বকুলতলায় জমেছে নবান্ন উৎসব

নবান্ন উৎসব জমেছে চারুকলার বকুলতলায়। ছবি: প্রথম আলো
নবান্ন উৎসব জমেছে চারুকলার বকুলতলায়। ছবি: প্রথম আলো

তখন পাখপাখালির ঘুম ভেঙেছিল বটে, তবে শিশিরভেজা গাছপালার পাতায় রোদের ছোঁয়া লাগেনি। চারুকলার বকুলতলায় এমন সময় বেজে উঠেছিল বাঁশির সুর, ঢোলের বাদ্যি। আর এক, দুই করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় উপস্থিত হতে শুরু করলেন শিল্পী ও শ্রোতারা। জাতীয় নবান্ন উৎসবের শুরুটা এভাবেই হয়েছিল আজ শনিবার। জাতীয় নবান্ন উৎসব উদ্‌যাপন পর্ষদের আয়োজনে এই নিয়ে ২১ বারের মতো অনুষ্ঠিত হলো উৎসব। এখানে যান্ত্রিক নগরজীবনে ঋতুভিত্তিক যে উৎসবগুলো আসে, তাতে গ্রামীণ আবহ রেখে বৈচিত্র্য অন্বেষণের আহ্বান এল নবান্ন উৎসবে। নৃত্য-গীত ও বাদ্যে হেমন্তবন্দনা যেমন হলো, তেমনিভাবে কথনে-বচনে ধ্বনিত হলো কৃষকের আর্তনাদের কথাও।

নবান্ন উৎসবে গানের সঙ্গে ছিল সমবেত নৃত্য। ছবি: প্রথম আলো
নবান্ন উৎসবে গানের সঙ্গে ছিল সমবেত নৃত্য। ছবি: প্রথম আলো

কার্তিক ও অগ্রহায়ণ—এ দুই মাসজুড়ে বাংলার প্রকৃতিতে স্বীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে আবির্ভূত হয় ফসলের ঋতু হেমন্ত। আর এ হেমন্তকালে গ্রামবাংলায় দেখা মেলে দিগন্তজোড়া ধানখেত। কচিকাঁচা ধানগাছগুলো সতেজ হয়ে এ সময় পূর্ণতা পায়। পাকা ধানের মাঠ এ সময় সোনালি চাদরের মতো লাগে। সূর্যের আলো পড়ে চিকচিক করতে থাকে। এ বছর থেকে বাংলা দিনপঞ্জি বদলে গেছে। ১৪২৬ বঙ্গাব্দে প্রথমবারের মতো আশ্বিন মাসের গণনা শুরু হয় ৩১ দিন হিসাবে। বাংলা একাডেমি দীর্ঘদিনের চেষ্টায় বাংলা বর্ষপঞ্জির এই সংস্কার করেছে। জাতির ইতিহাসের গৌরবময় দিনগুলো বাংলা ও গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জিতে অভিন্ন তারিখে সমন্বয় করতেই বাংলা বর্ষপঞ্জিতে এই সংস্কার আনা হয়েছে। সে হিসাবে আজ শনিবার ১ অগ্রহায়ণ। অগ্রহায়ণকে স্বাগত জানিয়ে হেমন্তকে উদ্‌যাপন করতে জাতীয় নবান্ন উৎসব উদ্‌যাপন পর্ষদ বিগত বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় এবারও নবান্ন উৎসবের আয়োজন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায়। বাঁশিতে লোকজ সুরে নগরে অগ্রহায়ণকে স্বাগত জানানোর পর ছিল ঋতুভিত্তিক গানের সম্মিলিত পরিবেশনা। একক গান, দলীয় নৃত্য ও একক আবৃত্তি পর্বে সাজানো হয়েছিল নবান্ন উৎসবের প্রথম ভাগ।

নবান্ন উৎসব জমেছে চারুকলার বকুলতলায়। ছবি: প্রথম আলো
নবান্ন উৎসব জমেছে চারুকলার বকুলতলায়। ছবি: প্রথম আলো

