বহু মানুষের অন্তর ছুঁয়ে গেছেন রবিউল হুসাইন

রবিউল হুসাইন। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
রবিউল হুসাইন। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

কবি ও স্থপতি রবিউল হুসাইনকে শেষ শ্রদ্ধা জানাল সর্বস্তরের জনগণ। কবি, সাহিত্যিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সংগঠন এবং আত্মীয়-সুহৃদদের ভালোবাসায় সিক্ত হলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত এই কবি। গতকাল সকাল ১০টায় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এই আয়োজন করে।

শ্রদ্ধা জানাতে এসে ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ‘রবিউল হুসাইন কবি হিসেবে বিশিষ্ট ছিলেন। এ ছাড়া স্থাপত্যবিদ্যায়ও তাঁর একটা ভূমিকা ছিল। সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে রবিউল হুসাইন সব সময় চলেছেন। আমরা কয়েক দিন আগে একসঙ্গে মিলিত হয়েছিলাম। এত তাড়াতাড়ি তিনি চলে যাবেন, এটা ভাবতে পারিনি। আমি তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।’

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সারওয়ার আলী বলেন, ‘রবিউল হুসাইনের বড় পরিচয় হলো, তিনি একজন উচ্চমানের কবি এবং উচ্চমানের একজন স্থপতিও। কিন্তু তাঁর আরেকটি সত্তা রয়েছে। তা হচ্ছে তিনি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ এবং এই চেতনায় যেন দেশের মানুষ ঋদ্ধ হয়, সে ব্যাপারে গভীর আগ্রহী ছিলেন।’

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আরেক ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, ‘এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, বহু মানুষের অন্তর তিনি ছুঁয়ে গেছেন। এমনভাবে আমাদের কাছ থেকে চলে যাবেন, এটা ভাবতেও পারিনি আমরা।’

শ্রদ্ধা জানান সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী, বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী ও নাট্যজন আসাদুজ্জামান নূর, নির্মাতা মসিহ উদ্দিন শাকের, কবি মুহাম্মদ সামাদ, চিত্রশিল্পী মনিরুজ্জামান, চিত্রশিল্পী মনিরুল ইসলাম প্রমুখ। এ ছাড়া বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান শ্রদ্ধা জানায়।

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে কবি ও স্থপতি রবিউল হুসাইনকে শেষ শ্রদ্ধা জানাল সর্বস্তরের জনগণ। ছবি: প্রথম আলো
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে কবি ও স্থপতি রবিউল হুসাইনকে শেষ শ্রদ্ধা জানাল সর্বস্তরের জনগণ। ছবি: প্রথম আলো

কবি রবিউল হুসাইনের ভাই তাইমুর হুসাইন জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে জানাজা শেষে রবিউল হুসাইনের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। তারপর মরদেহ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হবে।

রবিউল হুসাইন রক্তের সংক্রমণে ভুগছিলেন। দুই সপ্তাহ ধরে তাঁকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। অবস্থার অবনতি হওয়ায় সোমবার তাঁকে সিসিইউতে নেওয়া হয়েছিল। সেখানেই শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।

রবিউল হুসাইন একাধারে স্থপতি, কবি, শিল্প-সমালোচক, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক ও সংস্কৃতিকর্মী ছিলেন। পেশা স্থাপত্যশিল্প হলেও সম্পৃক্ত ছিলেন বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষকও ছিলেন তিনি। ভাষা ও সাহিত্যে অবদান রাখায় ২০১৮ সালে একুশে পদক পান এই কবি।

১৯৪৩ সালের ৩১ জানুয়ারিতে ঝিনাইদহের শৈলকুপার রতিডাঙ্গা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন রবিউল হুসাইন। কুষ্টিয়ায় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে তিনি ভর্তি হন ইস্ট পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং টেকনোলজির (বর্তমান বুয়েট) আর্কিটেকচার ফ্যাকাল্টিতে। ১৯৬৮ সালে তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন এবং স্থপতি হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।

রবিউল হুসাইনের নকশায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তি ও স্বাধীনতা তোরণ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ফটক, ভাসানী হল, বঙ্গবন্ধু হল, শেখ হাসিনা হল, খালেদা জিয়া হল, ওয়াজেদ মিয়া সায়েন্স কমপ্লেক্স, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটরিয়াম ও একাডেমিক ভবন কমপ্লেক্স নির্মিত হয়েছে।

বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য রবিউল শিশু-কিশোর সংগঠন কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলা, জাতীয় কবিতা পরিষদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর, ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ক্রিটিক অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন।

রবিউল হুসাইনের লেখা উল্লেখযোগ্য বই হলো ‘কী আছে এই অন্ধকারের গভীরে’, ‘আরও উনত্রিশটি চাঁদ’, ‘স্থিরবিন্দুর মোহন সংকট’, ‘কর্পূরের ডানাঅলা পাখি’, ‘আমগ্ন কাটাকুটি খেলা’, ‘বিষুবরেখা’, ‘দুর্দান্ত’, ‘অমনিবাস’, ‘কবিতাপুঞ্জ’, ‘স্বপ্নের সাহসী মানুষেরা’, ‘যে নদী রাত্রির’, ‘এইসব নীল অপমান’, ‘অপ্রয়োজনীয় প্রবন্ধ’, ‘দুরন্ত কিশোর’, ‘বাংলাদেশের স্থাপত্য সংস্কৃতি’, ‘নির্বাচিত কবিতা’, ‘গল্পগাথা’, ‘ছড়িয়ে দিলাম ছড়াগুলি’ ইত্যাদি।