টিভির আগে ইউটিউব

টিভি অনুষ্ঠানগুলোর দর্শক ইউটিউবেই দেখে নিচ্ছেন পছন্দের টিভি অনুষ্ঠানের পছন্দের অংশটি
টিভি অনুষ্ঠানগুলোর দর্শক ইউটিউবেই দেখে নিচ্ছেন পছন্দের টিভি অনুষ্ঠানের পছন্দের অংশটি
এত দিন রীতি ছিল নতুন অনুষ্ঠান, নাটক, টেলিছবির খবরের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হতো কোন টিভি চ্যানেলে দেখা যাবে সেটা। কিন্তু বছর দুই ধরে রীতিতে বদল এসেছে। শুরু হয়েছে নতুন ধারা। এখন টিভি চ্যানেলের নামের পাশাপাশি খবরে জুড়ে দেওয়া হয় ইউটিউব চ্যানেলের নাম। হোক তা গান, নাটক কিংবা টক শো—সবটার বেলাতেই সবাই জানতে চায়, ‘কোন ইউটিউব চ্যানেলে দেখা যাবে?’ ৪ নভেম্বর প্রথম আলোর ২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে একুশ শতকের এই নতুন ধারা বা ট্রেন্ড নিয়ে এবারের প্রতিবেদন।

দিন দিন টিভিটা সত্যিই হয়ে উঠেছে ‘বোকাবাক্স’। বোকার মতো পড়ে থাকে ঘরের একটা কোণে। তবে যে টিভিতে লেগেছে ‘স্মার্টনেস’–এর ছোঁয়া, তার আবার কদর বেশি। অর্থাৎ স্মার্ট টিভি হলে হাতের মুঠোফোন থেকে বিরতি নিয়ে বাড়ির সদস্যরা খানিকটা সময় দিচ্ছে তাকেও। কিন্তু সনাতনি টিভিসেট দিন দিন জাদুঘরে ওঠার মতো যোগ্যতা অর্জন করছে। ২১ শতকের এই বদলের হাওয়া আঁচ করতে পেরে দেশি–বিদেশি টিভি অনুষ্ঠান প্রযোজনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও নিজেদের কাজের ক্ষেত্র বদলাচ্ছে একটু একটু করে। হোক সেটা পশ্চিমের জিমি কিমেলের টিভি শো কিংবা আমাদের প্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’—টিভি চ্যানেলের পাশাপাশি ইউটিউবেও এখন বিস্তৃতি তাদের। বলে রাখি, জনপ্রিয় মার্কিন টিভি অনুষ্ঠান ‘এলেন ডিজেনেরেস শো’ শুধু ইউটিউবে দেখানো বিজ্ঞাপন থেকেই প্রতিদিন আয় করে ৪৮ হাজার মার্কিন ডলার। অর্থাৎ প্রতিদিন ৪০ লাখ টাকার বেশি!