সকালেই এলেন নাট্যব্যক্তিত্ব ফেরদৌসী মজুমদার। ধীরপায়ে মঞ্চে উঠে বললেন, ‘আমি সাধারণত এমন আয়োজনে আসি না। কিন্তু এখানে এসে দেখছি, কী চমৎকার রঙিন পরিবেশ, কী সুন্দর গান-নাচ! ঢোলের বাদ্যি শোনা গেল। এগুলোর দরকার আছে। জীবন যান্ত্রিক হয়ে গেছে!’ তিনি আরও বলেন, ‘এ নবান্ন উৎসব, চৈত্রসংক্রান্তি, পয়লা বৈশাখ—এগুলো অবশ্যই থাকবে। এ উৎসবগুলো আমাদের ঘটা করে, অন্তর দিয়ে উদ্‌যাপন করতে হবে।’ তিনি নগরে ঋতুভিত্তিক উৎসবে চিরায়ত কাঠামো ভেঙে বৈচিত্র্য আনার পরামর্শ দেন। তিনি উৎসবের উদ্বোধন ঘোষণা করেন।

জাতীয় নবান্ন উৎসব উদ্‌যাপন পর্ষদের চেয়ারম্যান লায়লা হাসান বলেন, ‘আমরা আমাদের এই প্রজন্মকে মাটির সোঁদা গন্ধের যে আমেজ, যে স্নিগ্ধতা, তা শেখাতে চাই। তাদের শিকড়ের সন্ধান দিতে চাই। মানবিক জীবনে আমাদের সন্তানদের অন্যদিকে ধাবিত হওয়ার প্রয়াস থাকে, সেখানে তাদের মনে যদি এসবের বীজ বপন করে দিতে পারি, তবে নিশ্চয়ই তারা বাংলাকে ভালোবাসবে।’ নবান্নকথনে বক্তারা আরও বললেন, উৎস থেকে, শিকড় থেকে যাতে শহুরে নতুন প্রজন্মের যোগটি একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়ে, নিজেদের সাংস্কৃতিক উপাদান উপকরণগুলোর সঙ্গে যেন পরিচয়টি গভীর হয়, সে উদ্দেশ্যই থাকে ঋতুভিত্তিক এ ধরনের উৎসবে।

সাংস্কৃতিক পরিবেশনা শেষে বকুলতলা থেকে ঢাক-ঢোল বাজিয়ে বের হয় নবান্ন শোভাযাত্রা। ছবি: প্রথম আলো
সাংস্কৃতিক পরিবেশনা শেষে বকুলতলা থেকে ঢাক-ঢোল বাজিয়ে বের হয় নবান্ন শোভাযাত্রা। ছবি: প্রথম আলো

মঞ্চে উঠলেও বক্তব্য দেননি নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি ঋতুভিত্তিক এসব উৎসবের মাধ্যমে নগরজীবনে অসাম্প্রদায়িকতার বার্তার তাগিদ দেন। রামেন্দু মজুমদারের মতে, ‘এ উৎসবের সবচেয়ে বড় দিক, তা মানবিক চেতনার উৎসব, অসাম্প্রদায়িক উৎসব। আজকে মানবিক চেতনা খুব জরুরি আমাদের দেশের জন্য। এসব উৎসবের মধ্যে মানুষকে যত বেশি মানুষকে মানবতাবাদী করতে পারব, সেখানেই হবে এ উৎসবের সার্থকতা।’

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছিল দর্শকদের সংখ্যা। ঝলমলে রোদ ছড়িয়ে পড়তে পড়তে বকুল এবং আরও অনেক গাছের তলা উৎসবে শামিল নাগরিকদের জটলায় জমজমাট। মঞ্চে শিল্পীরা কখনো একক, কখনো দলীয় গান শোনালেন। কখনো কখনো গানের সঙ্গে সমবেত নৃত্য।

উৎসবে দলীয় নৃত্য পর্বে অংশ নেয় নটরাজ, নৃত্যজন, নন্দন কলা কেন্দ্র, স্পন্দন, বকুল নৃত্যালয়। দলীয় সংগীত পরিবেশন করে বহ্নিশিখা, বুলবুল একাডেমি অব ফাইন আর্টস (বাফা), সত্যেন সেন শিল্পী গোষ্ঠী ও সুরতীর্থ।

আজ ছিল জাতীয় নবান্ন উৎসব উদ্‌যাপন পর্ষদের আয়োজনে ২১তম উৎসব। ছবি: প্রথম আলো
আজ ছিল জাতীয় নবান্ন উৎসব উদ্‌যাপন পর্ষদের আয়োজনে ২১তম উৎসব। ছবি: প্রথম আলো

সকালে সালমা আকবর শোনান রবীন্দ্রনাথের ‘সেদিন আমায় বলেছিলে’, মাহজাবিন রহমান শোনান নজরুলের ‘হৈমন্তিকা এস, এস’, নবনীতা জাইদ চৌধুরী শোনান ‘একি অপরূপ রূপে মা তোমায়’। একক আবৃত্তি পরিবেশন করেন নায়লা তারান্নুম ও বেলায়েত হোসেন।

