ইলিয়াস কাঞ্চনের পাশে শিল্পী সমাজ, ভক্তরা

ইলিয়াস কাঞ্চনের দুই পাশে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মিশা সওদাগর ও জায়েদ খান। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া।
ইলিয়াস কাঞ্চনের দুই পাশে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মিশা সওদাগর ও জায়েদ খান। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া।

১৯৯৩ সালের কথা। এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় এলোমেলো হয়ে যায় নব্বই দশকের তুমুল জনপ্রিয় নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের জীবন। কারণ, এ বছরের ২২ অক্টোবর তাঁর একটি ছবির শুটিং দেখতে যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চন। শোকার্ত ইলিয়াস কাঞ্চন এরপর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আর সিনেমাও করবেন না। একসময় শুরু করলেন ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন। সাড়া জাগানো অনেক ছবির অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন সেই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন এখনো। এভাবে কেটে গেছে ২৫ বছর বেশি সময়। তাঁর সংগঠনের নাম এখন জাতীয় স্লোগানে পরিণত হয়েছে।

আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে দেশে এখন প্রতিবছর পালিত হয় নিরাপদ সড়ক দিবস। সংগঠনর কর্মকাণ্ড জাতিসংঘেও প্রশংসিত হয়েছে। স্বীকৃতি হিসেবে তিনি একুশে পদক পেয়েছেন। তবে এ আন্দোলন নিয়ে ইলিয়াস কাঞ্চনকে বিভিন্ন সময় শ্রমিকদের রোষানলে পড়তে হয়েছে। এ আন্দোলন করে বারবার বিভিন্ন মহলের হুমকির শিকার হয়েছেন ইলিয়াস কাঞ্চন। সর্বশেষ নতুন সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনের দাবিতে গত সপ্তাহে বেশ কয়েক দিন বাংলাদেশের বাস-ট্রাকের শ্রমিকেরা যে ‘কর্মবিরতি’ পালন করেছেন, সেখানে চলচ্চিত্র নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের ছবিকে হেয় প্রতিপন্ন করার অভিযোগ উঠেছে। অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ইলিয়াস কাঞ্চনের ছবিসংবলিত ব্যানার টাঙিয়ে কিংবা কুশপুত্তলিকা তৈরি করে সেখানে জুতার মালা দেওয়া হয়েছে।

এসব আচরণে কষ্ট পেলেও থেমে যাওয়ার পাত্র নন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র ‘বেদের মেয়ে জোসনা’র নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন। বলেছেন, নিজের ক্যারিয়ার জলাঞ্জলি দিয়ে, নিজের সঞ্চিত অর্থ ব্যয় করে সড়ক নিরাপদের যে আন্দোলন শুরু করেছিলাম, সেটা আমি চালিয়েই যাব। কাঞ্চন বলেন, ‘যাদের জন্য আমি সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছি; কোনো কিছু পাওয়ার আশায় নয়। দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। আমার ক্যারিয়ারে সময় না দিয়ে নিরাপদ সড়কে সময় দিয়েছি। যখন দেখি, এ বিষয়টি নিয়ে বাজে মন্তব্য হচ্ছে, তখন খারাপ লাগে, কষ্ট লাগে। এ ছাড়া আর কিছু বলার নেই।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছে অগণিত ভক্তসহ চলচ্চিত্র অঙ্গনের তারকারা। বিস্ময় নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, ইলিয়াস কাঞ্চনের সঙ্গে এ কেমন আচরণ! তিনি তো সবার ভালোর জন্যই আন্দোলনটা শুরু করেছেন, বছরের পর বছর চালিয়ে নিয়ে গেছেন।

