নিরাপত্তার কড়াকড়ি, তবু এফডিসিতে ভিড় উপচে পড়েছে

ভোটের উৎসবে শিল্পীদের সেলফি। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
ভোটের উৎসবে শিল্পীদের সেলফি। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

নানা প্রজন্মের অভিনয়শিল্পীদের সরব উপস্থিতিতে উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হলো বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির দ্বিবার্ষিক (২০১৯-২১) নির্বাচন। শুক্রবার সকাল নয়টা থেকে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনে (বিএফডিসি) শিল্পী সমিতির আর্টিস্ট স্টাডি কক্ষে ভোট গ্রহণ শুরু হয়। মাঝখানে এক ঘণ্টা বিরতি দিয়ে শান্তিপূর্ণভবে বিকেল পাঁচটায় ভোট গ্রহণ শেষ হয়। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত শিল্পী সমিতির কার্যালয়ে ভোট গণনা চলছে।

এবারের নির্বাচনে ৪৪৯ জন ভোটারের মধ্যে ভোট পড়ে ৩৮৬টি। তথ্যটি নিশ্চিত করেন এ নির্বাচনের আপিল বোর্ডের প্রধান শামছুল আলম। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ইলিয়াস কাঞ্চন শান্তিপূর্ণভাবে সবাইকে ভোটে অংশ নেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানান। এ সময় তিনি বলেন, ‘সবার প্রতি ভালোবাসা। সবার অংশগ্রহণে সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন করতে পেরেছি আমরা।’

এফডিসির ভেতরে ও বাইরের মূল ফটকে শত শত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে আজ শুক্রবার সকাল নয়টায় যথারীতি ভোট গ্রহণ শুরু হয়। ভোটকেন্দ্রে শান্তিপূর্ণভাবে ভোট গ্রহণ চললেও ভোট শুরুর ঘণ্টাখানেক পরেই এফডিসির মূল ফটকে চলচ্চিত্রের লোকজনের সঙ্গে গোলযোগ শুরু হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের। অভিনয়শিল্পী, প্রযোজক, পরিচালক, সহকারী পরিচালকসহ এফডিসির বিভিন্ন ইউনিট সদস্যদের নিজ নিজ সমিতির পরিচয়পত্র ছাড়া ভেতরে ঢুকতে বাধা দেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সসদ্যরা।

এফডিসির গেটে সারা দিনই ভিড় লেগেছিল। ছবি: মাসুম আলী
এফডিসির গেটে সারা দিনই ভিড় লেগেছিল। ছবি: মাসুম আলী

সকাল ১০টার পর মূল ফটকে চিত্রনায়ক সোহেল রানাকে আটকে দেওয়া হয় সঙ্গে শিল্পী সমিতির কার্ড না থাকার অভিযোগে। খবরটি এফডিসির ভেতরে ছড়িয়ে পড়লে শিল্পী সমিতির নেতারা দৌড়ে মূল ফটকে গিয়ে তাঁকে ভেতরে নিয়ে আসেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটি চলচ্চিত্রশিল্পী সমিতির নির্বাচন হচ্ছে না, পুলিশের নির্বাচন হচ্ছে। আমার জীবনে এত বাজে নির্বাচন আগে দেখেনি।’ পরপরই এফডিসির ভেতর খবর আসে, মূল ফটকে পরিচালক দেলোয়ার জাহান ঝন্টু, অপূর্ব রানাসহ কয়েকজন পরিচালককে নিরাপত্তাকর্মীরা আটকে দিয়েছেন। এ খবর শুনে পরিচালক সমিতির দুই নেতা বদিউল আলম খোকন, শাহিন সুমনসহ একদল পরিচালক নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়ে ক্ষোভ ঝাড়তে ঝাড়তে দ্রুতই মূল ফটকের দিকে রওনা হন। শাহিন সুমন বলেন, ‘এফডিসি কি শিল্পী সমিতির নেতৃত্বে চলবে? তাঁরা যা খুশি তাই করবেন, তা মেনে নেওয়া হবে না। বিষয়টি নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনকে কৈফিয়ত দিতে হবে।’

