নাটকের অন্যতম চালিকাশক্তি দলবদ্ধ সংগ্রাম

গ্রুপ থিয়েটার দিবসে শোভাযাত্রা বের করেন শিল্পীরা। ছবি: প্রথম আলো
গ্রুপ থিয়েটার দিবসে শোভাযাত্রা বের করেন শিল্পীরা। ছবি: প্রথম আলো

১৯৮০ সালের ২৯ নভেম্বর বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন প্রতিষ্ঠা হয়। প্রথমবার সভাপতিমণ্ডলীর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন রামেন্দু মজুমদার এবং সেক্রেটারি জেনারেল নাসির উদ্দীন ইউসুফ। বর্তমানে এ সংগঠনে সারা দেশের তিন শোরও বেশি দল যুক্ত আছে। বিগত দিনে নাট্য সংগঠনগুলোও নিজস্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়েছে। নতুন নতুন নাট্যদল গড়ে উঠছে তাদেরই সচেতন প্রয়াসে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সঙ্গেও যোগাযোগ বেড়েছে।

শুক্রবার ৩৯ বছরে পদার্পণ করেছে সংগঠনটি। নানা কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে দিনটি উদ্‌যাপন করেন মঞ্চ নাটকের শিল্পীরা। ‘অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে সংস্কৃতি’ স্লোগান নিয়ে গ্রুপ থিয়েটার দিবসে উদ্‌যাপন শুরু হয় সেমিনারে আলোচনার মধ্য দিয়ে। শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার সেমিনার কক্ষে ‘গ্রুপ থিয়েটার চর্চা ও আগামীর থিয়েটার’ শীর্ষক স্মারক বক্তৃতা করেন অধ্যাপক আবদুস সেলিম। সংলাপ ও অভিনয় নাটককে বর্তমান বিশ্বজুড়ে বেশ চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। কিন্তু এমন নাটক কখনোই বিলীন হবে না বা হতে দেওয়া উচিত হবে না। তবে নিরীক্ষা তো থাকবেই। থিয়েটার আসলে গ্লোবাল, সে জন্য বৈশ্বিক পরিবর্তনের ঝাঁজ আমাদের মঞ্চেও লাগবে। এমনটাই ছিল তাঁর বক্তব্যের মূলভাব।

অধ্যাপক আবদুস সেলিম বলেন, বাংলাদেশের নাটকের অন্যতম চালিকাশক্তি দলবদ্ধ সংগ্রাম ও সচেতনতা। বাংলাদেশের গল্পবলা নাটকের কখনো মৃত্যু হবে না। কারণ ঐতিহ্যগতভাবে আমরা গল্প শোনার জাতি। তার ওপর দীর্ঘ ইংরেজ ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির আবেসে আমাদের নাট্যবিষয়ক ধারণাগুলো সনাতনী রয়ে গেছে এবং থাকবে। তিনি বলেন, পঁচাত্তর পরবর্তী প্রতিকূল পরিবেশেও দেশের নাট্যচর্চা থেমে ছিল না। এ ভূখণ্ডের নাট্যচর্চার ইতিহাস স্বাধীনতার পর আরও বেগবান হয়েছিল। সামরিক শাসনের পাঁচ বছরের মাথায় গ্রুপ থিয়েটারের একটি নির্দিষ্ট প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। যার পথ ধরে ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন প্রতিষ্ঠিত হয়।

গ্রুপ থিয়েটার দিবসে নন্দন মঞ্চের পরিবেশনা। ছবি: প্রথম আলো
গ্রুপ থিয়েটার দিবসে নন্দন মঞ্চের পরিবেশনা। ছবি: প্রথম আলো

আগামী দিনের নাটক প্রসঙ্গে আবদুস সেলিম বলেন, ‘আগামীর নাটকে বৈশ্বিক পরিবর্তনের ভবিষ্যদ্বাণী হলো নাটকের যা কিছু আদি সংজ্ঞা আছে, তার সলিলসমাধি অনিবার্য। তবে আমাদের গ্রুপ থিয়েটার চর্চায় তেমনটি এখনো লক্ষ্য করা যায়নি। তবে পরিবর্তনের আভাস স্পষ্ট। বিশেষ করে গত ২০ বছরে আমাদের নাটকে স্বভাব বৈশিষ্ট্যের প্রতুলতা লক্ষ্য করা গেছে। ফলে নাটকের একরৈখিকতার বদলে বহুরৈখিক বিমূর্তন আমাদের মঞ্চে দেখা গেছে। এগুলোর সবচেয়ে স্পষ্ট দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা (এনএসডি) এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যতত্ত্বে শিক্ষাপ্রাপ্ত মানুষের ভেতর। যার প্রভাব পড়েছে বর্তমান তরুণ নাট্যমোদীদের মধ্যে।’

অধ্যাপক সেলিম আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের নাটকের প্রেক্ষাপটে আগামীতে যে বিষয়গুলো প্রাধান্য পাবে বলে মনে করি, সেগুলো হলো— নারীবাদ বা সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অবস্থান, রাজনীতি, মৌলবাদ, পুরান-লোকগাথা, ক্ল্যাসিকের আধুনিক ব্যাখ্যা এবং অবশ্যই অনুবাদ ও রূপান্তর। তবে আমাদের নাটকের ধারাবাহিকতায় অতীতের মতো ভবিষ্যতেও গ্রুপ থিয়েটার চৈতন্য প্রণোদনার কাজ করবে যদিও পেশাদার নাট্যচর্চার স্থানও উন্মোচিত হবে। অনেকেই মনে করেন সরকারি প্রণোদনা অতি জরুরি। যদিও আমি মনে করি গ্রুপ থিয়েটার প্রণোদনাটি আমাদের অন্তর্গত ঐতিহ্যিক শক্তি।’

স্মারক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী লাকী, নাট্যজন ইনামুল হক, নাসিরউদ্দীন ইউসুফ, চন্দন রেজা, অভিজিৎ সেনগুপ্ত প্রমুখ। বেলা তিনটায় একাডেমির নন্দন মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বিকেল চারটায় ছিল গ্রুপ থিয়েটার দিবসের আলোচনা। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল কামাল বায়েজীদ। সভাপতিত্ব করেন ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নাট্যজন লিয়াকত আলী লাকী। বিকেল সাড়ে চারটায় ছিল গ্রুপ থিয়েটার দিবসের আনন্দ শোভাযাত্রা এবং সন্ধ্যায় মঞ্চশিল্পীদের মিলনমেলা, আড্ডা ও গানের অনুষ্ঠান। বাউল শিল্পীদের সংগীত পরিবেশনার মাধ্যমে শেষ হয় গ্রুপ থিয়েটার দিবসের আয়োজন।