এক গানেই তারকা, এরপর...

>একটি গান দিয়েই বাজিমাত। সবার মুখে মুখে, ফেসবুকে, ট্রলে আর মিমে, কথায় কথায়, উপমায়, হাসি-ঠাট্টায়, রূপকে উঠে আসে সেসব ভাইরাল গানের পঙ্‌ক্তি। গানটি থেকে যায় শ্রোতার মনে, কিন্তু গানের শিল্পীদের হয়তো চেনে না অনেকেই। আজ তেমনই কয়েকজন ‘ভাইরাল’ শিল্পীর ‘ভাইরাল’ গান নিয়ে এ আয়োজন। লিখেছেন মনজুরুল আলম
গুরুপদ গুপ্ত
গুরুপদ গুপ্ত

এট্টা মুক তো কতা কম কবা : গুরুপদ গুপ্ত

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে ‘এট্টা মুক তো কতা কম কবা’ গানটি। একই শিল্পীর ‘বয়স আমার বেশি না ওরে টুকটুকির মা, খালি চুল কয়ডা পাইহে গেছে বাতাসে...’ গানটাও এরপর ঘুরেছে ফেসবুক-ইউটিউবে। কিন্তু শিল্পীর নাম কয়জনই-বা মনে রেখেছেন? এই শিল্পীর উদয় কিন্তু হঠাৎ করেই হয়নি। গুরুপদ গুপ্ত ছিলেন খুলনা বেতারের আঞ্চলিক শিল্পী। এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে তিনি হয়ে গেছেন ভাইরাল শিল্পী!

খুলনা-যশোর অঞ্চলে গুরুপদ গুপ্ত একজন গীতিকার, সুরকার ও দোতরাবাদক হিসেবে পরিচিত। খুলনা, যশোর ও নড়াইল অঞ্চলের ভাষায় তিনি লিখেছেন তিন শতাধিক জীবনভিত্তিক আঞ্চলিক গান। পাশাপাশি জারি-সারি, ভাটিয়ালি, অষ্টক, কীর্তন, লোকগীতি, পল্লিগীতিসহ অন্যান্য গানও লিখেছেন। সেটার সংখ্যাও হবে তিন শতাধিক। খুলনা, নড়াইল, যশোর অঞ্চল ছাড়িয়ে এ শিল্পীর পরিচিতি সবখানে ছড়িয়ে যাওয়ার পরও মাটির এই শিল্পী আছেন মাটির কাছাকাছিই। গান নিয়ে তিনি বললেন, ‘গান লিখি, গাই, নানান বাদ্যযন্ত্র বানাই। বেশি দূর লেখাপড়া শিখতে পারিনি। ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়া। তাই এখন বেশি বেশি বই পড়ার চেষ্টায় থাকি। মানুষের জন্য আরও গান রেখে যেতে চাই। গান শুনে মানুষ হাসবে, কাঁদবে। আমার লেখা সব গান নিয়ে বই বের করতে পারলে ভালো হতো।’

আরমান আলিফ
আরমান আলিফ

অপরাধী : আরমান আলিফ
২০১৮ সালের ২৬ এপ্রিল ঈগল মিউজিকের ইউটিউব চ্যানেলে ছাড়া হয় আরমান আলিফের গান ‘অপরাধী’। এরপর রীতিমতো ঝড় উঠে যায়। ইউটিউব গ্লোবাল র‌্যাংঙ্কিংয়ে ‘অপরাধী’ গানটি স্থান করে নেয়। ১৮ বছরের তরুণ গায়ক আরমান আলিফের জীবন রাতারাতি বদলে যায়। এখন পর্যন্ত গানটি ইউটিউবে দেখা হয়েছে ২৫ কোটির বেশিবার।

একটি গানই আরমান আলিফকে ভক্তদের কাছে ‘অপরাধী আরমান’ নামে পরিচিত করে তুলেছে। এরপর আরমান আলিফের ২০টির বেশি গান অনলাইনে মুক্তি পেয়েছে, কিন্তু কোনোটিই অপরাধীর মাইলফলক আর ছুঁতে পারেনি। তবে ভাগ্য বদলে গেছে এই শিল্পীর। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আরমানের এখন ব্যাপক চাহিদা। অপরাধীর খ্যাতির কারণে প্রতিদিন নতুন নতুন জায়গায় মঞ্চে গান করার প্রস্তাব আসে। আগামী ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসের অর্ধেকের বেশি দিন আরমান মঞ্চে গান গেয়ে কাটাবেন। বছরের অন্য সময় প্রতি মাসেই প্রায় চার-পাঁচটি করে স্টেজ শো করেন তিনি। আরমান আলিফ বলেন, ‘অপরাধী আমার ভাগ্য বদলে দিয়েছে। এমন অকল্পনীয় সাড়া পাওয়া তো আর দ্বিতীয়বার সম্ভব নয়। কোন গান কখন শ্রোতা গ্রহণ করে, এটা কখনোই বলা যায় না।’