অরুণা বিশ্বাসের সেলফিতে শবনম, নাইম ও অমিত হাসান। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
অরুণা বিশ্বাসের সেলফিতে শবনম, নাইম ও অমিত হাসান। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
ভোট দিতে এসেছেন চিত্রনায়িকা চম্পা। ছবি: প্রথম আলো
ভোট দিতে এসেছেন চিত্রনায়িকা চম্পা। ছবি: প্রথম আলো

মূল ফটকে একই ঘটনা ঘটে জনপ্রিয় নায়ক শাকিব খানের সঙ্গে। বিকেল চারটার দিকে জনপ্রিয় নায়ক শাকিব খানও মূল ফটকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মুখোমুখি হন। তাঁকে ছাড় দিলেও তাঁর একজন সহকারী, একজন নিরাপত্তাকর্মীকে ভেতরে ঢোকার ব্যাপারে প্রশ্ন তোলে পুলিশ। তবে শেষে শাকিব খানের সঙ্গে থাকা সবাই-ই ভেতরে ঢোকার অনুমতি পান। ভোট প্রদান করার পর প্রযোজক সমিতিতে বসে এফডিসির নিরাপত্তার বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন শাকিব খান। প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘এফডিসিজুড়ে এত পুলিশ কেন? এফডিসিতে যখন আমি ঢুকছি, আমার সঙ্গে কে, এটা পুলিশকে কৈফিয়ত দিতে হবে কেন। আমার সঙ্গে যেই-ই থাকুক, নিশ্চয়ই তিনি গুরুত্বপূর্ণ কেউ! বিগত নির্বাচনগুলোতে এমনটি দেখেনি। দেখেছি উৎসবের আমেজ।’

দিনভর ছিল মেঘলা আকাশ। থেমে থেমে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। অপু বিশ্বাস, বুবলীসহ বেশ কয়েকজন তারকা সকাল সকাল ভোট দিয়ে ফিরে যান। তবে দুপুরের পর থেকেই তারকাদের ঢল নামে এফডিসিতে। সেই সঙ্গে পুরো এফডিসি লোকারণ্য হয়ে যায়। সেই ঢেউ এফডিসির মূল ফটক ছাড়িয়ে সামনের মূল রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে।

ভোট দিচ্ছেন চিত্রনায়ক ও সাংসদ ফারুক। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
ভোট দিচ্ছেন চিত্রনায়ক ও সাংসদ ফারুক। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

মান্না ডিজিটাল কমপ্লেক্সের পাশ দিয়ে শিল্পী সমিতির রাস্তায় জমে ওঠে তারকাদের আড্ডা, সঙ্গে ভোট প্রার্থনা। তারকা প্রার্থী ও তারকা ভোটারদের উপস্থিতিতে রঙিন হয়ে ওঠে ওই রাস্তা। সেই আড্ডায় ডিপজল, রুবেল, মিশা সওদাগর, মৌসুমি, ফেরদৌস, রিয়াজ, পপি, অমিত হাসান, আমিন খান, ওমর সানী, জায়েদ খান, অরুণা বিশ্বাস, ববি, পরীমনি, ইমন, সাইমন, বাপ্পীসহ অনেক তারকাকে দেখা গেছে। তবে আড্ডার মধ্যে তারকাদের কাছে অনেকটাই বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সেলফি তোলা ও অনেক ইউটিউব চ্যানেলের ক্যামেরা।

সন্তান ও স্বামীকে নিয়ে ভোটকেন্দ্রের সামনে মৌসুমি। ছবি: শফিক আল মামুন
সন্তান ও স্বামীকে নিয়ে ভোটকেন্দ্রের সামনে মৌসুমি। ছবি: শফিক আল মামুন

অনেক তারকা অভিযোগ করেছেন, মূল ফটকের ভেতরে–বাইরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শত শত কর্মী, এত এত নিরাপত্তা—এরপরও ভেতরে এত এত মানুষ কোথা থেকে এল। রিয়াজ বলেন, ‘শিল্পীরা শান্তিমতো ভোট দিতে যাবেন, রাস্তায় তো হাঁটারই জায়গা নেই। ধাক্কা মেরে যেন আমাদের ফেলে দিচ্ছে। কে কোথা থেকে সেলফি তুলছেন, চিনি না জানি না, ক্যামেরা হাতে সামনে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন সাক্ষাৎকার নিতে। শোনা যাচ্ছে, এরা সবাই ইউটিউবের জন্য। কিন্তু এরা তো সাংবাদিক না, কীভাবে ঢুকল ভেতরে।’

