জয়ী না হয়েও 'জয়ী' মৌসুমী

চলচ্চিত্রের শীর্ষ নায়ক শাকিব খান আসার পর সাড়া পড়ে যায় এফডিসি প্রাঙ্গণে। ছবি: প্রথম আলো।
চলচ্চিত্রের শীর্ষ নায়ক শাকিব খান আসার পর সাড়া পড়ে যায় এফডিসি প্রাঙ্গণে। ছবি: প্রথম আলো।

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির দুই বছরের মেয়াদ শেষ হয় গত ২৪ মে। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হওয়ার কথা। সে হিসেবে গত ২৪ আগস্টের মধ্যে নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। গঠনতন্ত্রের বাইরে গিয়ে প্রায় দুই মাস পর এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো গতকাল শুক্রবার। নানা কারণে আলোচিত ছিল চলচ্চিত্রের শিল্পীদের সংগঠনের এবারের নির্বাচন।

ভোট দিতে আসেন চিত্রনায়িকা পরীমনি। ছবি: প্রথম আলো
ভোট দিতে আসেন চিত্রনায়িকা পরীমনি। ছবি: প্রথম আলো

এবার নির্বাচনে বড় চমক ছিলেন চিত্রনায়িকা মৌসুমী। তিনিই প্রথম নারী, যিনি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনে সভাপতি পদে প্রার্থী হয়েছেন। শুরুতে বেশ ভালো প্রস্তুতি নিয়ে নেমেছিলেন মৌসুমী। কথা ছিল অভিনেতা ডি এ তায়েবের সঙ্গে প্যানেল করে নির্বাচনে লড়বেন। চমকের আশ্বাসও দিয়েছিলেন। কিন্তু মনোনয়ন দাখিলের সময় তিনি কাউকে পাশে পাননি। সেদিন মনোনয়ন পত্র দাখিল করে অনেকটা কাঁদতে কাঁদতেই এফডিসি ছাড়েন মৌসুমী।

প্যানেল করতে না পেরে প্রার্থী হিসেবে শুরু থেকেই ব্যক্তি মৌসুমী একা নির্বাচনের প্রচারণা চালিয়ে যান। সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্বামী চিত্রনায়ক ওমর সানী এবং কয়েকজন সহশিল্পী। তাঁরা কেউ প্রার্থী হননি। বাস্তবতা ছিল, মৌসুমী নিজের মতো করে স্বল্প পরিসরে প্রচার কার্যক্রম চালিয়েছেন, পাশাপাশি শুটিং করেছেন।

রাজধানী তেজগাঁও এলাকার বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের বা এফডিসি প্রাঙ্গণে নির্বাচনকে ঘিরে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে। তর্ক-বিতর্ক-হট্টগোল এমনকি ধাক্কাধাক্কির মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটে। থেমে যাননি মৌসুমী। স্বামী এবং কয়েকজন সহশিল্পী নিয়ে মাঠে থাকেন।

নির্বাচনে দারুণ সাড়া ছিল শিল্পীদের মাঝে। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া।
নির্বাচনে দারুণ সাড়া ছিল শিল্পীদের মাঝে। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া।

গতকাল বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির ১৫তম দ্বিবার্ষিক নির্বাচনের দিনও এফডিসি প্রাঙ্গণে মৌসুমীর স্বতঃস্ফূর্ত উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল। সকাল থেকে সারা দিন নির্বাচনের মাঠে ছিলেন। শেষ পর্যন্ত রাতে ভোট গ্রহণের সময়ও ছেলে আর স্বামীকে পাশে রেখে এফডিসিতে সরব ছিলেন। ফেরদৌস, অমিত হাসান,পপির মতো কয়েকজন তারকা শিল্পীর উপস্থিতি দেখা গেছে তাঁর পাশে। ভোট গণনার প্রায় পুরোটা সময় মৌসুমী সেখানে ছিলেন। এ সময় উদ্বিগ্ন মৌসুমী সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি এসব নিয়ে আর কথা বলব না। এমনিতে অনেক টেনশনে ছিলাম। এসব নিয়ে কথা বলতে গেলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।’

নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মৌসুমী বলেন, ‘আমি শিল্পীদের যে ভালোবাসা পেয়েছি, তার জন্য কৃতজ্ঞ। শিল্পীদের জন্য আমার দরজা সব সময় খোলা থাকবে।’

অরুণা বিশ্বাসের সেলফিতে শাবনাজ, নাঈম ও অমিত হাসান। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
অরুণা বিশ্বাসের সেলফিতে শাবনাজ, নাঈম ও অমিত হাসান। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

