'বাচ্চু ভাই, ভালো থেকো, আমরা ভালো নেই'

আইয়ুব বাচ্চু। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
আইয়ুব বাচ্চু। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

এক বুড়োর মুখে শুনেছিলাম, আপনির ফারাক আর তুইয়ের কাঠিন্যের মধ্যে টান ও ভালোবাসার কোমল জায়গাটুকু হচ্ছে তুমি। তুমি করে বলার ধৃষ্টতা ক্ষমা করো, বাচ্চু ভাই। কেমন আছ?

ওখানে সবাই মিলে জ্যামিং হচ্ছে তো? পরিবেশ নিশ্চয়ই এখান থেকে ভালো। জ্যামিং, সেশনের সব বন্দোবস্ত হওয়ার কথা চাহিবামাত্রই। আজম খান, পিলু মমতাজ, ফিরোজ সাঁই, নয়ন মুনশি, হ্যাপী আখান্দ্‌, শেখ ইশতিয়াক, নিলয় দাশ, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, লাকী আখান্দ্‌…কত নাম! সবাই মিলে কী মজাটাই না করছ। তোমাদের দলই তো ভারী! নিশ্চয়ই প্রচুর অ্যালবাম হচ্ছে? শুনেছি, ওখানে সময় ধরে রাখা যায়। মানুষ ওখানে স্বাধীন।

এখানে এমনিতে সব ঠিক আছে। তুমি যেমন দেখে গেছ। মানুষ আগের মতোই গান শোনে, দেখে, মজা পায়, উত্তেজনা বাড়ে, নিস্তেজ হলে আগের মতোই দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কাঁদে খুব কমই। জিবের তলে তেতো স্বাদটা এখনো অসহ্য হয়ে ওঠেনি। সব পাল্টাচ্ছে, কেমন একটা প্রলেপের মতো, তবে খুব ধীরে। এই এক বছরে বলা কঠিন।

আইয়ুব বাচ্চু। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
আইয়ুব বাচ্চু। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

কিন্তু চিঠিটা যে পড়ছ, তা জানি। কবিরা মিথ্যে ঠিকানা দেয় না। আর শিল্পীরা শ্রোতাদের চিঠি পড়ে না, তা হয় না। পাশে আজম খান থাকলে বলে দিয়ো শরীরের যত্ন নিতে। গান-বাজনার পাশাপাশি ওনার তো খেলাধুলার অভ্যাসও আছে। বলে দিয়ো, বেনসন অ্যান্ড হেজেস কনসার্টে ‘বাংলাদেশ’ গানটা গাওয়ার সময় তোমার কাঁধে হাত রেখে ‘গাও বাচ্চু গাও’ কথাটা এখনো কানে বাজে।

তোমার আর ‘এক্সট্রা কারিকুলাম’ কিছু করা হলো না। সেই গান আর সুর, সুর আর গান। এখন কিন্তু মাল্টি ট্যালেন্টেড হতে হয়, দু-একটা লেগে গেলে হয়ে যায়। তুমি দেখেই গেছ। কেন মনে করিয়ে দিলাম জানি না। এটুকু জানি, অমরত্বটা থাকতেই পেয়েছ। দেশের ভালো গিটারিস্টদের নিয়ে একটা অর্কেস্ট্রার মতো কনসার্ট করতে চেয়েছিলে। হলো না। ধৈর্য ধরো, একদিন সবাইকে পাবে।

তখন জেমসকে বুকে জড়িয়ে ধরো। তুমি যাওয়ার পর মঞ্চে ‘শো মাস্ট গো অন’ বলে ওই রকম কিছু করতে শুধু সে-ই পারে। কয়েক প্রজন্ম সেদিন বুঝেছে, সুস্থ প্রতিযোগিতা কথাটা শুধু কথার কথা না, একসময় সত্যিই ছিল! বাকিটা ভালোবাসা, শ্রদ্ধা যেন কী কী। একটা কথা রাখবে?

ব্যান্ডে যাদের রেখে গেছ, তাদের একটা কথা জিজ্ঞেস করবে। ঠিকানা পাল্টানোর বছর পেরোতেই না এত ভাঙাগড়া, এত টানা পোড়েন? লাভ রানস ব্লাইন্ড—নামটাই তো মিথ্যা হয়ে গেল!

আইয়ুব বাচ্চু। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
আইয়ুব বাচ্চু। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

ওই নাম এখন সম্ভবত শুধুই শ্রোতাদের। কজন শুনল, কজন ভুলল, আখেরই–বা কতজন গোছাল, এ নিয়ে মন খারাপ করো না। জানি, শুনবে না। গান ও সুরের মানুষদের মনখারাপ থাকতে হয়, আর এ তো প্রাপ্যই। কিন্তু মজাটা হলো, কোন প্রদীপ প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম জ্বলবে, তা শ্রোতারা জানে। যেমন ধরো, সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে…।

এ গান তুমি থাকতে অমর, সবাইকে চুপ করিয়ে দেয়। তুমি যাওয়ার পর ‘পেনশন’, ‘হকার’, ‘রিটায়ার্ড ফাদার’, ‘বড় বাবু মাস্টার’, ‘মাকে বলিস’, ‘জারজ সন্তান’, ‘ঢাকার সন্ধ্যা’, ‘এক কাপ চা’ ইউটিউবের ফিচার পেজে দেখি। ঘুমভাঙা শহরের মতো লাগে। এ কোলাহল ওখান থেকে শুনতে পাও? কেমন লাগে?

তখন কি গর্বের সঙ্গে একটু কষ্টও হয়? মিক্সড অ্যালবামে তোমার গান থেকেছে সবার আগে, প্রচ্ছদে শ্রেষ্ঠাংশ। ক্যাসেটের এক পিঠে তুমি, অন্য পিঠে জেমস না হলে হাসান। ঠিক তখন সিনেমাতেও বাজছে তোমার কণ্ঠের সস্তা গান! সে সময়ের সঙ্গে আগেরটুকু মেলাতে কষ্ট হতো। কিন্তু সেদিন বুকের মধ্যে কান্না দলা পাকিয়ে উঠেছিল এক লহমায়। কেমন বিপন্ন বোধ হচ্ছিল। এখন বুঝি ওটা শুধুই দেহত্যাগ।

আইয়ুব বাচ্চু। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
আইয়ুব বাচ্চু। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

এক বছর আগে আজকের সেই স্মৃতিটুকু ছাড়া সবকিছু চলছে আগের মতোই। প্রজন্মের রুচি যেভাবে তৈরি করে দিয়ে গেছ, সেভাবে। শুধু আগের মতো সময় করে ওঠা কঠিন। জীবন ক্যাসেট ছেড়েছে বহু আগেই। কিন্তু প্যাঁচানো ফিতার মতো আটকে আছে শৈশব-কৈশোরের ত্রিভুজ প্রেমের প্রচ্ছদ—আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, হাসান।

শুধু তোমাকেই লিখতে হয় আকাশের ঠিকানায়।

ভালো থেকো। আমরা ভালো নেই।