মানসী প্রেক্ষাগৃহ, কেউ কি চিনবে সিনেমা হলটিকে

‘সিনেমা চালিয়ে বিদ্যুৎ বিল উঠত না। দু-তিনজন দর্শক হতো। এমনও দিন গেছে, দর্শক মাত্র একজন। ছবির মাঝখানে উঠে চলে গেছেন। বলেছেন, “আমার ভয় করে একা একা ছবি দেখতে।”’ পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী মানসী সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাওয়ার বর্ণনা দিতে গিয়ে এসব কথা বললেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক খোরশেদ আলম। তিনি জানান, নিরুপায় হয়ে মালিক প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দিয়েছেন এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে। এখন সেখানে মার্কেট। ওপরে ২০০ আসনের একটি ছোট হল করার পরিকল্পনা আছে। তবে সেটি কবে হবে, তা জানা নেই।

অতীতে যাঁরা মানসী হলে ছবি দেখেছেন, তাঁরা এখন সেখানে গেলে বড় ধাক্কা খাবেন। ভবনটি আছে, নেই হলের সেই পুরোনো সাইনবোর্ড। প্যাঁচানো বাংলা ফন্টে ‘মানসী সিনেমা’ লেখা লাল রঙের বোর্ডটি ভবনের মূল গেটে নেই। সেখানে নতুন একটি সাইনবোর্ড, ‘মানসী কমপ্লেক্স’।

গতকাল শনিবার দুপুরে বংশাল রোডে মানসী হলে গিয়ে দেখা যায়, ব্রিটিশ শাসনামলে নির্মিত ভবনটির নিচতলার মূল প্রবেশপথ দিয়ে হলে ঢোকার নকশা করা কাঠের দরজাটির কোনো চিহ্ন নেই। নেই মুখোমুখি দুটি টিকিট কাউন্টার। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হলের রিয়ার স্টলে, পর্দা বা শত শত আসনের বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই। সেখানে সারি সারি ছোট-বড় ৪০টি দোকানে আলো জ্বলছে, চলছে বেচাকেনা।

মূল প্রবেশপথ দিয়ে ঢোকার পর পুরোনো সিঁড়িটি আছে। তবে সেটি এখন আর ব্যবহৃত হচ্ছে না; বরং যেখানে আগে সিনেমা প্রদর্শনের পর্দা ছিল, সেখানে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি বানানো হয়েছে। সেই সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে দেখা যায়, নতুন একটি অফিসকক্ষ হয়েছে। নকশা করা বিশ্রামাগার ও ক্যানটিনটি নেই। সেখানে প্রার্থনার জায়গা করা হয়েছে। ক্যানটিনের জায়গায় ‘মানসী করপোরেশন’ ও ‘দ্য নিউ পিকচার্স লিমিটেড’-এর নতুন অফিস। ওপরের ফ্লোরে মিলল আলো প্রক্ষেপণের ঘরটি। ঘর আছে ঠিকই, কিন্তু সেখানে নেই আলো প্রক্ষেপণের পুরোনো সেই যন্ত্র দুটি। সেখানে একটি পুরোনো চৌকি, কাঁথা-বালিশ আর কিছু পুরোনো আসবাব। এটি এখন কর্মীদের থাকার ঘর।

সবচেয়ে করুণ অবস্থা ড্রেস সার্কেল বা ডিসির। দেয়াল দিয়ে দুটি ঘর তৈরি করা হয়েছে। একটি নিচের কোনো দোকানের মালামাল রাখার জায়গা হিসেবে ভাড়া দেওয়া, অন্যটি মানসীরই স্টোররুম। সেখানে অগোছালোভাবে পড়ে আছে পুরোনো কয়েকটি আসন এবং বিভিন্ন যন্ত্রাংশ। অন্ধকার।

মানসী সিনেমা হলের নামফলক বদলে এখন তা ‘মানসী কমপ্লেক্স’। সিনেমা হলের বদলে সেখানে এখন সারি সারি দোকান।  ছবি: মাসুম আলী
মানসী সিনেমা হলের নামফলক বদলে এখন তা ‘মানসী কমপ্লেক্স’। সিনেমা হলের বদলে সেখানে এখন সারি সারি দোকান। ছবি: মাসুম আলী

হলের ব্যবস্থাপক খোরশেদ আলম প্রায় ৪০ বছর আগে বুকিং প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। এখন তিনি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করছেন। কর্মজীবনের পুরোটা এখানে কেটেছে। থাকেন জুরাইনে। জানালেন, কোনোভাবেই হল চালাতে পারছিল না মালিকপক্ষ। বর্তমান মালিকেরা দিনের পর দিন লোকসান গুনে শুধু ঐতিহ্য আর পূর্বপুরুষের স্মৃতি রক্ষায় হলটি চালিয়ে আসছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর টানতে না পেরে হল বন্ধ করে মার্কেট চালু করেছেন। তিনি বলেন, ছোট পরিসরে একটি হল করার পরিকল্পনা আছে। ২০০টি আসনও তৈরি করা হয়েছে। তবে কবে নাগাদ সেটি চালু হবে বলা যাচ্ছে না। সময় লাগবে।

জানা গেছে, এর আগে আরও দুবার দীর্ঘ সময়ের জন্য বন্ধ হয়েছিল মানসী হল। মুক্তিযুদ্ধের আগে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় মুসলমানরা ‘মানসী’ নামের কারণে হিন্দুদের প্রতিষ্ঠান ভেবে এতে আগুন ধরিয়ে দেয়। তখন বেশ কিছুদিন বন্ধ থাকে প্রতিষ্ঠানটি। অনেক পর প্রতিষ্ঠানটি নাম পরিবর্তন করে ‘নিশাত’ নামে চালু হয়। মুক্তিযুদ্ধের পরে নিশাতকে পাকিস্তানিদের সম্পত্তি ভেবে আবার আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। বন্ধ হয় সিনেমা হলটি। কিছুদিন পর আবার মানসী নামে ফিরে আসে। তবে এবার বন্ধ হওয়ার পর আবার কবে ফিরবে মানসী সিনেমা, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য হলের কোনো কর্মকর্তার কাছে নেই। কথা হয় হলটির পরিচালক আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে। তিনিও বলতে পারলেন না কবে চালু হবে বা কবে হল সাজানোর কাজ শুরু হবে।

গাজীপুরের কালিয়াকৈরের ঐতিহ্যবাহী বলিয়াদী জমিদার আবরার আহমেদ সিদ্দিকী ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর পূর্ববঙ্গের রাজধানী ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র সমিতি এবং ১৯৫২ সালে পূর্ববঙ্গ চলচ্চিত্র সমিতির অন্যতম নেতা ছিলেন। এর আগে তিনি ১৯২৬ সালে বংশাল এলাকায় একটি হল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। ওই সময়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। নিজের প্রতিষ্ঠানের জন্য জমিদার আবরার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে যান। কবিগুরু তখন সিনেমা হলের নাম দেন ‘মানসী’।

তিনতলার ওপরে টিনের ছাউনি দেওয়া মানসী হলের ভবনটি ব্রিটিশ, পাকিস্তানি শাসনামলসহ নানা সময়ের সাক্ষ্য বহন করছে। যুগের পর যুগ প্রতিষ্ঠানটি পুরান ঢাকার চলচ্চিত্রানুরাগী দর্শকদের চাহিদা পূরণ করেছিল। একসময় এখানে উর্দু ও হিন্দি ছবির প্রদর্শনী হতো। পরে ইংরেজি ও বাংলা ছবির প্রদর্শন হয় এখানে। তবে এখন মূল ভবন ছাড়া সবই ইতিহাস।