এবার নির্বাচনে মোট ভোটার ছিল ৪৪৯ জন। এর মধ্যে ৩৮৬ জন ভোট দিয়েছেন। প্রায় ৮৬ শতাংশ ভোট পড়েছে। এর মধ্যে বাতিল হয়েছে ৩৪টি ভোট। তার মানে মোট ৩৫২টি ভোটে ফলাফল নির্ধারিত হয়েছে।

সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দিতা করেছেন চিত্রনায়িকা মৌসুমী। ছবি: প্রথম আলো
সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দিতা করেছেন চিত্রনায়িকা মৌসুমী। ছবি: প্রথম আলো

এর মধ্যে ২২৭টি ভোট পেয়ে সভাপতি পদে নির্বাচিত হয়েছেন জনপ্রিয় খল অভিনেতা মিশা সওদাগর। তিনি চূড়ান্ত ভোটের প্রায় ৬৫ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। অন্যদিকে মৌসুমী পেয়েছেন প্রায় ৩৬ শতাংশ ভোট। এ ক্ষেত্রে বলা যায়, দারুণ লড়াই হয়েছে সভাপতি পদে। অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদক পদে একচেটিয়া ভোট পেয়েছেন জায়েদ খান। তিনি পেয়েছেন ২৮৪টি ভোট। প্রায় ৮২ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। তাঁর নিকটতম প্রার্থী ইলিয়াস কোবরা পেয়েছেন মাত্র ৬৮টি ভোট, মাত্র ১৯ শতাংশ।

এসেছিলেন চিত্রনায়িকা চম্পা। ছবি: প্রথম আলো
এসেছিলেন চিত্রনায়িকা চম্পা। ছবি: প্রথম আলো

এবার নির্বাচনে একটি প্যানেলই ছিল। বাকিগুলো ঘটনাচক্রে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নিতে বাধ্য হয়েছে। এর মধ্যে মিশা-জায়েদ প্যানেলের সবচেয়ে বড় চমক ছিলেন ডিপজল ও রুবেল। কয়েক বছর ধরে এফডিসিতে অনিয়মিত এই দুই শিল্পীকে নির্বাচনের উৎসবে বেশ সরব দেখা গেছে। মনোনয়নপত্র দাখিলের দিন থেকে প্রায় প্রতিদিন এফডিসি প্রাঙ্গণে দেখা গেছে তাঁদের। ইতিবাচক সাড়াও পেয়েছেন। বড় পদগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছেন মনোয়ার হোসেন ডিপজল। ৩১১ ভোট পেয়ে তিনি সহসভাপতি পদে নির্বাচিত হন। তিনি প্রায় ৮৯ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। একই পদে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন চিত্রনায়ক রুবেল। তিনি পেয়েছেন ২৯৩ ভোট।

কার্যনির্বাহী সদস্য হিসেবে মোট ১১ জন প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন। অঞ্জনা সুলতানা, রোজিনা, অরুণা বিশ্বাস, আলীরাজ, বাপ্পারাজ, আফজাল শরীফ, আসিফ ইকবাল, আলেকজান্ডার বো, জেসমিন, জয় চৌধুরী ও মারুফ আকিব। তাঁদের মধ্যে সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছেন আলেকজান্ডার বো, ৩৩৭টি।

চলচ্চিত্র তারকাদের মাঝে এই নির্বাচন বেশ ভালো সাড়া ফেলে। এ সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় তারকা শাকিব খান থেকে শুরু করে এক সময়ের সাড়া জাগানো তারকা সোহেল রানা, ফারুক, কবরী, আবুল হায়াত, শর্মিলী আহমেদ, আনোয়ারা হাজির হন ভোট দিতে।

ভোট দিয়েছেন সাংসদ ও চিত্রনায়ক ফারুক। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
ভোট দিয়েছেন সাংসদ ও চিত্রনায়ক ফারুক। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

তবে নিরাপত্তার কারণে আইনশৃঙ্খলার বাহিনীর সদস্যদের বিপুল উপস্থিতি এবং কড়াকড়ি শিল্পীসহ সংশ্লিষ্টদের ক্ষোভের কারণ হয়। সোহেল রানা, শাকিব খানসহ কয়েকজন তারকার সঙ্গে প্রবেশ পথে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মীদের তর্কাতর্কি হয়েছে। পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে সোহেল রানা বলেন, ‘এখানে চলচ্চিত্র শিল্পীদের কোনো নির্বাচন হচ্ছে? আগে এফডিসির সব নির্বাচন হয়েছে উৎসবমুখর পরিবেশে। কিন্তু এবার বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন দেখে মনে হচ্ছে এটা পুলিশের ক্যাম্প।’ একই প্রশ্ন করেন শাকিব খান। তিনি বলেন, ‘গেট দিয়ে যখন ঢুকছি, আমার সঙ্গে কে এটা, পুলিশকে কেন কৈফিয়ত দিতে হবে? আমার সঙ্গে যে-ই থাকুক না কেন, নিশ্চয়ই তিনি গুরুত্বপূর্ণ কেউ!’

