ঘটাহীন, তবে মূল্যবান এক উৎসব

কালো জলের কাব্য নাটকের মহড়া। ছবি: সংগৃহীত
কালো জলের কাব্য নাটকের মহড়া। ছবি: সংগৃহীত
এখন যেন উৎসবের নগরী ঢাকা। নাটকের উৎসব। একটি শেষ হতে না হতেই আরেক উৎসবের শুরু। আড়ম্বরপূর্ণ উৎসব, আড়ম্বরহীন উৎসব। দেশ–বিদেশের নাটকের সঙ্গে আরও যোগ হচ্ছে নতুন নাটকও। বিস্তারিত জানাচ্ছেন মাসুম আলী

বাংলাদেশে দর্শনীর বিনিময়ে নাট্যচর্চার পথিকৃৎ নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়। ১৯৭৩ সালে বাদল সরকারের লেখা বাকী ইতিহাস নাটক মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে নিয়মিত দর্শনীর বিনিময়ে নাট্যচর্চা শুরু করে দলটি। ২০১৮ সালে এ দল উদ্‌যাপন করেছে প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর এবং দর্শনীর বিনিময়ের নাট্যচর্চার ৪৫ বছর। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় আবারও ইতিহাস সৃষ্টি করছে। কাল ২৯ নভেম্বর ‘নতুনের উৎসব’ শিরোনামে একটি উৎসব শুরু করবে তারা। এ উৎসবের মূল বৈশিষ্ট্য হলো, সাতটি নতুন নাটক নিয়ে এ উৎসবের আয়োজন করেছে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়। এতগুলো নতুন নাটক নিয়ে একটি দলের উদ্যোগে এমন উৎসব আগে কখনো হতে দেখা যায়নি।

সাত নতুন নাটক নিয়ে এ উৎসব, তবে সাজসজ্জায় অনাড়ম্বর। এমনটাই জানালেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সাংসদ আসাদুজ্জামান নূর। তিনি জানান, নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের আয়োজনটি হবে অনাড়ম্বর। অর্থ সাশ্রয় করে তা দেওয়া হবে নাট্যাঙ্গনের অসচ্ছল দুই শিল্পীকে। আসাদুজ্জামান নূর বলেন, নতুন ভাবনার এ উৎসবের মূল লক্ষ্য হচ্ছে মঞ্চে মানসম্পন্ন নতুন নাটক নিয়ে আসা। সেই সূত্র ধরে প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ নির্দেশকদের কাজের বিস্তৃতি ঘটানো। এ ছাড়া আরেকটি কারণে এটি হবে ব্যতিক্রম আয়োজন। উদ্বোধনীতে প্রবীণেরা থাকবেন, তবে প্রদীপ প্রজ্বালন করবেন নতুন প্রজন্মের প্রতিশ্রুতিশীল সাত নারী।

আগামীকাল ২৯ নভেম্বর বিকেলে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রদীপ প্রজ্বালন করবেন বন্যা মির্জা, সামিনা লুৎফা, তনিমা হামিদ, আইরিন পারভীন, সাধনা আহমেদ, হৃদি হক ও জ্যোতি সিনহা। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেবেন উৎসবের আহ্বায়ক সারা যাকের। আতাউর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। বিশেষ অতিথি থাকবেন নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, মামুনুর রশীদ, নাসির উদ্দীন ইউসুফ ও শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী।

আগামী ৫ ডিসেম্বর উৎসবের সমাপনী অনুষ্ঠানে চার নাট্যব্যক্তিত্ব ফেরদৌসী মজুমদার, জ্যোৎস্না বিশ্বাস, লাকী ইনাম ও শিমূল ইউসুফকে সম্মাননা জানানো হবে।

নতুনের উৎসবের সমাপনী দিনে মঞ্চস্থ হবে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিল্পীদের অভিনীত নাটক লটারি। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
নতুনের উৎসবের সমাপনী দিনে মঞ্চস্থ হবে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিল্পীদের অভিনীত নাটক লটারি। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

