গল্পটা আমাদের, একান্তই আমাদের

এইডা বয়সের টান, ভাঙারি। মানুষ এমন এক জাত যে সবকিছুর মধ্যে নিজেরে নিয়া বাঁচতে চায়, সে চায় স্বপ্ন দেখতে। নিজের একটা পৃথিবী বানাইয়া নিতে...।’ জাতীয় নাট্যশালার চিলেকোঠার পাশে মহড়াকক্ষের বাইরে থেকে সংলাপগুলো শোনা যাচ্ছিল। দরজা বন্ধ ছিল যদিও, কিন্তু তাতে মহড়ার সংলাপগুলো চার দেয়ালে বদ্ধ ছিল না। শনিবার রাত ১০টা, মঞ্চে আসার আগে ‘কালো জলের কাব্য’ নাটকের শেষ দিনের মহড়া। পরের দুই দিন কারিগরি মঞ্চায়ন। আগামী শুক্রবার জাতীয় নাট্যশালায় উদ্বোধন হবে এ নাটকের।

ছুটির দিন, তাই সারা দিনই মহড়ায় হয়েছে শনিবার। অবশ্য তাতে বিন্দুমাত্র ক্লান্তি নেই কারও চোখে–মুখে। রাত ১০টার শেষ দফা মহড়ার আগে একটু বিরতি ছিল। সবাই মিলে কিছুটা সলাপরামর্শ করলেন। নির্দেশক আবার সবাইকে ফিরতে নির্দেশ দিলেন। চরিত্রে ফেরার জন্য মিনিট কয়েক শারীরিক কসরত, প্রাণায়াম। মুহূর্তেই সবাই হয়ে গেলেন ‘কালো জলের কাব্য’ নাটকের চরিত্র।

কালো জলের কাব্যে ‘ভাঙারি’ চরিত্রে অভিনয় করছেন আসাদুজ্জামান নূর। ছবি: প্রথম আলো
কালো জলের কাব্যে ‘ভাঙারি’ চরিত্রে অভিনয় করছেন আসাদুজ্জামান নূর। ছবি: প্রথম আলো

নবীন–প্রবীণ শিল্পীদের মধ্যে যে মানুষটির তরুণ উপস্থিতি, তিনি আসাদুজ্জামান নূর। সাধুবাদ দিতেই হয় তাঁকে। নাটকটির জন্য দারুণ শ্রম, মেধা দিচ্ছেন ব্যস্ত এ রাজনীতিবিদ সাংসদ। অবশ্য নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের অন্য সব সদস্য বাহবা পাওয়ার যোগ্য। নাটকে অপি করিমের মতো তারকার উজ্জ্বল উপস্থিতি দর্শকের আগ্রহ বাড়াবে নিশ্চয়। মহড়াকে তাঁরা সবাই মূল্য দেন। সারা দিন মহড়া করে, আবার ছুটছেন সেট প্রস্তুতের কাজে।

নির্দেশক পান্থ শাহরিয়ার নানা দিকে ঘুরছেন। ছোটখাটো ভুলগুলো ধরিয়ে দিচ্ছেন। সংলাপগুলো আমাদের বুঝিয়ে দেয়, গল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছে একাকার জাহাজভাঙা শিল্পের সঙ্গে জড়িত সাধারণ মানুষ। কাহিনি এগিয়ে যেতে থাকে আর মূর্ত হয়ে উঠতে থাকে চরিত্রগুলো। একসময় মনে হয়, কোথায় যেন শুনেছি বা পড়েছি গল্পটা...। শেক্‌সপিয়ারের ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’?

নাটকে অপি করিমের মতো তারকার উজ্জ্বল উপস্থিতি দর্শকের আগ্রহ বাড়াবে নিশ্চয়। ছবি: মাসুম আলী
নাটকে অপি করিমের মতো তারকার উজ্জ্বল উপস্থিতি দর্শকের আগ্রহ বাড়াবে নিশ্চয়। ছবি: মাসুম আলী

মহড়ার বিরতিতে বিষয়টি পরিষ্কার করলেন নির্দেশক। পান্থ শাহরিয়ার বললেন, ‘অনেক বছর ধরে শেক্‌সপিয়ারের “মার্চেন্ট অব ভেনিস”–এর গল্পটা মাথার ভেতর পোকা হয়ে ঘাপটি মেরে বসে ছিল। এবার তার নাড়া পড়ল। আমি গল্পটাকে দেখতে চেয়েছি এই মুহূর্তে। কিন্তু বিপত্তিটা হচ্ছে অমন ভয়ংকর একটা মুহূর্তকে কী করে এখনকার সময়ে দেখানো যায়। সে জন্য খুঁজতে শুরু করি এমন এক জায়গা, যেটা কিনা আমাদের খুব কাছে হলেও বড় অচেনা। আমাদের মতো করে দাঁড় করাতে চেয়েছি অন্য এক গল্প, যেটা “মার্চেন্ট অব ভেনিস”–এর ছায়া অবলম্বনে হলেও শেক্‌সপিয়ারের “মার্চেন্ট অব ভেনিস” নয়। গল্পটা আমাদের, একান্তই আমাদের।’

‘কালো জলের কাব্য’ নাটকের শেষ দিনের মহড়া। ছবি: মাসুম আলী
‘কালো জলের কাব্য’ নাটকের শেষ দিনের মহড়া। ছবি: মাসুম আলী

‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’–এর মূল চরিত্র শাইলক। আর ‘কালো জলের কাব্য’–এ চরিত্রটির নাম ‘ভাঙারি’। এ চরিত্রে অভিনয় করছেন আসাদুজ্জামান নূর। কথাপ্রসঙ্গে জানালেন, সর্বশেষ অভিনয় করেছিলেন ‘মুখোশ’ নাটকে, ২০০১ সালে। এরপর সেভাবে নতুন কোনো নাটকে অভিনয় করা হয়নি। এই নাটকে জাহাজভাঙা শিল্পে শ্রমিকের জীবনের হাসি–কান্না–দুঃখ–ভালোবাসার নিয়ন্ত্রণ যেন আসাদুজ্জামান নূর ‘ভাঙারি’র হাতে। তবে পুরো নাটক না দেখলে বোঝা যাবে না, অদ্ভুত এই ভাঙারি আসলে কে। এমনকি দিনের পর দিন ভাঙারি বলে পরিচিত হয়ে ওঠা লোকটার আসল নামটা পর্যন্ত না। আমরাও আপাতত জানতে চাই না। মহড়ায় বেশিক্ষণ অবস্থান করা ঠিক হবে না। অপেক্ষা ২৯ নভেম্বর শুক্রবারের জন্য, সেদিন সন্ধ্যা সাতটায় জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে ‘কালো জলের কাব্য’র প্রথম প্রদর্শনী হবে। এটি নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের ৪৭তম প্রযোজনা।

‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’–এর ছায়া অবলম্বনে করা হয়েছে ‘কালো জলের কাব্য’। ছবি: প্রথম আলো
‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’–এর ছায়া অবলম্বনে করা হয়েছে ‘কালো জলের কাব্য’। ছবি: প্রথম আলো