কত কাল কিংবা এই তো গতকালের কথা

শাহরুখ খান ও গৌরী খান। ছবি: রয়টার্স
শাহরুখ খান ও গৌরী খান। ছবি: রয়টার্স

শাহরুখ খান আজ এক কিংবদন্তির নাম। তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তার কারণে তিনি আজ ‘বলিউড বাদশাহ’ বা ‘কিং খান’। বলা হয়ে থাকে, বিশ্বের প্রতি পাঁচজনের একজন শাহরুখভক্ত। তাই তো সম্প্রতি শাহরুখ খানকে পরিচয় করিয়ে দিতে প্রখ্যাত মার্কিন টিভি সঞ্চালক, কমেডিয়ান, লেখক এবং প্রযোজক ডেভিড লেটারম্যান বলেন, ‘আমার এবারের অতিথির কোনো ভূমিকার প্রয়োজন নেই। তিনি এই বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেতা।’

আজ তাঁর আর স্ত্রী গৌরী খানের ২৮তম বিবাহবার্ষিকী। শাহরুখ যখন কেবলই একজন সাধারণ শাহরুখ, সেই সময় থেকে আজকের বলিউডের অন্যতম প্রভাবশালী নায়ক হওয়া পর্যন্ত তাঁর হাত শক্ত করে ধরে ছিলেন যে গৌরী খান।

গৌরী খান ও শাহরুখ খান। ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া
গৌরী খান ও শাহরুখ খান। ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া

কিছুদিন আগেই ২৮তম বিবাহবার্ষিকীকে সামনে রেখে একান্তে সময় কাটানোর জন্য আলিবাগের বাংলোয় গেছেন এই দম্পত্তি। বাংলোয় যাওয়ার পথে বিলাসবহুল এক বোটে সঙ্গে ছিল ছোট ছেলে আব্রামও। শাহরুখের আলিবাগের এই বাংলোর দাম প্রায় ২০০ কোটি টাকা। সেখানে আছে শাহরুখের ব্যক্তিগত জেটি, হেলিপ্যাড আর বিশাল সুইমিংপুল।

শাহরুখ খান অভিনীত ‘করণ-অর্জুন’, ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে’, ‘কাভি খুশি কাভি গম’, ‘দিল তো পাগল হ্যায়’, ‘দিল সে’, ‘দেবদাস’, ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’, ‘ফির ভি দিল হ্যায় হিন্দুস্তানি’, ‘স্বদেশ’, ‘বাজিগর’, ‘ম্যায় হু না’, ‘বীর জারা’, ‘চাক দে ইন্ডিয়া’, ‘মাই নেম ইজ খান’ ছবিগুলো বলিউডের সর্বকালের সেরা ছবির তালিকায় স্থান পাবে। তিনি ৩০ বার ফিল্মফেয়ার পুরস্কারে মনোনয়ন পেয়েছেন আর জিতেছেন ১৪টি।

বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে গৌরী খানের সঙ্গে নিজের একটি ছবি ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করেছেন শাহরুখ খান
বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে গৌরী খানের সঙ্গে নিজের একটি ছবি ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করেছেন শাহরুখ খান

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার না পেলে কী হবে, ২০০৫ সালে ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে ভূষিত করেছেন। আর ২০১৪ সালে ফ্রান্স সরকার তাঁকে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘নাইট অব দ্য লিজিওন অব অনার’ দেন। সম্প্রতি প্রথম ও একমাত্র ভারতীয় অভিনেতা হিসেবে পেয়েছেন ‘দুবাই স্টার’ সম্মাননা।

শাহরুখ খান আর গৌরী খানের প্রথম দেখা ১৯৮৪ সালে। দিল্লির পঞ্চশিলা ক্লাবে। তখন শাহরুখের বয়স ছিল ১৯ আর গৌরীর ১৪ বছর। শাহরুখ খান এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, ‘লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট’ বাগধারাটি সত্যি। সেই প্রথম দেখাতেই গৌরীর প্রেমে পড়েছিলেন শাহরুখ।

শাহরুখের ভেতর যে তখন থেকেই ‘রাহুল’, ‘রাজ’দের বাস, সেই প্রমাণও দেন। এক বন্ধুর মাধ্যমে গৌরীকে জানান, তিনি নাচতে চান গৌরীর সঙ্গে। শুনেই মুখের ওপর ‘না’ বলে দেন গৌরী। আর সাফ জানিয়ে দেন, তিনি নাকি তাঁর প্রেমিকের জন্য অপেক্ষা করছিলেন!

