ঢাকা-আসাম মিলেছিল ভূপেনের গানে

শিল্পকলা একাডেমির সংগীত ও নৃত্যকলা ভবন মিলনায়তনে ভূপেন হাজারিকার গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশনা। ছবি: প্রথম আলো
শিল্পকলা একাডেমির সংগীত ও নৃত্যকলা ভবন মিলনায়তনে ভূপেন হাজারিকার গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশনা। ছবি: প্রথম আলো

‘আমি এক যাযাবর’, ‘ও গঙ্গাঁ বইছো কেন’-র মতো গান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের সীমানা ছাড়িয়েও বাংলাদেশের মাটিতে ছড়িয়ে পড়েছে। নিজের একটা স্বতন্ত্র গায়কি তৈরি করেছিলেন ভূপেন হাজারিকা। আর সেই গায়কিতেই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থাকত এ দেশের অনেক সংগীতানুরাগী। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির সংগীত ও নৃত্যকলা ভবন মিলনায়তনে ভূপেনের গানে মুগ্ধ হওয়ার দৃশ্যটি আবার দেখা গেল। আবারও প্রমাণ হলো ভূপেন হাজারিকার গানের আবেদন এতটুকু কমেনি এ দেশের শ্রোতার কাছে।

উপমহাদেশের প্রখ্যাত গণসংগীতশিল্পী ভূপেন হাজারিকার অষ্টম প্রয়াণ দিবস ছিল ৫ নভেম্বর। তাঁকে স্মরণ করে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও আসামের সংগঠন ব্যতিক্রম মাসডো যৌথভাবে আয়োজন করেছে ‘মোরা যাত্রী একই তরণীর’ শীর্ষক আলোচনা, সংগীত ও নৃত্যানুষ্ঠানের। গতকাল সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় সংগীত ও নৃত্যকলা কেন্দ্র মিলনায়তনে শুরু হয় এই অনুষ্ঠান।

প্রথম দিনের আলোচনায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর সভাপতিত্বে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ব্যতিক্রম মাসডোর সভাপতি সৌমেন ভারতীয়া, ভূপেন হাজারিকার ছোট ভাই সমার হাজারিকা, পদ্মশ্রী পুরস্কারপ্রাপ্ত সূর্য কান্ত হাজারিকা এবং আসামের সাংবাদিক অজিত কুমার ভূঁইয়া। এ সময় বক্তারা ভূপেন হাজারিকার ওপর পদ্মশ্রী পুরস্কারপ্রাপ্ত সূর্য কান্ত হাজারিকা রচিত ‘আমি এক যাযাবর’ শীর্ষক গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করেন।

ভূপেন হাজারিকার গান শোনান শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। ছবি: প্রথম আলো
ভূপেন হাজারিকার গান শোনান শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। ছবি: প্রথম আলো

অনুষ্ঠানে আলোচনায় বক্তারা বলেন, ভূপেন হাজারিকার গান বাণী ও বিষয়বৈচিত্র্যের দৃষ্টিকোণ থেকে বহুমুখী। তিনি আজীবন মানবতাবাদী, সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে মানবপ্রেমই তাঁর গানের মূলকথা। তাঁর গানের মধ্যে মানবিকতা, দেশপ্রেম ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার বহিঃপ্রকাশ চিরায়ত। বক্তারা আরও বলেন, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাজুড়ে মানুষের নিদারুণ কষ্ট, চা-বাগানের মালিকদের অত্যাচার বা ইংরেজদের চাবুকের আস্ফালন—সবই যেন মনের খাতায় তুলে রাখতেন ভূপেন হাজারিকা। আর অবসরে সেই মনের খাতা খুলে নেমে পড়তেন আর একের পর গান লিখতেন। নিজেই সুর দিয়ে তৈরি করতেন এক অনন্য বার্তাবাহী গান। যা বয়ে নিয়ে যেত উজান আসামের মানুষের কথা। দেশভাগের সময় মানুষের দুঃখবেদনা এবং উদ্বাস্তু হওয়ার জ্বালাকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন ভূপেন হাজারিকা। আর এসব চাক্ষুষ অভিজ্ঞতাই পরে তাঁর গান হয়ে বেরিয়ে আসত। ভূপেন হাজারিকার গানে স্থানীয় লোকালয়ে একটা অনুপ্রেরণা অবশ্যই থাকত। কিন্তু সবকিছুকেই ছাপিয়ে যেত গানের মধ্যে লুকিয়ে থাকা একটি দৃঢ় প্রত্যয়ী বার্তা। মানুষের কথা বলতে ভালোবাসতেন ভূপেন হাজারিকা। আর তাঁর এই গানের জন্য বাঙালি খুঁজে পেয়েছিল দেশভাগে অব্যক্ত হয়ে থাকা কথাকে।’

অনুষ্ঠানে সূর্য কান্তা হাজারিকা রচিত ‘আমি এক যাযাবর’ শীর্ষক গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করেন অতিথিরা। ছবি: প্রথম আলো
অনুষ্ঠানে সূর্য কান্তা হাজারিকা রচিত ‘আমি এক যাযাবর’ শীর্ষক গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করেন অতিথিরা। ছবি: প্রথম আলো