লটারি

আরেকটি নাটক বিশেষভাবে আলোচনায় থাকবে উৎসবে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিল্পীদের অভিনীত নাটক লটারি।সমাপনী দিনে, অর্থাৎ ৫ ডিসেম্বর মঞ্চস্থ হবে এটি। মোস্তাফিজ শাহীন নির্দেশিত নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের এ প্রযোজনাটিতে উপদেষ্টার ভূমিকায় আছেন সারা যাকের। নির্দেশক মোস্তাফিজ শাহীন বলেন, এ নাটকে বেশির ভাগই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। দৃষ্টিশক্তি নেই। আর এই ‘নেই’ কথাটাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চান তাঁরা।

কালো জলের কাব্য

সংগত কারণে এ উৎসবে সবচেয়ে বেশি আলোচনা যে নাটক ঘিরে, সেটি হলো নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের নতুন প্রযোজনা কালো জলের কাব্য। নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন পান্থ শাহরিয়ার। উইলিয়াম শেক্‌সপিয়ারের মার্চেন্ট অব ভেনিসএর ভাবানুবাদের নাটকটিতে অভিনয় করছেন আসাদুজ্জামান নূর। উৎসবের প্রথম দিনে, অর্থাৎ আগামীকাল নাটকটির মঞ্চায়ন।

ঢাকার বাইরের দুই নাটক

শুধু রাজধানীতে সীমাবদ্ধ না রেখে ঢাকার বাইরের দুই দলকে যুক্ত করা হয়েছে উৎসবে। আফ্রিকার গল্প অবলম্বনে শুভাশিস সিনহার নির্দেশনায় ৪ ডিসেম্বর মঞ্চস্থ হবে মণিপুরি থিয়েটারের নাটক ও মনপাহিয়া।উৎসবের দ্বিতীয় দিন ৩০ নভেম্বর মঞ্চস্থ হবে শামীম সাগর নির্দেশিত সুনামগঞ্জের বন্ধন থিয়েটার ও প্রসেনিয়াম থিয়েটার যৌথ নির্মাণের ফসল রাধারমণ

আকাশে ফুইটেছে ফুল— লেটো কাহন

১ ডিসেম্বর মঞ্চস্থ হবে রতন সিদ্দিকী রচিত ও হৃদি হক নির্দেশিত নাগরিক নাট্যাঙ্গনের নাটক আকাশে ফুইটেছে ফুল—লেটো কাহন।এটি মঞ্চে আনছে নাগরিক নাট্যাঙ্গন। নির্দেশনার পাশাপাশি হৃদি হক এই নাটকে অভিনয়ও করেছেন। মঞ্চে এটি হৃদি হকের তৃতীয় নির্দেশনা। নাটকের গল্পে দেখা যাবে, একটি লেটো গানের দল আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মাতিয়ে রাখে চুরুলিয়া-আসানসোল। এরই মধ্যে একদিন ঘোষিত হয় বঙ্গভঙ্গ। বিভক্ত হয় বাংলা। বিষাক্ত হয়ে ওঠে কলকাতা, ঢাকা, বর্ধমান। ১৯১১ সালে প্রাণান্তকর চেষ্টায় রোহিত হয় বঙ্গভঙ্গ। স্বস্তির বাতাস বয়ে যায়। কিন্তু তত দিনে গায়কের অভাবে লেটোর দল বিলুপ্ত হতে বসেছে। এমনই ক্রান্তিকালে লেটোর দলে যুক্ত হয় চুরুলিয়ার হতদরিদ্র পরিবারের ছেলে দুখু মিয়া। তার গায়কি দক্ষতায় পুনরায় জেগে ওঠে লেটোর দল। মেতে ওঠে চুরুলিয়া-আসানসোলের প্রান্তিক মানুষ। এটাই হচ্ছে আকাশে ফুইটেছে ফুল—লেটো কাহন

খোয়াবনামা ও অরূপরতন

উৎসবের নাটকগুলো হবে বৈচিত্র্যপূর্ণ। সেটাই বোঝা গেল নির্দেশকের সঙ্গে কথা বলে। এ আয়োজনে যুক্ত হয়েছে নাগরিকের একটি নতুন নাটক এবং মঙ্গলদ্বীপ ফাউন্ডেশন প্রযোজিত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের অভিনীত নাটক। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের উপন্যাসের নাট্যরূপে কাজী তৌফিকুল ইসলামের নির্দেশনায় ৩ ডিসেম্বর মঞ্চস্থ হবে নাটক খোয়াবনামা।এটি আনছে প্রাচ্যনাট। নির্দেশক কাজী তৌফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এ প্রথম একটি নাটকের নির্দেশনা দিতে গিয়ে একটা বিষয়ে কোনো টেনশন ছিল না, অর্থ জোগানো। নিশ্চিন্তে কাজ করতে পেরেছি।’