আসলে প্রেমিক নয়, ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছিলেন গৌরী। আর তাঁরও ভালো লেগেছিল শাহরুখকে। কিন্তু তাঁর পরিবার খুবই রক্ষণশীল, বাবা কট্টর ব্রাহ্মণ। তাই প্রেমটাকে প্রশ্রয় দিতে চাননি। কিন্তু শাহরুখের প্রেমে পড়া ছিল অবধারিত। তা আর ঠেকাতে পারলেন কই।

গৌরী খান ও শাহরুখ খান। ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া
গৌরী খান ও শাহরুখ খান। ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া

এরপর গৌরীর পারিবারিক অনুষ্ঠানে গৌরীর বাবা–মায়ের সঙ্গে খাতির জমান। নিজেকে পরিচয় দেন হিন্দু বলে। সেভাবেই পাঁচ বছর প্রেম করেন। কিন্তু গৌরীকে খুবই নিয়ন্ত্রণ করেছেন শাহরুখ। এমনকি চুল খোলা অবস্থায় গৌরীকে দেখলেও ভীষণ চটে যেতেন তিনি। এসব কারণে ছোটখাটো নানা বিষয় নিয়ে তাঁদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়।

তারপর একদিন কাউকে কিছু না জানিয়ে কয়েকজন বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মুম্বাই চলে যান গৌরী। বিরহে পাগল শাহরুখ তাঁর মাকে গৌরী সম্পর্কে সবকিছু খুলে বলেন। তখন শাহরুখের মা তাঁকে ১০ হাজার রুপি দিয়ে হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকাকে খুঁজে আনতে পাঠান মুম্বাই।

এত দূর পড়ার পর সিনেমার গল্প মনে হলেও এটাই শাহরুখের জীবনের সত্যি। সিনেমায় নামার আগেই তাঁর জীবনের গল্প হার মানায় সিনেমাকে। তাই সিনেমাকে জীবন বানাতে সময় লাগেনি শাহরুখের। সেখানেও জীবনযুদ্ধের মতোই পেয়েছেন আশ্চর্য সফলতার দেখা।

মুম্বাইয়ে গৌরীকে খুঁজে বেড়ান শাহরুখ। কিন্তু এ তো খড়ের গাদায় সুই খোঁজার চেয়েও কঠিন। কোথায় খুঁজে পাবেন গৌরীকে? তবে শাহরুখ খুব ভালো করেই জানতেন, সমুদ্রসৈকত দারুণ পছন্দ গৌরীর। এর জন্য তিনি বিভিন্ন সমুদ্রসৈকতে প্রেমিকাকে খুঁজতে শুরু করেন। একদিন আকসা সমুদ্রসৈকতে ঠিকই তিনি গৌরীর সন্ধান পেয়ে যান।

হারিয়ে যাওয়া প্রেমকে আবার ফিরে পাওয়ার সেই মুহূর্ত। সামনাসামনি হতেই কারও মুখে কোনো কথা নেই। দুজনেই কাঁদতে শুরু করেন। সেই মুহূর্তে গৌরী উপলব্ধি করেন, শাহরুখ তাঁকে কতটা ভালোবাসেন! কান্না থামিয়ে শাহরুখকে কথা দেন আর কখনোই শাহরুখকে ফেলে কোথাও পালাবেন না তিনি, কোনো দিন না, কোনো পরিস্থিতিতে না।

ছেলে আব্রামের সঙ্গে শাহরুখ খান ও গৌরী খান। ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া
ছেলে আব্রামের সঙ্গে শাহরুখ খান ও গৌরী খান। ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া

বাড়ি ফিরে সব সাহস সঞ্চয় করে সব সত্যি বলে দেন গৌরী, কিন্তু শাহরুখের মতো পাগলাটে, ভ্যাগাবন্ড আর মুসলিম ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে কিছুতেই রাজি হন না মা–বাবা। মা–বাবাকে না নিয়ে গৌরী বিয়ে করবেন না বলে গোঁ ধরেন। দুই বছর সময় নেন মা–বাবাকে রাজি করাতে। অবশেষে আসে সেই শুভদিন। আজ থেকে ঠিক ২৮ বছর আগের এই দিন।

১৯৯১ সালের ২৫ অক্টোবর গৌরীর বাবা–মায়ের শর্ত অনুযায়ী হিন্দু রীতি অনুযায়ী শাহরুখের সঙ্গে বিয়ে হয় গৌরীর। বিয়ের স্যুট কেনার টাকা ছিল না শাহরুখ খানের। তখন চলছিল ‘রাজু বন গ্যায়া জেন্টালম্যান’ ছবির শুটিং। সেই সেট থেকেই অনেক অনুরোধ করে কস্টিউমের একটা স্যুট ধার করে এনে পরেছিলেন শাহরুখ।

গৌরীকে কথা দিয়েছিলেন, হানিমুনে প্যারিস নিয়ে যাবেন। কিন্তু টাকা কই? হানিমুনে গেলেন দার্জিলিং। তা–ও ‘রাজু বন গ্যায়া জেন্টালম্যান’ ছবির শুটিংয়ের দলের সঙ্গে। শুটিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে স্ত্রীকে নিয়ে চা–বাগানে ঘুরেছেন। দুই একটা ছবি তুলেছেন। এই ছিল মধুচন্দ্রিমা। কিন্তু এসব নিয়ে কখনো আক্ষেপ করেননি গৌরী। মধুচন্দ্রিমায় যে প্যারিসে যেতে পারেননি, সেখানেই এখন নিজের প্রাসাদ আছে শাহরুখ খানের।