আলোচনা ও বইয়ের মোড়ক উন্মোচন শেষে আসামের বর্ণালি মহাত্মের পরিচালনায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি নৃত্যশিল্পীদের পরিবেশনায় সত্রীয়া নৃত্য, কৃষ্ণ বন্দনা, গোপী নৃত্য পরিবেশিত হয়। অনুষ্ঠানে গান শোনান সমার হাজারিকা, ডাউর হাজারিকা এবং দিকসু শর্মা। ‘বিস্তীর্ণ দুপারে’ গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করে দিপালী দাস। রুমিলা বড়োর নৃত্য পরিচালনায় বিহু আঙ্গিকে সাজিয়ে দোপাটি মাথার খোঁপাটি গানের সুরে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নৃত্যশিল্পীরা পরিবেশন করেন সমবেত নৃত্য। ছিল ঢাকা সাংস্কৃতিক দলের পরিবেশনায় সমবেত গানের পরিবেশনা। একক গান শোনান শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী, মাইনু দেবী এবং পাদ্মানভ বারদলই।

আজ দ্বিতীয় দিনের আয়োজন শুরু হয় সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায়। একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে আজও আলোচনা, সংগীত, নৃত্য ও নাট্যানুষ্ঠান রয়েছে। কাল সন্ধ্যা সাতটায় একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে পরিবেশিত হবে অসম কলাতীর্থ ও এস বি মুভিজের নাটক ‘কমলাকুঁয়ারীর সাধু’।

অনুষ্ঠানে আয়োজক ও অতিথিদের সঙ্গে দুই দেশের শিল্পীরা। ছবি: প্রথম আলো
অনুষ্ঠানে আয়োজক ও অতিথিদের সঙ্গে দুই দেশের শিল্পীরা। ছবি: প্রথম আলো

উত্তর–পূর্ব ভারতের রাজ্য আসামে ১৯২৬ সালে এক শিক্ষক পরিবারে জন্ম ভূপেন হাজারিকার। গুয়াহাটি, বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় আর কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। পড়াশোনা শেষে ভারতে ফিরে ভূপেন হাজারিকা গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। 

আমেরিকায় থাকার সময়েই তাঁর পরিচয় বিখ্যাত শিল্পী পল রবসনের সঙ্গে, যাঁর অনেক বিশ্ববিখ্যাত গানের ভারতীয় রূপান্তর করেছেন ভূপেন হাজারিকা। অবশ্য তার অনেক আগেই, ১৯৩৯ সালে অহমীয়া ভাষায় প্রযোজিত দ্বিতীয় ছায়াছবি ‘ইন্দ্রমালতীর’ জন্য গান গেয়ে তাঁর সংগীত জীবনের শুরু তখন ভূপেনের বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর। ছোট থেকেই অসমিয়া ছবিতে শিশুশিল্পী হিসেবে কাজ করতেন ভূপেন। শুটিংয়ের ফাঁকে ব্রহ্মপুত্রের বিশাল জলরাশি বা চা-বাগানের কুরি তোলা মহিলারা তাঁর মনকে ভাবিয়ে তুলত। আর এদের কথা ভেবেই মাত্র ১২ বছরে গান লিখে ফেলেছিলেন ভূপেন হাজারিকা।

ভূপেনের গানের সঙ্গে বাংলাদেশের শিল্পীদের নৃত্য পরিবেশনা। ছবি: প্রথম আলো
ভূপেনের গানের সঙ্গে বাংলাদেশের শিল্পীদের নৃত্য পরিবেশনা। ছবি: প্রথম আলো

অহমীয়া লোকসংগীতের আধারে একের পর এক গান লিখেছেন, সুর করেছেন ভূপেন। যুক্ত হয়েছেন বামপন্থী গণনাট্য আন্দোলনে, যার ফলে ভূপেন হাজারিকার গানে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ জায়গা পেয়ে এসেছে। প্রথমে অহমীয়া ভাষায় গাওয়া তাঁর গানগুলোতে, আর তারপরে যখন তিনি কলকাতায় এলেন তখনো তাঁর গানে মানুষই প্রধান।

নিজের ভাষা ভিন্ন হলেও বাংলায় একের পর এক অসাধারণ গান উপহার দিয়ে গেছেন তিনি, যার মধ্যে জনপ্রিয়গুলোর একটা ‘আমি এক যাযাবর।’ যাযাবর ছিলেন বলেই আসাম থেকে কলকাতা, সেখান থেকে মুম্বাই পৌঁছেছিলেন ভূপেন হাজারিকা। কাজ করেছেন সলিল চৌধুরীর সঙ্গে। হিন্দিতেও গেয়েছেন অসংখ্য গান। হিন্দি গানের মধ্যে বিখ্যাত রুদালি ছবির ‘দিল হুম হুম করে’। এই গানটি নিয়ে হাজারিকা মন্তব্য করেছিলেন, ওই সুরটা অনেকটা তাঁর মায়ের গলায় শোনা একটা ছেলেভোলানো গানের সুরের মতো। তাঁর ‘মানুষ মানুষের জন্য’ গানটি বিবিসির শ্রোতা জরিপে সর্বকালের প্রথম ১০টি জনপ্রিয় গানের মধ্যে স্থান করে নিয়েছিল।

গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশনা। ছবি: প্রথম আলো
গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশনা। ছবি: প্রথম আলো

গানের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি ছায়াছবি প্রযোজনা আর পরিচালনাও করেছেন। অহমীয়া আর বাংলায় গান লেখা, সুর করা, ছায়াছবি পরিচালনা করা, এসবের জন্য ভূপেন হাজারিকা পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। যার মধ্যে সেরা সংগীত পরিচালকের সম্মান যেমন আছে, তেমনই আছে পদ্মশ্রী, দাদাসাহেব ফালকে সম্মান আর পশ্চিমবাংলার আকাদেমি পুরস্কার। ২০১১ সালের ৫ নভেম্বর ভূপেন হাজারিকা মারা যান। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘ভারতরত্ন’ পদকে সম্মানিত হয়েছেন প্রয়াত ভূপেন হাজারিকা।