ইমন খান
ইমন খান

আজও প্রতি রাত জেগে থাকি তোমার আশায় : ইমন খান
এই গান নিয়ে অনেক মিম তৈরি হয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ গান নিয়ে হয় আলাপ-আলোচনা। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন শহর ও গ্রামাঞ্চলের শ্রোতাদের কাছে এই গান ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। কিন্তু এই শিল্পীর নাম কখনো কোথাও উঠে আসেনি। এই গানের গায়ক সিরাজগঞ্জের অজপাড়াগাঁয়ের ছেলে ইমন খান। তখন তাঁর বয়স ২০ বছর। চারটি অডিও অ্যালবাম বের করে কোনো সাফল্য আসেনি। ব্যক্তিগত উদ্যোগে ২০০৭ সালের শেষের দিকে ১২টি গান নিয়ে ইমন বের করেন ৫ নম্বর অডিও অ্যালবাম কেউ বোঝে না মনের ব্যথা সেই অ্যালবামেই ছিল ‘আজও প্রতি রাত জেগে থাকি তোমার আশায়’ গানটি। রাতারাতি আলোচনায় উঠে আসে গানটি। ২০০৮ সালে ইমন খানের এই অ্যালবামের মোট ১৫ লাখ কপি বিক্রি হয়।

‘আজও প্রতি রাত জেগে থাকি তোমার আশায়’ গানটি ইমন খানের ব্যস্ততা বহু গুণে বাড়িয়ে দেয়। ইমন বলেন, ‘এটা ভাগ্য। আমি কখনো কল্পনাই করিনি এই গানটা মানুষ এত পছন্দ করবে।’ এই গানের পর ইমন খান দেশ ও দেশের বাইরেও স্টেজ শো করা শুরু করেন। এরপর ইমন আরও সাড়ে চার শ গান করেছেন। কিন্তু ওই এক গানই ইমনকে তারকা বানিয়ে দিয়েছে। এরপর আর কোনো গান দিয়েই সাড়া ফেলতে পারেননি তিনি। তবে ওই গানের কারণে ইমন এখনো প্রতি মাসে চার-পাঁচটি করে অনুষ্ঠান করেন।

প্রমিত কুমার। ছবি: সংগৃহীত
প্রমিত কুমার। ছবি: সংগৃহীত

ও টুনির মা তোমার টুনি কথা শোনে না : প্রমিত কুমার
নরসিংদীর পলাশ থানার পণ্ডিতপাড়া গ্রামে বসে এই গান লেখেন প্রমিত কুমার। তিন দিন লাগে গানটি শেষ করতে। এরপর ঢাকায় রেকর্ডিং করাতে এলে স্টুডিও থেকে সবাই বলতে থাকেন, ‘না না, এই রকম গান চলবে না, এটা কোনো গান হলো?’ শুনে মন খারাপ হয় প্রমিতের। ইচ্ছা ছিল পঞ্চম অ্যালবামের নাম দেবেন ‘টুনির মা’। কিন্তু অডিও প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান সেই নাম বাদ দিয়ে রাখে বউ আমার চেয়ারম্যান।এই নাম নিয়েই প্রমিতের স্বপ্নের প্রথম অ্যালবাম তাঁর হাত আসে। অল্প সময়ের মধ্যেই ‘ও টুনির মা’ গানটি অনেকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। গানটি জনপ্রিয় হওয়ার পর মঞ্চে গান গাওয়ার জন্য প্রমিতের ডাক আসে ভারত থেকে। নিজের প্রথম ভারত সফরেই প্রমিত টানা ৩০টি স্টেজ শো করেন। প্রমিত কুমার বলেন, ‘গানটি আমাকে ২০০৯ সাল থেকে এখনো অনেক কিছু দিয়ে যাচ্ছে। এতটা আমি কখনো প্রত্যাশা করিনি।’ প্রমিত এখন প্রতি কনসার্ট মৌসুমে (শীতের সময়) ১৫টির বেশি স্টেজ শো করেন। আর বছরের অন্যান্য সময় প্রতি মাসে দুই থেকে পাঁচটি অনুষ্ঠানে গান করেন। আরও ১৫টি অ্যালবাম আছে প্রমিতের। কিন্তু সবাই তাঁকে ওই এক ‘টুনির মা’ গান দিয়েই চেনেন।

মতিন চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত
মতিন চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত

টিকাটুলীর মোড়ে একটা অভিসার হল রয়েছে : মতিন চৌধুরী
এই গানের ব্যাপারে জানার জন্য ফোনে যোগাযোগ করা হয় শিল্পী মতিন চৌধুরীর সঙ্গে। শুরুতেই তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন। কারণ, সচরাচর এই শিল্পীর কাছে কেউ এই গানের কথা জানতে চান না। কারণ, অনেকে জানেনই না যে সবার মুখে মুখে ঘোরা এই গান ঢাকার শাহজাদপুরের বাসিন্দা মতিন চৌধুরীর লেখা। ২০০৫ সালে এই গান তৈরি করা হয়। কিন্তু সেবার গানটি মুক্তি দিতে পারেননি তিনি। অনেক বছরের চেষ্টার পর ২০১০ সালে মতিন চৌধুরী বের করেন তাঁর প্রথম অ্যালবাম জীবন হলো সিগারেটের ছাই।ওই অ্যালবামে “টিকাটুলীর মোড়ে” গানটি রাখেন তিনি। এই একটি গান মতিন চৌধুরীর ব্যস্ততা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। তিনি বলেন, ‘টিকাটুলীর মোড় গানটি সবার মুখে মুখে ঘোরে, এটাই বড় পাওয়া। তবে গানটিকে যখন অনেকে মজা হিসেবে কিংবা উপহাস করে গায়, তখন একটু খারাপ লাগে। সব গানের পেছনেই মেধা ও পরিশ্রম থাকে।’

মতিন চৌধুরী তারকা শিল্পী নন, তবে এই গানের কারণে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নিয়মিত অনুষ্ঠান করে যাচ্ছেন তিনি।