নিশো যেভাবে নিশো

>মডেলিং দিয়ে শুরু। এরপর নাম লেখান অভিনয়ে। বিনোদনের এই জগতে নিশোর পথচলার বয়স ২০ হতে চলেছে। আমরা এই দুই দশকপূর্তির জের ধরেই অভিনেতা আফরান নিশোর সঙ্গে আলাপ করতে বসি। নিশো নিজের চেয়ে বেশি নিজের পরিবার, গুরু আর বন্ধুদের নিয়ে কথা বলেন। আমাদের জানান কার কাছ থেকে কোন শিক্ষাটা নিয়েছেন তিনি। আফরান নিশো নয়, আমরা যেন এ আলাপে সুনির্মল বসুর ‘সবার আমি ছাত্র’ কবিতার নতুন সংস্করণের সঙ্গে পরিচিত হই। 
আফরান নিশো। ছবি: সুমন ইউসুফ
আফরান নিশো। ছবি: সুমন ইউসুফ

‘আকাশ আমায় শিক্ষা দিল উদার হতে ভাই রে, কর্মী হবার মন্ত্র আমি বায়ুর কাছে পাই রে’—আফরান নিশোর সঙ্গে আলাপ করে ফেরার পথে এই কবিতার লাইনগুলো মনে পড়ছিল ঘুরেফিরে। কারণ, নিশোর সঙ্গে তাঁর অভিনয়জীবনের দুই দশকের যাত্রা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে নিশোকে খুবই কম পেয়েছি। তাঁর কথায় আমরা পেয়েছি এমন কিছু চরিত্র, যারা নিশোর মন আর মগজে বাসা বেঁধে আছে। যাদের প্রভাব নিশোকে আজ এতটা পথ নিয়ে এসেছে। বিভিন্নজনের কাছ থেকে নিশোর পাওয়া পাঁচটি শিক্ষা আজ এই লেখায় থাকছে। বাকিগুলো নাহয় আগামী দশকগুলোর জন্য তুলে রাখি।

লোকে বলত
‘মডেলরা অভিনয় করতে জানে না’

শুরুটা শিক্ষা নয়, জেদ দিয়ে করি। এ কথার জন্যই নাকি আফরান নিশো অভিনয় নিয়ে উঠেপড়ে লাগেন। ১৯৯৯ বা ২০০০ সালের দিকে আফরান নিশো মডেল হিসেবে কাজ শুরু করেন। তখন বন্ধুদের সঙ্গে মজার ছলেই মডেলিংয়ে জুড়ে যান। অত আগপিছ ভাবেননি সে সময়। একটা–দুটো কাজ করতে করতে মডেলিং থেকে জুড়ে যান বিজ্ঞাপনচিত্রের সঙ্গে। এই ক্ষেত্রে তাঁর শুরুটা হয় অমিতাভ রেজার সঙ্গে, এরপর আফজাল হোসেন। ২০০৫ সালে নিশো প্রথম অভিনয় করেন বাংলাভিশনের একটি ধারাবাহিকে, নাম ঘরছাড়া। পরিচালক ছিলেন গাজী রাকায়েত। নিশো নিজেই আমাদের বললেন, ‘শুরুতে আমি অত বেশি সিরিয়াস ছিলাম না। বিরতি দিয়ে দিয়ে কাজ করতাম। অনেক পরে গিয়ে অভিনেতা হিসেবে সিরিয়াস হই।’ কী এমন ঘটল, যা ‘এলোমেলো’ নিশোকে সিরিয়াস অভিনেতা হিসেবে গড়ে তুলল! জবাবে নিশো জানালেন, আশপাশের লোকের একটা কথা তাঁকে বদলে দিয়েছে। মানুষ নাকি বলত, মডেলরা ভালো অভিনেতা হতে পারে না। ব্যস, এ কথাই জেদ হয়ে চাপল নিশোর মাথায়। অভিনেতা তিনি হয়েই দেখাবেন। যেই কথা সেই কাজ। নিশো এখন কতটা ‘অভিনেতা’ হয়ে উঠেছেন, তা তো তাঁর নাটক আর ইউটিউবে থাকা নাটকগুলোর নিচে মন্তব্য দেখলেই বোঝা যায়। 