একই উৎসবে এর আগের দিন অর্থাৎ আগামী ২ ডিসেম্বর মঞ্চস্থ হবে সাইদুর রহমানের নির্দেশনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অরূপরতন নাটকটি।

আজ নাট্যধারার আনন্দযজ্ঞ ও ‘তনুশ্রী পদক’

২৭ বছরে পদার্পণ করেছে ‘নাট্যধারা’। এ উপলক্ষে আজ ২৮ নভেম্বর থেকে ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার মিলনায়তনে তিন দিনের ‘নাট্যোৎসব এবং আনন্দযজ্ঞ’র আয়োজন করেছে দলটি। আজ বিকেল চারটায় ঢাকের বাজনার তালে তালে, বেলুন উড়িয়ে ও প্রদীপ জ্বালিয়ে উৎসবের উদ্বোধন করবেন ২৭টি নাট্যসংগঠনের ২৭ জন নাট্যকর্মী। এদিন সন্ধ্যা ছয়টা ৩০ মিনিটে অকালপ্রয়াত নাট্য ও নৃত্যশিল্পী তনুশ্রী গায়েন স্মরণে তনুশ্রী বন্দনা পরিবেশন করবে নৃত্যসংগঠন ‘নৃত্যলোক’। এরপরই দেওয়া হবে ‘তনুশ্রী পদক’। তনুশ্রীর স্মৃতিকে ধরে রাখতে ২০০১ সাল থেকে পদকটি দিয়ে আসছে ‘নাট্যধারা’। সবশেষে সমতট নাট্যদল মঞ্চায়ন করবে পালানাটক উজান ভাইটাল কইন্যা। দ্বিতীয় দিনের উৎসব শুরু হবে বিকেল চারটায়। এদিন কলকাতা থেকে আসা ইফটা মঞ্চায়ন করবে ডিয়ার পাপার দুটি প্রদর্শনী। প্রথম প্রদর্শনীটি হবে বিকেল চারটা ১৫ মিনিটে, দ্বিতীয়টি সন্ধ্যা সাতটা ১৫ মিনিটে। উৎসবের সমাপনী দিন থাকছে নাট্যধারার নাটক চার্লির প্রদর্শনী।

সম্মাননা গ্রহণ করছেন কুমার বিশ্বজিৎ
সম্মাননা গ্রহণ করছেন কুমার বিশ্বজিৎ

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে চার গুণীকে ঋষিজের সংবর্ধনা

সাংস্কৃতিক সংগঠন ঋষিজ পূর্ণ করেছে ৪৩ বছর। ১৯৭৬ সালের ২২ নভেম্বর যাত্রা শুরু করে সংগঠনটি। সাফল্যের সেই উদ্‌যাপনে ২৩ নভেম্বর সংগঠনের পক্ষ থেকে আনন্দ আয়োজন অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনার সঙ্গে সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় সাজানো সেই অনুষ্ঠানে সংবর্ধনা দেওয়া হয় ছয় গুণীজনকে। আজীবন সম্মাননা জানানো হয় সাংবাদিক ও লেখক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে। সাহিত্য-সংস্কৃতিতে সম্মাননা পেয়েছেন ইমদাদুল হক মিলন। চলচ্চিত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সংবর্ধনা প্রদান করা হয়েছে কোহিনূর আক্তার সুচন্দাকে। এ ছাড়া সংগীত ও অভিনয় শাখায় সম্মাননা পেয়েছেন কুমার বিশ্বজিৎ ও মাহমুদ সাজ্জাদ।

২৩ নভেম্বর বিকেলে শিল্পকলা একাডেমির সংগীত ও নৃত্যকলা মিলনায়তনে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন তথ্যসচিব আবদুল মালেক ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ। সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি গণসংগীতশিল্পী ফকির আলমগীর।