দীপ্তি নিজেও অবাক

দীপ্তি এবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন সিলন সুপার সিঙ্গারে। ছবি: সংগৃহীত
দীপ্তি এবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন সিলন সুপার সিঙ্গারে। ছবি: সংগৃহীত

বিভূতিভূষণ গুপ্ত মানুষটা গানপাগল। এ খোঁজ সবাই জানে। বাগেরহাটের রামপালের পাড়দীঘির পাশের মাঠে ফি বছর একটা অনুষ্ঠান হয়। আয়োজকদের তরফ থেকে মুরব্বি গোছের কেউ একজন খবর পাঠায়, ‘ও বিভূতি, এইবারও তো তোমার কিন্তু গান গাতি হবি।’

অন্য শিল্পীদের মতো বিভূতি বাবু হাজারটা বায়নাক্কা করেন না। গানের আমন্ত্রণ পেলে নিজের হারমোনিয়ামটা কোলে নিয়ে চলে যান। কিন্তু এবার শুধু হারমোনিয়ামটা নিলেন না; সঙ্গে নিলেন নিজের চার বছরের ভাগনি দীপ্তিকে। মেয়েটাকে কিছুদিন ধরে তিনিই গান শেখাচ্ছেন। এই চার বছরের মধ্যে কী বিস্ময় লুকিয়ে আছে, সেটা সবাইকে দেখিয়ে দিতে চান।

মঞ্চে মামা-ভাগনিকে ওঠানো হলো। এত বড় হারমোনিয়ামের আড়ালে মেয়েটাকে যে দেখাই যায় না। কেউ একজন একটা টুলও জোগাড় করে এনে দিল। তাতে দাঁড়িয়ে মেয়েটা গাইল—আয় তবে সহচরী, হাতে হাতে ধরি ধরি, নাচিবি ঘিরি ঘিরি, গাহিবি গান।

দীপ্তি সরকার। ছবি: সংগৃহীত
দীপ্তি সরকার। ছবি: সংগৃহীত

এই যে শুরু হলো গান, সেটাই আজ দীপ্তি সরকারের জীবন বদলে দিয়েছে। যে গানটা একসময় হারিয়েও যেতে বসেছিল। ফিনিক্স পাখির মতো নিজের শিল্পীসত্তার পুনর্জন্ম ঘটানো দীপ্তি এবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন সিলন সুপার সিঙ্গারে। জীবনে গান গেয়ে কোনো দিন এক টাকাও সম্মানী পাননি। চা-শিঙাড়া-বিস্কুটের খাতিরদারিই কেবল মিলেছে। সেই তিনিই প্রথম সম্মানী যখন পেলেন, অঙ্কটা ২০ লাখ টাকার!

এই বদলে যাওয়ার পেছনে আছে সিলন সুপার সিঙ্গার। একসময় নিয়মিত গান করতেন, কিন্তু সংসারের চাপে আর সব চাওয়ার সঙ্গে গানটাকেও বিসর্জন দিয়েছিলেন যে গৃহিণীরা; তাঁদের নতুন করে গানে ফিরিয়ে আনার মঞ্চ। বাংলাদেশে গৃহিণীদের নিয়ে আয়োজিত গানের প্রথম রিয়েলিটি শো।

স্বামী প্রতাপ সরকার আইনজীবী। রোজ খুলনার কোর্টে যাওয়া–আসার পথে শিববাড়ীর মোড়ে একটা বড় বিলবোর্ড চোখে পড়ে। কী একটা রিয়েলিটি শো হবে। প্রতাপ স্ত্রীকে নানাভাবে রাজি করানোর চেষ্টা করেন অডিশন দিতে। কিন্তু দীপ্তির মনে দ্বিধা। ছোটবেলায় অনেক প্রতিযোগিতাতেই নাম দিয়েছেন। কিন্তু কখনোই বিভাগ পর্যায় পেরিয়ে জাতীয় পর্যায়ে যাওয়া হয়নি। কী দরকার বাপু এসব করে লোক হাসানোর। তা ছাড়া যে মেয়েটা রেডিওতেই এখনো গান করেনি, সে কিনা বাংলাদেশের বড় একটা টিভি চ্যানেলের এত বড় আয়োজনের রিয়েলিটি অনুষ্ঠানে গাইবে! ভাবতেই তো ভয়ে গা শিউরে ওঠে।

স্বামীর পীড়াপিড়ি তো ছিলই; তা ছাড়া খুলনায় অডিশনের ভেন্যু ছিল বাড়ির একদম কাছেই। দীপ্তি ভাবলেন, আচ্ছা, গিয়ে অডিশনটা দিয়েই আসি। হবে তো না, একটা চেষ্টা করে দেখলে ক্ষতি কী।

অডিশন দিতে গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ। প্রায় সাত শ জন এসেছেন অডিশন দিতে! দীপ্তির ভয়টা আরও বাড়ল। শেষে না সাত শ জনের মধ্যে সবার শেষের নামটা তাঁরই হয়! কিন্তু অডিশন রুমে ঢুকতেই সবকিছু যেন বদলে গেল। প্রাথমিক অডিশনে সাবিনা ইয়াসমীনের একটা গান গাইলেন। বিচারকেরা প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত করেও ফেললেন। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। এবার হাজির হতে হবে মূল তিন বিচারক ফাহমিদা নবী, পার্থ বড়ুয়া ও তারিন জাহানের সামনে। নামগুলো শুনলেই তো ভয় লাগে। এত দিন এই তারকাদের টিভিতেই দেখে এসেছেন। সামনাসামনি প্রথম দেখা, সেটিও আবার গিয়ে শোনাতে হবে গান।

