দেবতা না, দলপতি রহু

‘রহু চণ্ডালের হাড়’ নাটকের একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত
‘রহু চণ্ডালের হাড়’ নাটকের একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত

ভরদুপুর। সূর্য এখন মাথার ওপরে। আকাশে একটা কাকও উড়ছে না। যত দূর চোখ যায় ধু-ধু মাঠ। নেই কোনো মানুষ, গরু-ছাগল। তবে এর মাঝে হেঁটে চলেছে একদল নারী-পুরুষ। একজনের মাথার ওপরে বানর, আরেকজনের ব্যাগে পুতুল, আবার আরেকজনের কাছে জাদু দেখানোর জিনিসপত্র। ওরা বাজিকর। হেঁটে চলেছে সামনের গ্রামটির দিকে। এখনো কয়েক ক্রোশ হেঁটে পার করতে হবে। তবেই পৌঁছতে পারবে সামনের গ্রামটিতে। বাজিকরদের নিত্যদিনের গল্প এ রকমই।

বাজিকরের জীবন অদ্ভুত। নেই কোনো জাত, ধর্ম বা দেশ। পথে পথে ঘুরেই যাদের কেটে যায় দিন। অভিজিৎ সেন রচিত ‘রহু চণ্ডালের হাড়’ বাজিকরদের উত্থান, অদ্ভুত জীবন নিয়েই তৈরি। ১৯৯২ সালে ইংরেজিতে যার অনুবাদ প্রকাশিত হয় ‘ম্যাজিক বোনস’ নামে। একই বছরে তা পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রবর্তিত বঙ্কিমচন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার লাভ করে। গঙ্গা যমুনা সাংস্কৃতিক উৎসব-২০১৯ আয়োজন করা হয় ১১ থেকে ২০ অক্টোবর। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও মহিলা সমিতিতে প্রতিদিন সন্ধ্যা সাতটায় নাটকের আয়োজন ছিল। ১৫ অক্টোবর শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার মিলনায়তনে ছিল আরশিনগর থিয়েটারের প্রযোজনায় নাটকটি, যা নিয়ে এই লেখা।

অভিজিৎ সেন রচিত ‘রহু চণ্ডালের হাড়’ বাজিকরদের উত্থান, অদ্ভুত জীবন নিয়েই তৈরি। ছবি: সংগৃহীত
অভিজিৎ সেন রচিত ‘রহু চণ্ডালের হাড়’ বাজিকরদের উত্থান, অদ্ভুত জীবন নিয়েই তৈরি। ছবি: সংগৃহীত

শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার মিলনায়তনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে আসনবিন্যাসব্যবস্থা চারকোনা ধরনের। অনেকটা চারকোনা টেবিলে বসার মতো করে বসেন দর্শকেরা। সামনাসামনি না বসে কোনাকুনি বসলেই নাটকটি বেশ ভালোভাবে উপভোগ করা যায় বলে আমার মনে হয়েছে। মূল ঘটনায় আসি। রহু চণ্ডালের কাহিনিতে বাজিকরের পাঁচ পুরুষের গল্প উঠে এসেছে। সেখানে দেখানো হয়েছে, তাদের খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা থেকে শুরু করে হৃদয়বিদারক বিতাড়িত হওয়ার ঘটনা। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়। বাজিকর সর্দার পীতেম চেয়েছিল বাজিকরেরা এবার একটা জায়গা পাক। জাতপাত হোক। সহজ কথায় একটা ঠিকানা হোক। কিন্তু তা শুধু স্বপ্নই থেকে যায়। বাজিকরেরা জড়িয়ে পড়ে সাঁওতাল বিদ্রোহে। পীতেমের বড় ছেলে ধন্দু মারা যায়, মেয়ে পেমা ধর্ষিত হয়ে মারা যায়, বাজিকর রমণী সালমা ধর্ষিত হয়, পুলিশ বাজিকরদের আস্তানা গুঁড়িয়ে দেয়।

আরশিনগর থিয়েটারের প্রযোজনায় নাটকটি। ছবি: সংগৃহীত
আরশিনগর থিয়েটারের প্রযোজনায় নাটকটি। ছবি: সংগৃহীত

বাজিকরেরা চাইলেও স্থায়ী ঠিকানা পায় না। বেরিয়ে পড়ে আরেক দেশের জন্য। মালদা নামের দেশে চাষাবাদ শুরু করে। কিন্তু শেষমেশ বাজিকরদের গ্রহণ করে না কেউ। আবার বাজিকরদের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। ভারত-পাকিস্তান ভাগের পরও এই মহাযাত্রা চলতেই থাকে। বাজিকরেরা ঘুরতেই থাকে। কিন্তু সেই যাত্রা থামে না।

দৃশ্য থেকে দৃশ্যে স্থানান্তরের সময় আলোর খেলা, পীতেমের আত্মার বিদায়ের সময়কার দোলনা, পেমার বিদায়, জমিরের মারামারি—সবকিছুই পাকা হাতে পরিচালনার ছোঁয়া পাওয়া যায়। এ ছাড়া প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে আবহসংগীতের ব্যবহার, বাজিকরদের বিভিন্ন শারীরিক কসরত ও অভিনয় চোখে পড়ার মতো ছিল। সুরের ক্ষেত্রে বাজিকরদের গাওয়া প্রাচীন গীতের প্রাধান্যই লক্ষণীয়। নাটকটি প্রথমবার মঞ্চায়িত হয়েছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষ পরীক্ষা প্রযোজনা হিসেবে। দ্বিতীয়বার আরশিনগর থিয়েটারের প্রযোজনায় নাটকটি নির্দেশনা দেন রেজা আরিফ। 

শত বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে বাজিকর নিজের পথ অতিক্রম করে। কিন্তু কখনো থেমে যায় না।