সুমিতের চলচ্চিত্রকাব্য

>মাঝখানে কেবল একটা দেয়াল। দেয়ালের এপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ (ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন), আর ওপারে চারুকলা অনুষদ। ছোটবেলা থেকে বই, চলচ্চিত্র আর শিল্পের নানা মাধ্যমের হাত ধরে বড় হওয়া রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিতের মন পড়ে থাকত ওপারে। তাই আইবিএতে মার্কেটিংয়ের ক্লাস শেষ করে বেশির ভাগ সময় কাটত চারুকলায়। ১৫ অক্টোবর যখন কথা চলছে এই নির্মাতার সঙ্গে, তখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে। আরেক নির্মাতা ও প্রযোজক আরিফুর রহমানের সঙ্গে যৌথভাবে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে অংশ নিয়েছেন গ্লোবাল মিডিয়া মেকারস প্রোগ্রামে।
রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিত
রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিত

চারুকলা অনুষদের দেয়ালে সাঁটা এক পোস্টারে একদিন চোখ পড়ে সুমিতের। বাংলাদেশ ফিল্ম ইনস্টিটিউশনের এক মাসের ‘ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সে’র পোস্টার। ক্যামেরার পেছনে কী হয় জানার কৌতূহল থেকে ভর্তি হয়ে গেলেন। সেখানে প্রতিদিন ক্লাসে তানভীর মোকাম্মেলের সঙ্গে চলচ্চিত্রবিষয়ক নানা আলাপ হতো। আর আলাপ শেষে সেই আলোচনার ওপর একটা সিনেমা দেখানো হতো। সেই প্রথম বিশ্ব চলচ্চিত্রের প্রথিতযশাদের সঙ্গে পরিচয়। মূলত সুমিতের ঘাড়ে সেবারই চেপে বসল সিনেমার ভূত। 

তারপর? 
আইবিএতে পড়াশোনা শেষে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান হাফ স্টপ ডাউনে ছয় মাসের শিক্ষানবিশি করেন সুমিত। সেখান থেকে এশিয়াটিকে ইভেন্টস মার্কেটিংয়ে কাজ করেন কিছুদিন। মন টিকল না। তারপর ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নে শুরু করলেন নতুন চাকরি। কিন্তু চলচ্চিত্রকে যিনি মন দিয়েছেন, তাঁর কি আর এসব ভালো লাগে? ঠিক করলেন, চলচ্চিত্রই হবে তাঁর জীবনসঙ্গী। পড়াশোনা করবেন চলচ্চিত্র নিয়ে। বৃত্তিও পেলেন নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির টিশ স্কুল অব দি আর্টসে পরিচালনা ও প্রযোজনা বিষয়ে। অস্কারজয়ী পরিচালক স্পাইক লি ছিলেন তাঁদের প্রোগ্রাম ডিরেক্টর। এ বেলা জানিয়ে রাখি, হলিউড রিপোর্টারের র​্যাঙ্কিং অনুযায়ী, বিশ্বের চলচ্চিত্র নির্মাণ শেখানোর স্কুলের তালিকায় টিশ স্কুল অব দি আর্টসের অবস্থান ৭ম। চারবার অস্কার মনোনয়ন পাওয়া হলিউড পরিচালক চার্লি কফম্যান, অস্কারজয়ী মার্কিন পরিচালক মার্টিন স্করসেসি থেকে শুরু করে অভিনেতা জেমস ফ্র্যাঙ্কো, অস্কারজয়ী সংগীতশিল্পী লেডি গাগাসহ অনেকেই পড়েছেন এই স্কুল থেকে।

নির্মাতার পথচলা
২০০৭ সালে সুমিত নির্মাণ করেন তাঁর প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র সিটি লাইটস। তখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ২১ বছরের তরুণ। গ্রাম থেকে আসা মানুষ শহরের ভিড়ে কীভাবে নিজের পরিচয় হারিয়ে ফেলে, এমনই এক গল্প বলেছিলেন ওই চলচ্চিত্রে। আর তাতেই তিনি আমন্ত্রণ পান বার্লিনালের ট্যালেন্ট হান্ট ক্যাম্পাসে। এই প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো সবচেয়ে তরুণ বাংলাদেশি নির্মাতা তিনিই। তাঁর পরে সেখানে বাংলাদেশ থেকে গিয়েছেন ইশতিয়াক জিকো, রুবাইয়াৎ হোসেন, কামার আহমাদ সাইমনরা। এরপর দুবছর ধরে দিনে চাকরি করে রাতে মনের খোরাক জোগাতে একা হাতে বানিয়েছেন মুন ফেইরি। যা দেখানো হয় কোপেনহেগেন চিলড্রেনস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে। ছবিটি তিন বছর ছিল অনলাইন স্ট্রিমিং প্লাটফর্ম মুভিতে। এখন বিনা মূল্যে দেখা যাবে ভিমিওতে। নিউইয়র্কের তিন বছরে প্রতি সেমিস্টারেই অন্তত একটি প্রকল্পের সঙ্গে কাজ করেছেন। বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের যৌথ প্রযোজনায় শেষ করেছেন তাঁর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নোনাজলের কাব্য। এর মধ্যেই তাঁর পরবর্তী ছবি আ নিউ প্রফেট-এর জন্য পেয়েছেন স্লোন ফাউন্ডেশন গ্র্যান্ট। ১ লাখ ডলার, মানে প্রায় ৮৪ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। এই বিজ্ঞাননির্ভর গল্পটির প্রেক্ষাপট জাদুর শহর ঢাকা। 