হুমায়ুন ফরীদি বলতেন
‘কাজ একটাই করো, মন দিয়ে করো’

নিশো নিজেকে নিয়ে যতটা কথা বলেছেন, তার থেকে তিন গুণ বেশি বলেছেন নিজের অভিনয়ের আদর্শ হুমায়ুন ফরীদিকে নিয়ে। ফরীদি তাঁর আদর্শ, অনুপ্রেরণা, গুরু, শিক্ষক—সব। প্রয়াত এই অভিনেতার প্রতি নিশোর ভালোবাসার মাত্রাটা বলি একটা ঘটনা দিয়ে। লোটাকম্বল নামে একটি নাটকের পাণ্ডুলিপি এসেছে নিশোর হাতে। সেই পাণ্ডুলিপিতে নিশোর চরিত্রের ভাষাটা অন্য রকম। এমন কোনো চরিত্রে আগে তাঁর কাজ করা হয়নি। হাতে সময় খুব কম, এর মধ্যেই এই চরিত্রের জন্য তৈরি হতে হবে নিশোকে। কীভাবে নিজেকে তৈরি করবেন, কোন দিক থেকে শুরু করবেন, কোথা থেকে রেফারেন্স নেবেন—কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। অনেক রাত অবধি চিন্তাভাবনা করে নিশো ঘুমাতে গেলেন। স্বপ্নে এলেন গুরু হুমায়ুন ফরীদি। বেশি কিছু না, ফরীদি স্বপ্নে নাকি নিশোকে শুধু বলেছিলেন, ‘তুই পারবি। চেষ্টা কর।’ ব্যস, পরদিন গেলেন সেটে। গিয়ে দেখলেন, আগের রাত পর্যন্ত যে বিষয়টা অসম্ভব ঠেকছিল, সেটাই হয়ে গেছে ভীষণ সহজ। এভাবেই হুমায়ুন ফরীদি না থেকেও প্রভাবিত করে যাচ্ছেন আফরান নিশোকে। 

তো হলো কি, ক্যারিয়ারের যে সময়টায় নিশো ভীষণ অস্থির; অভিনয় নিয়ে এই সিরিয়াস, এই উড়নচণ্ডী; ভাবছেন শখের বশে অভিনয় করে যাবেন, পাশাপাশি পেশা হিসেবে একটা কাঠামোবদ্ধ চাকরি বা ব্যবসা করবেন—সে সময় গুরু হুমায়ুন ফরীদি শুনিয়েছিলেন এক ‘অমৃত বচন’। যেটা এখনো চিরন্তন হিসেবে নিজের সঙ্গে রেখে দিয়েছেন নিশো—‘কাজ একটাই করো, মন দিয়ে করো’। আফরান নিশো এর পরদিন থেকেই সেই পথে হাঁটা শুরু করলেন। ঠিক করলেন নিজের অনুপ্রেরণার মতোই নিশো হবেন একজন চরিত্রাভিনেতা। থাকবেন অভিনয়ের সঙ্গেই, মন দিয়ে এটাই করে যাবেন। এখনো তিনি তা–ই করছেন। 

ফরীদি আরও বলেছিলেন
‘অভিনয়ের সঙ্গে আপস কোরো না’

‘অল্প সময়ের জন্য ফরীদি ভাইয়ের সঙ্গে কাজের সুযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু তাঁকে নিয়ে বলে যেতে পারব ঘণ্টার পর ঘণ্টা’—কথাটা যে মিথ্যা নয়, তা বুঝতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না। হুমায়ুন ফরীদিকে নিয়ে নিশোর গল্পের ঝাঁপি ফুরাবার নয়। তাই আরেকটা গল্প বলে ফেলি। একদিন ফরীদির সামনেই একটা শট দিচ্ছিলেন নিশো। চিত্রগ্রাহক ফ্রেম ঠিক করার জন্য বারবার নাকি নিশোকে ডানে চাপতে বলছিলেন। নিশোও বাধ্য শিল্পীর মতো চেপে যাচ্ছিলেন। একসময় চাপতে চাপতে বসার জায়গার একেবারে শেষ প্রান্তে চলে যান তিনি। কোনোরকমে সেখানে বসে শটটা দিতে শুরু করেন। তখন হুমায়ুন ফরীদি গিয়ে দৃশ্যায়ন থামান। নিশোকে বলেন, ‘যেভাবে বসলে তোর স্বাচ্ছন্দ্য, সেভাবে বস।’ নিশোও সেভাবে বসেন। আর দৃশ্য ধারণ হয়। তখন নাকি ফরীদি নিশোকে বলেছিলেন, ‘অভিনয়টাকে প্রাধান্য দিতে হবে। অভিনয়ের সঙ্গে কখনো আপস করা যাবে না। শিল্পী যদি অভিনয়ের চেয়ে ডানে চেপে বসার দিকে খেয়াল দেয়, তাহলে তো অভিনয়টা হবে না।’ ফরীদি বললেন, ব্যস, মনে গেঁথে নিলেন নিশো।