‘কফি উইথ করণ’–এ আমির খান ও করণ জোহর
‘কফি উইথ করণ’–এ আমির খান ও করণ জোহর

টিভির চেয়ে ইউটিউবে দর্শক বেশি
পরিসংখ্যানটা এলেন ডিজেনেরেসের টিভি শো থেকেই দিই। এই অনুষ্ঠান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার দর্শকেরা দেখতে পান এনবিসি ইউনিভার্সাল নামের চ্যানেলে। যুক্তরাজ্যে এটি দেখা যায় আইটিভি টু–তে। তিন দেশ মিলে প্রতিদিন এই অনুষ্ঠান টিভি চ্যানেলে দেখেন ৩৬ লাখ দর্শক, যেখানে ইউটিউবে প্রতিদিন এই অনুষ্ঠানের একেকটি ভিডিওর গড় দর্শকসংখ্যা ১ কোটি ২০ লাখ।
শুধু ‘ইউটিউব’ নামের এই ভিডিও প্ল্যাটফর্মটির জন্য এখন এলেনের মতো বেশির ভাগ পশ্চিমা টিভি অনুষ্ঠান সঞ্চালকদের বৃহস্পতি এখন তুঙ্গে। জিমি কিমিল, জিমি ফ্যালন, কোলবার্ট, জেমস কর্ডন—সবাই এখন টিভি অনুষ্ঠান সঞ্চালনার পাশাপাশি ইউটিউবের আয় থেকে পাচ্ছেন আলাদা লভ্যাংশ। মার্কিন মুলুকের মতো ভারতেও একই অবস্থা। হোক সেটা কপিল শর্মার কমেডি শো কিংবা করণ জোহরের ‘কফি উইথ করণের’ ছোট ছোট ক্লিপ, সেটারই এখন টিভি চ্যানেলের চেয়ে ইউটিউবে কদর বেশি। ভারতীয়রা এক ধাপ এগিয়ে। তাদের টিভি চ্যানেলগুলো ‘নিউ মিডিয়া’র সঙ্গে পাল্লা দিতে একেকটা নেটওয়ার্ক খুলে বসেছে একেকটা নতুন ওটিটি (ওভার দ্য টপ) সাইট। যেমন স্টার প্লাস চালু করেছে ‘হটস্টার’, জি নেটওয়ার্কের আছে ‘জি ফাইভ’। বাংলাদেশেও ওটিটি প্লাটফর্মগুলো ধীরে ধীরে ডালপালা মেলছে। মৌলিক কনটেন্ট দিয়ে বায়োস্কোপ, হইচই, র‌্যাবিটহোল বিডি, আইফ্লিক্স, বঙ্গবিডি টেক্কা দিচ্ছে টিভি চ্যানেলগুলোকে। এভাবেই ২১ শতকের ধারার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলে যাচ্ছে চ্যানেলগুলো। টিভি চ্যানেল থেকে হয়ে যাচ্ছে ইউটিউব চ্যানেল কিংবা স্মার্টফোনে থাকা ছোট্ট একটা অ্যাপ।

বাংলাদেশে বদলের হাওয়া
বৈশ্বিক বদলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও দিনকে দিন শক্তি বাড়ছে ‘নিউ মিডিয়া’র। শুরুতেই যেমনটা বললাম, আগে খবরে জানা যেত, কোন টিভি চ্যানেলে দেখা যাবে কোন নাটক। এখন খবর আসে কোন ইউটিউব চ্যানেলে উঠছে কোন নতুন নাটক, কোন গান। নতুন ধারার তোড়ে টিভি চ্যানেলগুলো বিকল্প মাধ্যমে রূপ নিচ্ছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় টিভি চ্যানেলগুলো টেলিভিশনের চেয়ে এখন ইউটিউব নিয়ে বেশি মনোযোগী। যেমন: এনটিভি। এই টিভি চ্যানেল ইউটিউবে খুলেছে মোট ১৪টি চ্যানেল। এনটিভি নাটক, এনটিভি নিউজ, এনটিভি এন্টারটেইনমেন্ট, এনটিভি গান—এমন একেক বিনোদনের ঘরানার জন্য একেকটা চ্যানেল। টিভি চ্যানেল পরিচালনার পাশাপাশি এই ইউটিউব চ্যানেল চালানোর জন্য রীতিমতো আলাদা নিয়োজিত কর্মিবাহিনী রয়েছে তাদের। একই অবস্থা চ্যানেল আই, আরটিভিসহ প্রায় সবকটি টিভি চ্যানেলের।

গানবাংলার ‘উইন্ড অব চেঞ্জ’ অনুষ্ঠানে গাইছেন ভারতের কৈলাশ খের
গানবাংলার ‘উইন্ড অব চেঞ্জ’ অনুষ্ঠানে গাইছেন ভারতের কৈলাশ খের

