জন্মদিনে কথা-কবিতা-গান-নৃত্যে কবি শামসুর রাহমানকে স্মরণ

কবি শামসুর রাহমানের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেন ইমেরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান । ছবি: প্রথম আলো
কবি শামসুর রাহমানের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেন ইমেরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান । ছবি: প্রথম আলো

কথা ছিল বড় পরিসরে বাংলা একাডেমির রবীন্দ্রচত্বরে অনুষ্ঠিত হবে কবি শামসুর রাহমানের জন্মদিনের অনুষ্ঠান। কিন্তু বৃষ্টির কারণে তা সম্ভব হয়নি। একাডেমির ভেতরে কবির নামে করা কবি শামসুর রাহমান মিলনায়তনে হলো জন্মজয়ন্তী উদ্‌যাপন।

অবশ্য স্বল্প পরিসরে হলেও ভালোবাসা আর আন্তরিকতার কমতি ছিল না। আজ বুধবার বিকেলে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমানের ৯১তম জন্মদিন উদ্‌যাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমি, জাতীয় কবিতা পরিষদ এবং শামসুর রাহমান স্মৃতি পরিষদের যৌথ উদ্যোগে আয়োজনে ছিল প্রাণবন্ত আলোচনা, নিবেদিত কবিতা পাঠ ও সাংস্কৃতিক পর্ব। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।

অনুষ্ঠানের শুরুতে বাংলা একাডেমির সাবেক কর্মকর্তা প্রাবন্ধিক-অনুবাদক আরশাদ আজিজের প্রয়াণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। শামসুর রাহমানকে ঘিরে স্মৃতিচারণা ও আলোচনায় অংশ নেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, কালি ও কলম সম্পাদক আবুল হাসনাত, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী, কবি মুহাম্মদ নূরুল হুদা, জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি কবি মুহাম্মদ সামাদ। এসেছিলেন শামসুর রাহমানের পুত্র ফাইয়াজ রাহমান, পুত্রবধূ টিয়া রাহমান, পৌত্রী নয়না রাহমান, অধ্যাপক মনিরুজ্জামান, কথাসাহিত্যিক মোহিত কামাল, লেখক-সাংবাদিক নাসিমুন আরা হক, গবেষক ইসরাইল খান প্রমুখ।

কবি শামসুর রাহমান। ছবি: সংগৃহীত
কবি শামসুর রাহমান। ছবি: সংগৃহীত

কবিকে নিবেদিত কবিতা পাঠে অংশ নেন রবিউল হুসাইন, আনোয়ারা সৈয়দ হক, কাজী রোজী, লিলি হক, শিহাব সরকার, ফারুক মাহমুদ, হাসান হাফিজ, রেজাউদ্দিন স্টালিন, নাহার ফরিদ খান, পিয়াস মজিদ, হানিফ খান। কবির কবিতা আবৃত্তি করেন রফিকুল ইসলাম, লায়লা তারান্নুম চৌধুরী, ফয়জুল আলম এবং শাহাদাৎ হোসেন। শামসুর রাহমানের কবিতা থেকে সংগীত পরিবেশন করেন রফিকুল আলম এবং আবিদা রহমান। কবির কবিতা অবলম্বনে নৃত্য পরিবেশন করেন সাহিদা রহমান।

বক্তারা বলেন, ‘শামসুর রাহমানের কবিতা ধারণ করেছে আমাদের সমাজসত্তার সামগ্রিক বিবর্তন। তিনি আমাদের চেতনার কাব্যিক রূপকার। ভাষা আন্দোলন পূর্ববাংলার কবিতাকে যেভাবে বদলে দিয়েছে, শামসুর রাহমানের কবিতাকেও সেই প্রেক্ষাপটে বিচার করতে হবে। নিভৃত কাব্যলোক থেকে তিনি সমকালের রক্ততে আলোড়িত হয়েছেন, জাতীয় জীবনের মূল কেন্দ্রস্বরকে তাঁর জীবনচেতনায় ভাস্বর করে তুলেছেন। নির্জনতা ও নিঃসঙ্গতা থেকে শামসুর রাহমান যেভাবে জনতার স্বাধীনতাকামী ময়দানে কবিতাকে নিয়ে এসেছেন, তা বাংলা কবিতার জন্য এক অনন্য অভিজ্ঞতা।’

বক্তারা আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের সমাজমানসের বিবর্তনের সঙ্গে শামসুর রাহমানের কবিতাকে মিলিয়ে পাঠ করলে আমরা দেখব তিনি এই অঞ্চলের সব সংগ্রামী, সদর্থক ও শুভবাদী আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে যোগাযোগ অনুভব করেছেন। শিল্পমান অক্ষুণ্ন রেখেও কবিতাকে যে মানুষের কাছাকাছি নিয়ে আসা যায়, সে সত্য তাঁর কাব্যিক করতলে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। উদ্ভট উটের পিঠে স্বদেশকে চলতে দেখেও তিনিই সেই কবি—যিনি বলতে পারেন “বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে”।’

বাংলা একাডেমিতে কবি শামসুর রাহমানের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে বক্তারা। ছবি: প্রথম আলো
বাংলা একাডেমিতে কবি শামসুর রাহমানের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে বক্তারা। ছবি: প্রথম আলো

সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, শামসুর রাহমান স্বৈরাচার-মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা এবং সব অশুভের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে, অসাধারণ শিল্পনৈপুণ্যে কবিতা রচনা করে গেছেন। যত দিন বাংলা ভাষা ও সাহিত্য থাকবে, তত দিন শামসুর রাহমানের কবিতা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সঙ্গে পঠিত হবে।

অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন জাতীয় কবিতা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কবি তারিক সুজাত এবং বাংলা একাডেমির উপপরিচালক কবি আমিনুর রহমান সুলতান ও শাহাদাৎ হোসেন।

কবি শামসুর রাহমানের জন্ম ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর পুরান ঢাকার মাহুতটুলীতে। ঢাকা নগরেই তাঁর বেড়ে ওঠা। তাই নাগরিক দুঃখ-সুখ তাঁর কবিতায় বিশেষভাবে উঠে এসেছে। জীবনের সত্য-সুন্দরকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অনন্য। পাশাপাশি বাঙালির সব আন্দোলন-সংগ্রামের গৌরবদীপ্ত অধ্যায় ফিরে ফিরে এসেছে তাঁর কবিতায়। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬০ সালে। প্রকাশিত গ্রন্থ শতাধিক। দৈনিক বাংলার সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন অনেক দিন। কবি বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৯), একুশে পদক (১৯৭৭), স্বাধীনতা পদকসহ (১৯৯১) দেশ-বিদেশের অসংখ্য পুরস্কার অর্জন করেন। বাংলাদেশের মানুষের জন্য তিনি লিখেছেন আমৃত্যু।

২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট কবি শামসুর রাহমান চিকিৎসাধীন অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্তেকাল করেন।