মা বলেছেন
‘সেরা হও’

নিশো আমাদের তাঁর পরিবারের কথাও বললেন। জানালেন, অভিনয়ে তিনি এসেছেন হুট করেই। পারিবারিক কোনো যোগসাজশ ছিল না, ছিল না কোনো থিয়েটারের সঙ্গে সম্পর্কও। শৈশব, স্কুল বা কলেজজীবনে কখনো কোনো সংস্কৃতিচর্চার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। একেবারে সাদামাটা একটা পরিবার তাঁর। যে পরিবারে মা–বাবা নিজ সন্তানদের চিকিৎসক বা প্রকৌশলী হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন। সেই পরিবারের ছেলেই আজ প্রায় ২০ বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছেন বিনোদনের জগতে, হয়ে উঠেছেন অনেকের প্রিয় শিল্পী। এই প্রিয় শিল্পী হয়ে ওঠার পেছনে পরিবারের অনুপ্রেরণা বা শুরুর দিকে মত না থাকলেও, পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া একটা শিক্ষা খুব কাজে লেগেছে। সেই শিক্ষাটা নিশো পেয়েছেন তাঁর মায়ের কাছ থেকে। নিশোর মা নাকি তাঁকে ছোটবেলা থেকেই শিখিয়েছেন ‘যা–ই হতে চাও, সেরা হও।’ নিশো আমাদের সেই শিক্ষার কথা বুঝিয়ে বললেন, ‘মা বলতেন, তুমি যদি মুচিও হও, তাহলে সেরা মুচি হও। যেন ওই কাজের কথা উঠলে সবার আগে তোমার নামটা ভাবে। ডাক্তার হলেও দেশের সেরা পাঁচ ডাক্তারের একজন হও। ছোটবেলা থেকে এই বিষয়টা মাথায় গেঁথে গিয়েছিল।’

নিশো বলেন
‘নিজের পরিচয় নিজে গড়ো’

অভিনয়ের জগতে নিশো নিজের অবস্থান নিজে গড়েছেন। আশপাশের নানাজনের কাছ থেকে নিয়েছেন নানান শিক্ষা। সেটাকেই নিজের ভেতর ধারণ করে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। দুই দশক পেরিয়ে এসে এখন নিজের সন্তানকে এটাই শেখাতে চান এই অভিনেতা। নিশো আমাদের বললেন তাঁর ছেলে নির্ভানের কথা। পাঁচ বছরের নির্ভানের কাছে তার বাবা আর সব বাবার মতোই সাধারণ। রাস্তায় অনেকে সেলফি তুলতে আসে, তবে নির্ভান তারকা বাবার খ্যাতি এখনো আঁচ করতে শেখেনি। নিশোও চান না তাঁর ব্যক্তিজীবনে খ্যাতির আলো পড়ুক। তাই ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে অনেক কথা বললেও, নিজের ব্যক্তিজীবন আর কর্মজীবনকে আলাদা রাখতে চান। বাবা হিসেবে নিশো চান, তাঁর ছেলেও বড় হয়ে এমন কিছু করুক, যেন সবাই চেনে। কিন্তু বাবার পরিচয়ে নির্ভানকে পরিচিত করতে চান না তিনি। তাই সময় হলে ছেলেকে নিশো যে শিক্ষাটা দিতে চান, সেটা হলো ‘নিজের পরিচয় নিজো গড়ো।’