দেশি টিভি অনুষ্ঠানের দর্শক এখন বৈশ্বিক
ফাগুন অডিও ভিশনের জনপ্রিয়তম ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’। প্রায় ৩০ বছর বয়সী এই অনুষ্ঠান ইউটিউবে পেয়েছে এক নতুন মাত্রা। শুধু পুরো অনুষ্ঠান নয়, ফাগুন অডিও ভিশনের ইউটিউব চ্যানেল থেকে এই অনুষ্ঠানের ছোট ছোট অংশ দর্শক এরই মধ্যে দেখেছেন কয়েক লাখ–কোটিবার। ইউটিউবে শুধুই ইত্যাদির জনপ্রিয়তার তোড়ে ফাগুন অডিও ভিশনের চ্যানেলটির সাবসক্রাইবারের সংখ্যা এখন ১৫ কোটির বেশি। একসময় যে দর্শকেরা মাসের পঞ্চম শুক্রবারে রাত ৮টার বাংলা সংবাদ শেষ হওয়ার অপেক্ষা করতেন, ২১ শতকে এসে এখন আর অপেক্ষা নয়। মনমতো সময়ে প্রিয় অনুষ্ঠান হাতের কাছে থাকা পর্দায় দেখে নিচ্ছেন দর্শক।

দীর্ঘতম সময় ধরে চলে আসা ‘ইত্যাদি’র কথা তো হলো। সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত গানের অনুষ্ঠান ‘উইন্ড অব চেঞ্জ’–এর কথাও বলি। গানের এই অনুষ্ঠানটি দেখানো হয় গানবাংলা চ্যানেলে। কিন্তু এই টিভির সম্প্রচার তো আনুষ্ঠানিকতামাত্র। অনুষ্ঠানের একেকটা গান ইউটিউবের মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে শ্রোতাদের মধ্যে—এমনটা জানিয়েছেন গানবাংলার চেয়ারপারসন ফারজানা মুন্নি। সংগীতভিত্তিক টিভি চ্যানেল গানবাংলারই ইউটিউব চ্যানেলে ওঠে উইন্ড অব চেঞ্জের গানগুলো। তাই টিভি ও ইউটিউবের দর্শক হিসাব করে ইউটিউবকেই এগিয়ে রাখছে গানবাংলা কর্তৃপক্ষ। ফারজানা মুন্নির ভাষায়, ইউটিউব দিয়ে উইন্ড অব চেঞ্জের বাংলা গানগুলো বিশ্বময় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। কারণ, এখন এটাই সময়ের দাবি। তাই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে বিনোদনজগৎটাও।

নতুন পথে রিয়েলিটি শো
শুধু টিভি চ্যানেলের নামে ইউটিউব চ্যানেল নয়। অনুষ্ঠানের নাম ধরেও তৈরি হচ্ছে আলাদা ইউটিউব চ্যানেল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় শাহরিয়ার নাজিম জয়ের টক শোর কথা। তা ছাড়া সাম্প্রতিক টিভি রিয়েলিটি শোগুলোও নিজেদের মূল মাধ্যম হিসেবে ধরছে ইউটিউব চ্যানেলকে। টিভি চ্যানেলে এর প্রচার হয়ে উঠেছে ‘অপশনাল’। কিছুদিন আগের সংগীতভিত্তিক রিয়েলিটি শো ‘সানসিল্ক ডিভাস’ কিংবা সম্প্রতি শেষ হওয়া ‘কে হবে মাসুদ রানা?’–এর কথা ধরা যাক। দুটোই প্রচারিত হয়েছে আলাদা চ্যানেলে, কিন্তু আলোচনা হয়েছে ইউটিউবে পর্বগুলো ওঠার পরই।

একুশ শতকে এসে পুরোনো ধারায় অনুষ্ঠান প্রচার করলে তা আর ধোপে টিকবে না—এটা বুঝে গেছেন প্রযোজক ও অনুষ্ঠান নির্মাতারা। তাই দেশি–বিদেশি জনপ্রিয় অনুষ্ঠানগুলো নতুন সময়ের নতুন ধারার সঙ্গে তাল মেলানো শুরু করে দিয়েছে। কারণ নানান সংস্থার, নানান পরিসংখ্যান বলছে, টিভিসূচি ধরে বিনোদন নেওয়ার দিন ফুরাতে চলেছে। মানুষ এখন ঝুঁকছে পকেট বিনোদনের দিকে। তাই টিভি থেকে ইউটিউব আর ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোর দিকে ঝুঁকছে সবাই।