নোনাজলের কাব্য ছবির পোস্টার
নোনাজলের কাব্য ছবির পোস্টার

নোনাজলের কাব্য নিয়ে কিছু কথা
চার বছর ধরে চিত্রনাট্য ও সরেজমিন গবেষণা করেছিলেন। তারপর ২০১৮ সালের ১৩ জুলাই অর্ধশতাধিক শিল্পী ও কলাকুশলী মিলে ঘোর বর্ষায় পটুয়াখালী ও চট্টগ্রামে হয়েছিল শুটিং। তা শেষ হয় অক্টোবরের ৩ তারিখে। এই ছবিতে আছেন ফজলুর রহমান বাবু, তিতাস জিয়া, তাসনুভা তামান্না, শতাব্দী ওয়াদুদ, রোজি সিদ্দিকী, অশোক ব্যাপারী, আমিনুর রহমান মুকুলসহ আরও অনেকে। সংগীতায়োজন করেছেন শায়ান চৌধুরী অর্ণব। প্রযোজক ও কলাকুশলীদের বেশির ভাগই ভিনদেশি। সরকারি অনুদানে পেয়েছিলেন ৫০ লাখ টাকা। আরও প্রায় ৭৫ লাখ টাকা দিয়েছিলেন ফরাসি প্রযোজক ইলান জিরাদ। এ ছাড়া বাংলাদেশ থেকে প্রযোজনা করেছে হাফ স্টপ ডাউন। ইলান জিরাদ অস্কারজয়ী তথ্যচিত্র মার্চ অব দ্য পেঙ্গুইনস–এর প্রযোজক। সম্পাদনা করেছেন রোমানিয়ার লুইজা পারভ্যু ও ভারতের শঙ্খজিৎ বিশ্বাস। শব্দ ও রং সম্পাদনার কাজটি হয়েছিল ফ্রান্সের দুটি বিখ্যাত স্টুডিওতে। যেখানে ডিজনির ছবিরও সম্পাদনা করা হয়।

স্পাইক লির পরামর্শ
নিউইয়র্কে পড়াশোনার সময় সুমিত নোনাজলের কাব্যর চিত্রনাট্যের জন্য ‘স্পাইক লি রাইটিং গ্রান্ট’ পেয়ে যান। তারপর এই প্রকল্প নিয়ে দু–তিন দিন ‘ওয়ান টু ওয়ান’ আলোচনায় বসেন স্পাইক লির সঙ্গে। সমস্তটা পড়ে এবং শুনে স্পাইক লি জানতে চেয়েছিলেন, ‘তুমি বাংলাদেশের একটি গ্রামে, বর্ষাকালে, পানিতে শুটিং করবে?’ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সুমিত বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ।’ স্পাইক লি তখন বলেছিলেন, ‘গড ব্লেস ইউ।’ আর বলেছিলেন, ‘সুমিত, এটা তোমার প্রথম ফিচার ফিল্ম। তাই তোমার আশপাশে যাঁরা থাকবেন, তাঁরা যেন তোমার চেয়ে অভিজ্ঞ হন, বিষয়টি নিশ্চিত কোরো।’ এই উপদেশ খুবই কাজে দিয়েছিল সুমিতের। তাই দলের অন্য সবার অন্তত চারটি ছবির সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল। সবার এই অভিজ্ঞতাই সুমিতের কাজটা অনেক সহজ করে দিয়েছে। 

এ বছর থেকেই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে ছবিটি প্রদর্শনী ও প্রতিযোগিতার জন্য পাঠানো হবে। আগামী বছরের মাঝামাঝি ছবিটি মুক্তি পাবে বাংলাদেশে।