গৃহিণীদের নিয়ে সংগীত প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠান সিলন সুপার সিঙ্গারে বিজয়ী হলেন দীপ্তি সরকার। ছবি: সংগৃহীত
গৃহিণীদের নিয়ে সংগীত প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠান সিলন সুপার সিঙ্গারে বিজয়ী হলেন দীপ্তি সরকার। ছবি: সংগৃহীত

দীপ্তি নিজেকে আরও কঠিন পরীক্ষাতেই ফেললেন ইচ্ছা করে। মাহমুদুন্নবীর একটি কঠিন গানই বেছে নিলেন। আর সেই গান যেন স্মৃতিকাতর করে তুলল ফাহমিদা নবীকে। বাবার গান নিয়ে ফাহমিদা একটা তাল-লয়ের ভুলেও ছাড় দিতে নারাজ। সেখানে মেয়েটা কী গাইল! দারুণ প্রশংসা করলেন পার্থ বড়ুয়া আর তারিন জাহানও। পেয়ে গেলেন ঢাকার স্টুডিও রাউন্ডের টিকিট—ইয়েস কার্ড!

এখানেও দ্বিধা। ঢাকায় গিয়ে বেশ কদিন থাকতে হবে। শুনলেন আয়োজকেরাই থাকা-খাওয়ার আয়োজন করে রেখেছেন। স্বামীও বললেন, ভয় নেই। দরকার হলে এই কদিন আমার কোর্টে হাজিরা বন্ধ! এমন স্বামী পাশে থাকলে যে একজন স্ত্রী কত দূরে যেতে পারেন, দীপ্তি তারই প্রমাণ।

একের পর একে রাউন্ড পেরিয়ে যেতে লাগলেন দীপ্তি। জনপ্রিয় শিল্পী নাজমা জামানের ‘তোমারই জীবনে’ গানটি গেয়ে তো তাক লাগিয়ে দিলেন। গান শেষে তিনজন বিচারক একসঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানান। দীপ্তির আত্মবিশ্বাস উঠে গেল তুঙ্গে। কিন্তু সেটাই হোঁচট খেল দেশের গানের রাউন্ডে এসে। দীপ্তি প্রায় বাদই পড়ে যেতে বসলেন। মঞ্চের আড়ালে গিয়ে পারলে কেঁদেই দেন। এত দূর এসে, সেরা পাঁচ থেকে এত কাছে এসে ঘরে ফিরে যেতে হবে! না, শেষ পর্যন্ত সেরা পাঁচে উঠল তাঁরই নাম।

গান আজ দীপ্তির জীবন বদলে দিয়েছে।
গান আজ দীপ্তির জীবন বদলে দিয়েছে।

তা হয়তো উঠল, কিন্তু দীপ্তি তখনো ভাবেননি, তিনি চ্যাম্পিয়ন হবেন। বাকি চারজন প্রত্যেকে এত ভালো গান করেন, পাঁচের একজন হয়ে থাকতে পেরেই তিনি খুশি। এমনকি চূড়ান্ত ফল ঘোষণার পর যখন তাঁরই নাম বললেন উপস্থাপিকা, দীপ্তি ভাবলেন, এ–ও হয়তো সাসপেন্স তৈরির কোনো নাটক। একটু পরেই বলবে, আমাদের বিজয়ী দীপ্তি সরকার...না, দীপ্তি নয়…চ্যাম্পিয়ন সুমনা রহমান। এই সব যখন ভাবছেন, তখন মঞ্চেই তাঁর পাশে দাঁড়ানো সুমনা রহমানই এসে আলিঙ্গনে বেঁধে ফেলেছেন। দীপ্তির তখনো মনে হচ্ছে, কোথাও কোনো ভুল হচ্ছে না তো!

রুনা লায়লার মতো প্রথিতযষা শিল্পী তাঁকে চ্যাম্পিয়ন লেখা শ্যাশে পরিয়ে দিলেন। দীপ্তি পা ছুঁতে যাবেন, এমন কিংবদন্তির পায়ের ধুলা মাথায় নেওয়াও তো আশীর্বাদ। রুনা লায়লা বুকে টেনে নিলেন। বললেন, ‘এখানেই শেষ নয়, বরং শুরু। এখন তো তোমার দায়িত্ব বেড়ে গেল অনেক।’

একসময় স্বামীর কথা মনে পড়ল; এমন স্বামী আগের জন্মের পুণ্যতেই কেবল মেলে। কত সহযোগিতা-সমর্থনই না দিয়েছেন! তারপর সব থিতিয়ে এলে দীপ্তির খুব মনে পড়ল মামার কথা। আহা, মামা আসতে চেয়েছিল, অসুস্থতার জন্য আসতে পারেনি। ভাগনির সাফল্যে মামা যে বাড়িতে বসে কান্নাকাটি শুরু করেছে; সেই খবরও চলে এল কানে। দীপ্তির তখন মন টানছে মামার কোলে ছুটে যেতে। আবার গাইতে—আয় তবে সহচরী। সেই গানের একপর্যায়ে যখন দীপ্তি দরদ ঢেলে গাইবেন: ঢালো ঢালো শশধর, ঢালো ঢালো জোছনা…সত্যিকারের জোছনা নেমে আসবে তাঁদের উঠানজুড়ে!