সাংস্কৃতিক পরিবেশনা শেষে বকুলতলা থেকে ঢাক-ঢোল বাজিয়ে বের হয় নবান্ন শোভাযাত্রা। সেটি চারুকলা ক্যাম্পাস ঘুরে এসে উৎসব প্রাঙ্গণে এসে শেষ হয়।

মাঝে কিছুটা বিরতি। নবান্ন উৎসবের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হবে বিকেল পাঁচটায়। সে পর্বে দলীয় সংগীতে অংশগ্রহণ করবে সুরবিহার, স্বপ্নবীণা, মন্দিরা, প্রার্থনা, ঢাকা স্বরকল্পন, কিশলয় কচিকাঁচার মেলা, সমস্বর, স্বভূমি লেখক শিল্পীকেন্দ্র, পঞ্চভাস্কর, দৃষ্টি, ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী, সংস্কৃতি মঞ্চ ও পঞ্চায়েত। দলীয় নৃত্য পরিবেশন করবে বাফা, নান্দনিক নৃত্য সম্প্রদায়, দিব্য, নৃত্যালোক, বকুল নৃত্যালয়, নৃত্যমঞ্চ ও স্বপ্ন বিকাশ কলা কেন্দ্র।

নবান্ন উৎসব জমেছে চারুকলার বকুলতলায়। ছবি: প্রথম আলো
নবান্ন উৎসব জমেছে চারুকলার বকুলতলায়। ছবি: প্রথম আলো

একক আবৃত্তিতে অংশগ্রহণ করবেন ইকবাল খোরশেদ, রফিকুল ইসলাম, রেজিনা ওয়ালী লীনা, ফয়জুল আলম পাপ্পু, মাসকুর এ সাত্তার কল্লোল, মাহমুদা আখতার, তামান্না তিথি, মাসুম আজিজুল বাসার, মাহমুদুজ্জামান মাসুদ, নজরুল কবির ও বিপ্লব রায়হান।

একক সংগীত পরিবেশন করবেন চম্পা বণিক, সরদার রহমত উল্লাহ, খগেন্দ্রনাথ সরকার, আবু বকর সিদ্দিক, অণিমা মুক্তি গোমেজ, মহাদেব ঘোষ, তামান্না নিগার তুলি, আবদুল হালিম, সঞ্জয় কবিরাজ, অনিকেত আচার্য, আবিদা রহমান সেতু, সমর বড়ুয়া, আরিফ রহমানসহ আরও অনেকে।

দলীয় আবৃত্তিতে অংশগ্রহণ করবে মুক্তধারা সংস্কৃতি ও আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্র।

নবান্ন উৎসব শুধু আমাদের দেশেই নয়, পৃথিবীর অর্ধশতাধিক দেশে উদ্‌যাপিত হয়ে আসছে। নতুন ফসল নিয়ে উৎসব মানবসমাজের প্রাচীনতম উৎসবের একটি। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ঋতুতে এ উৎসব উদ্‌যাপিত হয়। বাংলা পিডিয়ায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘অধিক শস্য প্রাপ্তি, বৃষ্টি কামনা এবং সন্তান ও পশুসম্পদ কামনা করে এই উৎসবের প্রচলন।’ আমাদের দেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মধ্যেও তাদের নিজস্ব রীতিতে নবান্ন উৎসব উদ্‌যাপিত হয়। সাঁওতালরা পৌষ মাসে ফসলের উৎসব করে ‘সোহরায়’ নামে। তাদের উৎসব চলে সাত দিন ধরে। গান-নাচের আসর চলে সারা রাত ধরে। পার্বত্য এলাকার জুমনির্ভর ম্রো জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ফসল তোলার উৎসবের নাম ‘চামোনাইত’। গারোদের উৎসবের নাম ‘ওয়ানগাল্লা’।

শুধু গানবাজনাই নয়, আগত ব্যক্তিদের নবান্নের আপ্যায়নও করা হয়েছিল শীতের ঐতিহ্যবাহী পিঠা আর মুড়ির মোয়া ও মুড়কির দিয়ে। ছবি: প্রথম আলো
শুধু গানবাজনাই নয়, আগত ব্যক্তিদের নবান্নের আপ্যায়নও করা হয়েছিল শীতের ঐতিহ্যবাহী পিঠা আর মুড়ির মোয়া ও মুড়কির দিয়ে। ছবি: প্রথম আলো