স্ত্রী বর্ষাকে নিয়ে ভোট দিতে আসেন চিত্রনায়ক ও প্রযোজক অনন্ত জলিল। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
স্ত্রী বর্ষাকে নিয়ে ভোট দিতে আসেন চিত্রনায়ক ও প্রযোজক অনন্ত জলিল। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

প্রসঙ্গত, নির্বাচন হবে কিনা, সে ব্যাপারে নির্বাচনের আগের দিনও সংশয় তৈরি হয়। গত ১৫ অক্টোবর বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার ইলিয়াস কাঞ্চন বরাবর নির্বাচন কেন স্থগিত করা হবে না, এই মর্মে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানো হয়। অভিনেতা মো. সোহেল খান ও মোহাম্মদ হোসাইনের পক্ষে তাঁদের আইনজীবী এই নোটিশ পাঠান। নোটিশ গ্রহণ করেননি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ইলিয়াস কাঞ্চন এবং বাংলাদেশ শিল্পী সমিতির আগের কমিটির সভাপতি মিশা সওদাগর ও সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান।

নোটিশ গ্রহণ না করায় বৃহস্পতিবার উচ্চ আদালত থেকে এই তিন বিবাদীর নামে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য সমন জারি হয়। সমন নিয়ে উচ্চ আদালতের একজন পেশকার গত বৃহস্পতিবার দুপুর ৩টায় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির কার্যালয়ে আসেন। ওই সময় মিশা সওদাগর ও জায়েদ খান অনুপস্থিত ছিলেন। আর ইলিয়াস কাঞ্চনকে পেলেও সমনে তাঁর নামের আগে ‘মোহাম্মদ’ থাকায় সেটি গ্রহণ করেননি তিনি। পরে সাংবাদিকদের সামনে পেশকারকে ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘আমি একজন পরিচিত অভিনেতা। আমাকে রাষ্ট্র কয়েকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার দিয়েছে। একবার একুশে পদকও দিয়েছে। আমার নাম সেখানে ইলিয়াস কাঞ্চন। এই মোহাম্মাদ ইলিয়াস কাঞ্চনকে আমি চিনি না। তাই এটি আমার পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।’

অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ, কান্নাকাটি, প্রতিবাদ, ক্ষোভ নিয়ে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের মতে সুষ্ঠু এবং সফলভাবেই নির্বাচন হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এমনিতে আমাদের নির্বাচন কমিশনের লোকবলের সংকট ছিল। তবুও আমরা চেষ্টা করেছি। শেষ পর্যন্ত ভোটগ্রহণ এবং গণনার দৃশ্য ধারণ করে সরাসরি বাইরে প্রচার করার ব্যবস্থা করেছি। যেন কেউ স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে না পারে। আমি মনে করি আমার সৎ উদ্দেশ্য সফল হয়েছে।’

সহশিল্পী রুবেলের সেলফিতে মৌসুমী ও ওমর সানী। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
সহশিল্পী রুবেলের সেলফিতে মৌসুমী ও ওমর সানী। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

ইলিয়াস কাঞ্চন আরও বলেন, ‘জয় পরাজয় পরের বিষয়, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির ইতিহাসে এই প্রথম কোনো চিত্রনায়িকা সভাপতি পদে অংশ নেন, এটা অনেক বড় ব্যাপার।’

গত ৩ অক্টোবর মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে মন খারাপ করে মৌসুমী বলেন,‘একটি প্যানেল করতে দিলে কিছুই ক্ষতি হতো না। আমার সঙ্গে শিল্পীরা নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁরা সরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এ জন্য তাঁরা মনে কষ্ট পেয়েছেন। আর আমি আগে থেকেই যেহেতু ঘোষণা দিয়েছি, এ কারণে সরে যাচ্ছি না। তা ছাড়া অনেকেই আমার দেখাদেখি স্বতন্ত্র দাঁড়াচ্ছেন। তাঁদের কথা, শেষ পর্যন্ত যদি আমিও নির্বাচনে না থাকি, তাহলে চাওয়ার জায়গাটা সব শেষ হয়ে যাবে। তাই আমি নির্বাচন করছি। দেখি কী হয়!’

শেষ পর্যন্ত লড়াইয়ে ছিলেন। এককভাবে লড়ে গেছেন। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ছিলেন মাঠে। ৩৬ শতাংশ ভোটও পেয়েছেন। জয়ী হতে না পারলেও তাঁর লড়াকু মনোভাব অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্যতা রাখে। জয়ী না হয়েও ‘জয়ী’ মৌসুমী। অভিনন্দন মৌসুমী!