ভোট দিতে এসেছেন পরীমনি। ছবি: প্রথম আলো
ভোট দিতে এসেছেন পরীমনি। ছবি: প্রথম আলো

এ ব্যাপারে প্রধান নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকেরা আমাদের একটি তালিকা দিয়েছেন, সেই তালিকা অনুযায়ী শতাধিক পাস দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে কারা ঢুকছেন, সেটা আমার জানা নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ভালো বলতে পারবে।’
বিষয়টি নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার যেভাবে আমাদের নির্দেশনা দিয়েছেন, সেভাবেই কাজ করছি। পাস ছাড়া কাউকেই ঢুকতে দিচ্ছি না। মূল ফটকে কড়া পাহারা, বিনা পাসে কারও ঢোকার সুযোগ নেই।’

এদিকে ভোটার তালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও ভোট দিতে পারেননি চিত্রনায়িকা অমৃতা খান। ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার মিনিট দশেক আগে শিল্পী সমিতির সামনে দাঁড়িয়ে ক্ষোভের কথা জানালেন অমৃতা। তিনি বলেন, ‘তালিকায় আমার ভোটার নম্বর সাত। কিন্তু আমার ভোটার কার্ডটি শিল্পী সমিতি থেকে আমাকে দেওয়া হয়নি। ফলে দুপুরে ভোট দিতে এসে একবার ফিরে গেছি। পরে বিকেলে আমাকে নির্বাচন কমিশনার ডেকেছিলেন। তাঁর কাছে গেলে তিনি কার্ড না থাকার কারণে ভোট দিতে অনুমতি দেননি।’ পাশে দাঁড়িয়েছিলেন চিত্রনায়ক শিপন। তিনি বলেন, ‘শুনেছি, ভোটের আগেই কেউ একজন অমৃতার নামে কার্ডটি তুলে নিয়ে গেছে শিল্পী সমিতি থেকে।’

সারাহ বেগম কবরীর কাছে ভোট চাইতে এগিয়ে গেলেন রুবেল। ছবি: প্রথম আলো
সারাহ বেগম কবরীর কাছে ভোট চাইতে এগিয়ে গেলেন রুবেল। ছবি: প্রথম আলো
অনন্ত জলিল ও বর্ষা। ছবি: শফিক আল মামুন
অনন্ত জলিল ও বর্ষা। ছবি: শফিক আল মামুন

দুই বছর পরপর বাংলাদেশ শিল্পী সমিতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এফডিসিভিত্তিক সব কটি সমিতির নির্বাচনের মধ্যে শিল্পী সমিতির নির্বাচন হয় সবচেয়ে উৎসবমুখর। জ্যেষ্ঠ অভিনয়শিল্পী থেকে শুরু করে নতুন প্রজন্মের সব শিল্পী ভোট দিতে এফডিসিতে হাজির হন। সবার উপস্থিতিতে একটি মিলনমেলায় পরিণত হয়। কিছু বিছিন্ন ঘটনা ছাড়া নবীন ও প্রবীণ শিল্পীদের উপস্থিতিতে এবার নির্বাচনও ছিল অনেকটাই উৎসবমুখর।

কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় বাংলাদেশ শিল্পী সমিতির ২০১৯-২১ মেয়াদি নির্বাচনে তিন পদে বিনা বাধায় নির্বাচিত হয়েছে তিনজন। তাঁরা হলেন সাংগঠনিক সম্পাদক পদে সুব্রত, দপ্তর ও প্রচার সম্পাদক পদে জ্যাকি আলমগীর ও কোষাধ্যক্ষ পদে ফরহাদ। বাকি নির্বাচনে ১৮ পদে লড়েছেন ২৭ জন শিল্পী।