সমুদ্রকে সাক্ষী রেখে সেই দেওয়া কথা রেখেছিলেন তিনি। ২৮ বছর ধরে শাহরুখের সব খারাপ, ভালো, ব্যর্থতা আর সফলতার সঙ্গী গৌরী। তিন সন্তান নিয়ে বলিউডের সবচেয়ে সফল আর আদর্শ জুটির উদাহরণ তাঁরা। তাই তো শাহরুখ বলেছেন, ‘পৃথিবীতে গৌরীই আমাকে সবচেয়ে বেশি জানে আর বোঝে।’ আরও বলেছেন, আজ তিনি যা, তাঁর কৃতিত্ব সমানভাবে ভাগ করলেও গৌরীর সঙ্গে অবিচার হবে। বলেছেন, ‘আমার সফলতায় আমার চেয়েও গৌরীর অবদান বেশি।’ 

বিয়ের পর গৌরী খানকে সঙ্গে নিয়ে শাহরুখ খান প্রথম যান দার্জিলিংয়ে। ছবি: টুইটার থেকে নেওয়া
বিয়ের পর গৌরী খানকে সঙ্গে নিয়ে শাহরুখ খান প্রথম যান দার্জিলিংয়ে। ছবি: টুইটার থেকে নেওয়া

জীবনের এতটা সময় পার করে এসেও শাহরুখ বারবার ফিরে যান অতীতে। যে অতীত আজ তাঁকে বাদশাহ বানিয়েছে। হিন্দুস্তান টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমি মধ্যবিত্ত, খুব সাধারণ পরিবারের ছেলে। তাই আমার জন্য আজ এত দূর আসা কোনো রূপকথা গল্প থেকে কম নয়। আমার জীবন স্বপ্ন সত্যি হওয়ার গল্প। আর এই গল্পের সবচেয়ে বড় অনুঘটক মানুষের ভালোবাসা। আমি এখনো এসব বিশ্বাস করতে পারি না। আমি এখনো দিল্লির সেই ছেলেটা।’

এ সময় ৫৩ বছর বয়সী শাহরুখ তাঁর ছোটবেলার শহর দিল্লির কথা মনে করেন। তখন ভারতের প্রথম মাল্টিপ্লেক্স ‘পিভিআর অনুপম’ভেসে ওঠে শাহরুখের স্মৃতির পর্দায়। যে হলটি বর্তমানে বন্ধ হয়ে গেছে। ছোটবেলায় কী হতে চেয়েছিলেন? শাহরুখ জানান, তিনি স্বপ্ন দেখতেন, একদিন তিনি বড় ব্যবসায়ী হবেন। তাঁর ফাইভ স্টার হোটেল থাকবে। আর সেখানে থাকবে মাল্টিপ্লেক্স। কিন্তু জীবন শাহরুখ খানকে সেই স্বপ্নের চেয়েও অনেক বেশি কিছু দিয়েছে। শাহরুখ কোনো দিন ভাবেননি, তিনি অভিনেতা হবেন।

মেয়ে সুহানা খানের সঙ্গে শাহরুখ খান ও গৌরী খান। ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া
মেয়ে সুহানা খানের সঙ্গে শাহরুখ খান ও গৌরী খান। ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া

শাহরুখ খানের দেখা নিজের অভিনীত প্রথম ছবি ‘রাজু বন গ্যায়া জেন্টালম্যান’। প্রথমবার বড় পর্দায় নিজেকে দেখে নাকি শাহরুখের অস্বস্তি হয়েছিল। শাহরুখ বলেন, ‘মুম্বাইয়ের আরকে স্টুডিওতে দেখলাম। নিজেকে কেমন বেখাপ্পা লাগছিল। বড় বড় চুল, কী বিশ্রী। আর নানা পাটেকার, অমৃতা সিং, জুহি চাওলাদের সঙ্গে কী যে খারাপ অভিনয় করেছিলাম!’

শাহরুখ খানের সর্বশেষ ইনস্টাগ্রাম পোস্টটি চোখে পড়েছে? সেখানে গৌরী খানের সঙ্গে নিজের একটি ছবি পোস্ট করেছেন শাহরুখ। ক্যাপশনে লিখেছেন, ‘মাঝেমধ্যে মনে হয়, কত কাল ধরে আমরা পথ চলছি...আবার হঠাৎ করে মনে হয়, এই তো গতকাল। বিয়েটা গতকালের কথা। তিন সন্তান নিয়ে প্রায় তিন দশক পথ চলছি। সব রূপকথা ছাড়িয়ে আমার জীবনের রূপকথা সবার ওপরে। কারণ, এই রূপকথা আমার জীবনের পরম সত্যি। কল্পনায় যতটা সুন্দর হওয়া সম্ভব, আমার জীবন ঠিক ততটাই সুন্দর।’