সঙ্গে যেভাবে ধনীবিরোধী আন্দোলনকে মেলানো হয়, তা অযৌক্তিক। তাই সে বলে, ‘হ্যাঁ, আমি আছি।’ সিনেমায় একের পর এক ঘটনা ঘটতে থাকে। কিন্তু এর কোনোটিই সম্ভবত আপনি আগে থেকে অনুমান করতে পারবেন না। অর্ধেক দৃশ্য আর অর্ধেক শব্দ মিলে নাকি চলচ্চিত্র। সঙ্গে এই ছবির শতকরা ৬০ ভাগ ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর আর মিউজিক। সাসপেন্স তৈরি করা ও ধরে রাখাতে ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছে। আর বাকিটা জোকিন ফিনিক্সের অভিনয়। জোকার চরিত্রে হিথ লেজারকে যেমন মানুষ মনে রাখতে বাধ্য, জোকিনকেও ভোলা কঠিন হবে। তবে হ্যাঁ, নৃশংস হত্যার দৃশ্য দেখে হলের ভেতর যেভাবে মানুষ হাততালি দিয়ে উঠেছে, সেটা অবশ্যই ভীতিজনক। তাই এই ছবি যে এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের জন্য সবার সমর্থন পাওয়ার জন্য পরোক্ষ ভূমিকা রাখবে, তা বলাই বাহুল্য।

জোকারের মুখোশের আড়ালে জোকিন ফিনিক্স। ছবি: ইনস্টাগ্রাম
জোকারের মুখোশের আড়ালে জোকিন ফিনিক্স। ছবি: ইনস্টাগ্রাম

‘জোকার’ নিয়ে যত সমালোচনা
দ্য গার্ডিয়ান ইতিমধ্যে জোকারকে বছরের সবচেয়ে হতাশাজনক ছবি বলে আখ্যায়িত করেছে। বলা হয়েছে, এই ছবির গল্প বাজে এবং ম্যাড়মেড়ে। ছবিটি ভেনিসের সেরা ছবি হওয়ায় নিউইয়র্ক পোস্ট ছবির রিভিউয়ে লিখেছে, ‘তুমি কি আমার সঙ্গে মজা করছ?’ সব মিলিয়ে, বিষয়বস্তুর দিক থেকে ছবিটাকে খুবই কম নম্বর দিয়েছেন সমালোচকেরা। উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বলেছেন, ‘এই ছবির ফলস্বরূপ গান কিলিং বেড়ে যেতে পারে। আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটতে পারে।’ একজন সিরিয়াল কিলারকে হিরোর আসনে বসানো হয়েছে, তাঁর খুনকে সমর্থন করা হয়েছে বলেও অভিযোগ এসেছে। এমনকি ২৮ সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই ছবির প্রিমিয়ারের দিন পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। এই ছবিতে নৃশংসভাবে হত্যার দৃশ্য আছে। যা দেখলে মানুষের মনোজগতে যে পরিবর্তন আসবে, সেটি মোটেও ইতিবাচক নয়। ট্রল, প্রতিহিংসার অস্থির সময়ে এই ছবি অস্থিরতা আরও বাড়াবে। সেটা শরীরের ভেতর থেকে বাইরে বেরিয়ে পড়া অস্বাভাবিক নয়। শিশুকে নিয়ে এই ছবি দেখা ঠিক হবে না।