চিত্রনায়ক রুবেল বলেন, ‘নিরাপদ সড়কের দাবি নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করে যাচ্ছেন ইলিয়াস কাঞ্চন সাহেব। তাঁর দাবি সবারই দাবি। তাঁর এই কাজ দেশব্যাপী প্রশংসা পেয়েছে। তাঁর সঙ্গে দেশের মানুষ রয়েছে। তাঁকে নিয়ে যেসব মানুষ এ ধরনের পোস্টার তৈরি করেছে, তারা নোংরা মনের পরিচয় দিয়েছে। আমি এ ঘটনার প্রতিবাদের পাশাপাশি তাদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।’

শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান বলেন, ‘আমরা কাঞ্চন ভাইয়ের পাশে আছি। তিনি যেভাবে চাইবেন, আমরা তাঁর সঙ্গে আছি। যারা নোংরামি করছে, তারা দেশের ও সমাজের শত্রু। শিল্পী সমিতির পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিবাদ ও ধিক্কার জানাই। কাঞ্চন ভাই দীর্ঘদিন ধরে মানুষকে সচেতন করে আসছেন, এটা আমাদের গর্বের বিষয়। তাঁর এই সুন্দর কাজের সঙ্গে শিল্পীরা থাকবেন এবং শিল্পী সমিতি আছে।’

অভিনেতা ইমন বলেন, ‘কাঞ্চন ভাইকে নিয়ে যারা কটূক্তি করছে, আমি আমার জায়গা থেকে তাদের ধিক্কার জানাই। কারণ, কাঞ্চন ভাই আমাদের পথপ্রদর্শক, সিনিয়র অভিনেতা। নিরাপদ সড়ক প্রত্যেক মানুষের অধিকার। কাঞ্চন ভাইয়ের স্ত্রী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। এরপর থেকে তিনি সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ভূমিকা রেখে আসছেন। আমাদের দেশে বড় গাড়িগুলো রাস্তায় নামলে প্রাইভেট কার, রিকশা—এগুলোকে কিছুই মনে করে না। আমি ফেসবুকে দেখেছি, কাঞ্চন ভাইকে নিয়ে বাজে ছবি পোস্ট করা হচ্ছে। আমি মনে করি, কাঞ্চন ভাইয়ের সঙ্গে আমাদেরও একাত্মতা প্রকাশ করা উচিত।’

রাজপথে ইলিয়াস কাঞ্চন। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া।
রাজপথে ইলিয়াস কাঞ্চন। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া।

সাইমন সাদিক বলেন, ‘নিরাপদ সড়কের আইন সংশোধন করার কথা বলছেন। কেন আইন সংশোধন করতে হবে। আমরা নিজেরা সংশোধন হলেই তো হয়। আমরা আইন অমান্য করব না। তা হলে তো সংশোধন করার দরকার নেই বলে মনে করছি। সারা দেশের মানুষ তাঁকে সমর্থন দিচ্ছেন, দেবেন। কারণ, আমরা সবাই নিরাপদ সড়ক চাই। এটা নিয়ে বিরোধ করার কোনো কারণ নেই। শ্রমিকদের ফিরে আশা উচিত। যারা ভুল বোঝাচ্ছে, তাদের শনাক্ত করা উচিত।’ এ ছাড়া অভিনেত্রী অরুণা বিশ্বাস, পরিচালক গাজী জাহাঙ্গীর, অপূর্ব রানা, বজলুর রাশেদ চৌধুরী প্রমুখ ফেসবুকে এ বিষয়ে মন্তব্য করেছেন।

যোগাযোগ করা হলে প্রথম আলোকে ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা, প্রতীক্ষার পর বিভিন্ন মহলের মতামত, অনেক গবেষণা ও ব্যাপক আকারে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সবাই পেয়েছে “সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮”। যুগোপযোগী এ আইন পাস হওয়ার পর সাধারণ জনগণ ও সচেতন মহলের সবাই আইনের প্রতি সমর্থন দিয়েছে। সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর ১ নভেম্বর থেকে হওয়ার কথা থাকলেও আইন সম্পর্কে সবাই অবগত না থাকার কারণে ১৪ দিন সময় দেওয়া হয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ চালক, মালিক, যাত্রী, পথচারী—সবার আইন সম্পর্কে অবহিত হওয়া প্রয়োজন। এরপর গত তিন দিন আগে থেকে যখন আইনটি প্রয়োগ শুরু হলো, ঠিক সেই সময় আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখলাম চারদিকে এক নৈরাজ্য পরিস্থিতি। আমার প্রশ্ন হলো, কেন এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো?’

ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘এসব করে কি কোনো কিছু রোধ করা যাবে? প্রতিবাদের ভাষা কি এসব হতে পারে? পৃথিবীতে যত বড় সমস্যাই হয়ে থাকে, তার সুষ্ঠু সমাধান রয়েছে। এর জন্য সব পক্ষ থেকে আলাপ–আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের উপায় আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। আইনে কোনো অসংগতি থাকলে তা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান বের করতে হবে। এসব না করে আইনটি কার্যকর হওয়ার পর বিভিন্ন মহল থেকে আমাকে হেনস্তা করা হচ্ছে; যা অতীতেও করা হয়েছে। অথচ আমি সব সময় বলে আসছি, এ আইন করা হয়েছে সড়কের শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য, সড়কে দুর্ঘটনা কমানোর জন্য। জেল বা জরিমানা আদায়ের জন্য নয়।’

ইলিয়াস কাঞ্চন। ছবি: প্রথম আলো
ইলিয়াস কাঞ্চন। ছবি: প্রথম আলো

একসময়ের দাপুটে নায়ক কাঞ্চন বলেন, ‘কাউকে শাস্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে নয়। যদি আপনারা এ আইন সঠিকভাবে মেনে চলেন, তাহলে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। আর যদি সড়কে শৃঙ্খলা ফিরেই আসে, তাহলে আইনে জরিমানার ভয় কিসের? আপনি অপরাধ করলে আপনার জেল–জরিমানা হবে। আপনি যদি অপরাধ না করেন, তাহলে কেন আপনার জেল–জরিমানা হবে? আমি বুঝতে পারছি না নিজেদের সংশোধন না করে, সঠিক লাইসেন্স না নিয়ে, দক্ষতা অর্জন না করে, গাড়ির রেজিস্ট্রেশন ও ফিটনেস না নিয়ে উল্টো জেল-জরিমানার কথা বলে জনগণকে জিম্মি করে কেন অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হচ্ছে? অথচ একটু ধৈর্য ধরে আইনের ভেতরে গিয়ে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, এ আইনে কাউকে এককভাবে দায়ী বা টার্গেট করা হয়নি।’

১৯৭৭ সালে আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘তেইশ নম্বর তৈলচিত্র’ উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি ‘বসুন্ধরা’ চলচ্চিত্র দিয়ে চিত্রজগতে নাম লেখান ইলিয়াস কাঞ্চন। প্রথম চলচ্চিত্রেই তিনি ব্যাপক পরিচিতি পান। এরপর সুপারডুপার ছিল ‘আঁখি মিলন’ ছবির ‘আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে’ গানটি এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে। এরপর ‘ভেজা চোখ’ ছবির ‘জীবনের গল্প, আছে বাকি অল্প’ গানটিও ইলিয়াস কাঞ্চনকে দর্শকের মনে অন্যভাবে ঠাঁই করে দিয়েছিল। এরপর ‘মাটির কসম’, ‘নীতিবান’, ‘সহযাত্রী’, ‘প্রেমপ্রতিজ্ঞা’, ‘বেদের মেয়ে জোসনা’, ‘গাড়িয়াল ভাই’, ‘বাঁচার লড়াই’, ‘খুনি আসামি’—এমন অসংখ্য ছবি করেছেন তিনি। ১৯৫৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার আশুতিয়াপাড়া গ্রামে জন্ম নেওয়া বাংলা চলচ্চিত্রের সফল চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন।