১৮ বছর পর নতুন নাটকে আসাদুজ্জামান নূর

নতুনের উৎসবের উদ্বোধনীতে মঞ্চস্থ ‘কালো জলের কাব্য’ নাটকের একটি দৃশ্য। শুক্রবার, জাতীয় নাট্যশালায়। ছবি: তানভীর আহাম্মেদ
নতুনের উৎসবের উদ্বোধনীতে মঞ্চস্থ ‘কালো জলের কাব্য’ নাটকের একটি দৃশ্য। শুক্রবার, জাতীয় নাট্যশালায়। ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

উৎসবের আগে আয়োজকেরা বলেছিলেন, আড়ম্বরশূন্য। কিন্তু গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির প্রাঙ্গণে গিয়ে প্রথমেই একটা প্রশ্ন মাথায় এসেছে, আড়ম্বরের আর বাকি আছে কী? হইচই, সাজসজ্জা সবই ছিল। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় বলে কথা!

১৯৭৩ সালে প্রথমবার বাংলাদেশে দর্শনীর বিনিময়ে নিয়মিত নাটক মঞ্চায়নের মাধ্যমে ইতিহাস সৃষ্টি করে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়। ৪৬ বছর পর গতকাল আবারও ইতিহাস সৃষ্টি করল দলটি। সাতটি নতুন নাটক নিয়ে সাত দিনের উৎসব শুরু করেছে তারা। এখানে প্রতিটি নাটকেরই প্রথম প্রদর্শনী হচ্ছে। ‘আয় নাটকের অঙ্গনে’ স্লোগানে উৎসবের শিরোনাম ‘নতুনের উৎসব ২০১৯ ’।

এত দিন যেমনটি চলে আসছিল, নাটকের উৎসব মানেই দেশের নামী দলগুলোর সমকালীন নাটকের সমাহার। এর বাইরে আমন্ত্রণ জানানো হয় দেশের বাইরে বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার দু-একটি দলকে। কালকের উৎসবটি তাই নতুন ধারণা নিয়ে এসেছে। আর এ ব্যতিক্রম উৎসবে শুরুর দিনের বড় চমক, খ্যাতিমান অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর। গতকাল পান্থ শাহরিয়ারের রচনা এবং নির্দেশনায় নাগরিকের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত ‘কালো জলের কাব্য’ নাটকের উদ্বোধন করা হয়। উইলিয়াম শেক্‌সপিয়ারের ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’-এর এ দেশের প্রেক্ষাপটে নিজস্ব আঙ্গিকে রূপায়ণ। নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন আসাদুজ্জামান নূর। দীর্ঘ ১৮ বছর পর তাঁকে দেখা গেল নতুন মঞ্চনাটকে। তিনি সবশেষ অভিনয় করেছিলেন ‘মুখোশ’ নাটকে, ২০০১ সালে। আছেন অপি করিমের মতো উজ্জ্বল তারকাও।

নতুনের উৎসবের উদ্বোধনীতে মঞ্চস্থ ‘কালো জলের কাব্য’ নাটকের একটি দৃশ্য। শুক্রবার, জাতীয় নাট্যশালায়। ছবি: তানভীর আহাম্মেদ
নতুনের উৎসবের উদ্বোধনীতে মঞ্চস্থ ‘কালো জলের কাব্য’ নাটকের একটি দৃশ্য। শুক্রবার, জাতীয় নাট্যশালায়। ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

সন্ধ্যার পরপর জাতীয় নাট্যশালার মঞ্চে অতিথিদের ডাকেন সঞ্চালক ফারহানা মিঠু। ছোট পরিসরে আলোচনা। সেখানে উৎসবের প্রয়োজনীয়তা, মঞ্চ নাটকের বর্তমান অবস্থা, নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের ইতিহাস ও পথচলার নানা দিক উঠে আসে আলোচনায়। উদ্বোধক প্রধান অতিথি সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদের বক্তব্যে আর্থিকভাবে অসচ্ছল শিল্পীদের ভাতার প্রসঙ্গটি উঠে আসে। তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ের আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে ভাতার পরিমাণ ও সুবিধাভোগীর সংখ্যা বর্তমানে সীমিত রয়েছে। অতি দ্রুত অসচ্ছল শিল্পীদের ভাতার পরিমাণ ও সংখ্যা দুটোই বাড়ানো হবে। তবে ভাতা যাতে প্রকৃত অসচ্ছল শিল্পীরা পান, এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে। তিনি এ বিষয়ে বিভিন্ন শিল্পী সংগঠনের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা কামনা করেন।

বাংলাদেশের নব নাট্যচর্চার ইতিহাসে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় গুরুত্বপূর্ণ নাম, এমন মন্তব্য করে বিশ্ব আইটিআইয়ের সাম্মানিক সভাপতি রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘দলটি উল্লেখযোগ্য বিদেশি নাট্যকারদের কাজের সঙ্গে আমাদের দর্শকদের প্রথমবারের মতো পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।’ রামেন্দু মজুমদার নাগরিকের এই উৎসবের বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করে বলেন, উৎসবের মধ্যে নতুনত্ব না থাকলে মনে সেটা দাগ কাটে না। নাগরিকের নতুনের উৎসব নাট্যাঙ্গনে সুবাতাস ছড়াবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।

নতুনের উৎসবকে সময়োপযোগী পদক্ষেপ উল্লেখ করে নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, ‘থিয়েটার বেঁচে থাকে নতুনের হাতে। সময়ের সঙ্গে বদলে যায় সমাজ। সমাজের সঙ্গে বদলে যায় জীবন। সব নাটক নয়, কোনো কোনো নাটক অনাদিকাল বেঁচে থাকে। তবে ভালো নাটকের চেষ্টাটা করতে হবে।’

আতাউর রহমান বলেন, মঞ্চনাটক শুধু বিনোদন নয়, এটা গণশিক্ষার মাধ্যম। মঞ্চ সত্য কথা বলে। মঞ্চ সর্ববিদ্যার আধার। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের ইতিহাস টেনে তিনি বলেন, দলটি অলিখিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। পড়াশোনার জায়গা হয়ে গিয়েছিল। আজ নতুনের যে উৎসব হচ্ছে, সেখান থেকেও ভালো কিছু অর্জিত হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

প্রদীপ প্রজ্বালনের মাধ্যমে উৎসবের সূচনা করা হয়। গতকাল রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমিতে। ছবি: প্রথম আলো
প্রদীপ প্রজ্বালনের মাধ্যমে উৎসবের সূচনা করা হয়। গতকাল রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমিতে। ছবি: প্রথম আলো

স্বাগত বক্তব্যে উৎসব সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরেন আয়োজক দলের সহসভাপতি সারা যাকের। তিনি বলেন, ‘গত বছর দলের ৫০ বছর পূর্তি করে নাগরিক। সেই সঙ্গে দর্শনীর বিনিময়ে নাটক মঞ্চায়নের ৪৫ বছর উদযাপন করে। এরই অংশ হিসেবে এবার নাটককে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্য নিয়ে আয়োজন করা হয়েছে নতুনের উৎসব ২০১৯। এর মূল লক্ষ্য মঞ্চে মানসম্পন্ন নতুন নাটক নিয়ে আসা। প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ নির্দেশকদের কাজের সুযোগ করে দেওয়া। আমাদের আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে তরুণ নির্দেশকদের কাছ থেকে অনেক নাটকের প্রস্তাব এসেছিল। সেখান থেকে জুরি বোর্ডের মাধ্যমে ভালো ভালো নাটক বেছে নেওয়া হয়েছে।’ ভবিষ্যতে একই উৎসব আয়োজনের ইচ্ছার কথাও জানান মঞ্চের এই খ্যাতিমান অভিনেত্রী।

পেছনে নাটকের মঞ্চ তৈরি। সামনে আলোচনা। বিদগ্ধজনেরা মঞ্চে ছিলেন বটে, তবে উৎসবের প্রদীপ জ্বালানোয় নেতৃত্ব দেন নতুন প্রজন্মের প্রতিশ্রুতিশীল ছয় নারী সংস্কৃতিসেবী—বন্যা মির্জা, সামিনা লুৎফা নিত্রা, হৃদি হক, তনিমা হামিদ, সাধনা আহমেদ ও আইরিন পারভীন লোপা।

প্রদীপ জ্বালানোয় নেতৃত্ব দেন নতুন প্রজন্মের প্রতিশ্রুতিশীল ছয় নারী—সংস্কৃতিসেবী বন্যা মির্জা, সামিনা লুৎফা নিত্রা, সাধনা আহমেদ, হৃদি হক, তনিমা হামিদ ও আইরিন পারভীন লোপা। ছবি: প্রথম আলো
প্রদীপ জ্বালানোয় নেতৃত্ব দেন নতুন প্রজন্মের প্রতিশ্রুতিশীল ছয় নারী—সংস্কৃতিসেবী বন্যা মির্জা, সামিনা লুৎফা নিত্রা, সাধনা আহমেদ, হৃদি হক, তনিমা হামিদ ও আইরিন পারভীন লোপা। ছবি: প্রথম আলো

দর্শক অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন নাটক দেখার জন্য। ঠিক সন্ধ্যা সাতটায় দর্শকের অপেক্ষার অবসান হলো বাঁশির সুরে। পর্দা নামতেই চোখ ধাঁধানো মঞ্চ। শুরু হলো নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের ৪৭ তম প্রযোজনা। মিলনায়তন-ভর্তি দর্শক সাক্ষী থাকলেন ‘কালো জলের কাব্য’ নাটকের প্রথম প্রদর্শনীতে। নির্দেশনা দিয়েছেন পান্থ শাহরিয়ার।
নাটকে ‘শাইলক’ চরিত্রে অভিনয় করেছেন আসাদুজ্জামান নূর। জাহাজঘাটে ভাঙারি কেনাবেচা করে জীবিকা নির্বাহ করেন এমন একটি চরিত্র। নাটকে জাহাজভাঙা শিল্পে শ্রমিকের জীবনের হাসি-কান্না-দুঃখ-ভালোবাসার নিয়ন্ত্রণ যেন আসাদুজ্জামান নূর ‘ভাঙারি’র হাতে। নাটক দেখতে দেখতে নির্দেশক পান্থ শাহরিয়ারের কথাটি মনে পড়ে গেল, তিনি বলেছিলেন, ‘“মার্চেন্ট অব ভেনিস”-এর ছায়া অবলম্বনে হলেও শেক্‌সপিয়ারের “মার্চেন্ট অব ভেনিস” নয় “কালো জলের কাব্য”। গল্পটা আমাদের, একান্তই আমাদের।’

উৎসবে আজ শনিবার মঞ্চস্থ হবে সুনামগঞ্জের বন্ধন থিয়েটার ও প্রসেনিয়াম থিয়েটারের যৌথ নির্মাণ ‘রাধারমণ’। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
উৎসবে আজ শনিবার মঞ্চস্থ হবে সুনামগঞ্জের বন্ধন থিয়েটার ও প্রসেনিয়াম থিয়েটারের যৌথ নির্মাণ ‘রাধারমণ’। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

উৎসবে আজ শনিবার মঞ্চস্থ হবে শামীম সাগর নির্দেশিত সুনামগঞ্জের বন্ধন থিয়েটার ও প্রসেনিয়াম থিয়েটারের যৌথ নির্মাণ ‘রাধারমণ’। আগামীকাল রোববার মঞ্চস্থ হবে রতন সিদ্দিকী রচিত ও হৃদি হক নির্দেশিত নাগরিক নাট্যাঙ্গন প্রযোজনা ‘আকাসে ফুইটেছে ফুল-লেটো কাহন’। সোমবার প্রদর্শিত হবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত ও সাইদুর রহমান লিপন নির্দেশিত নাটক ‘অরূপ রতন’। মঙ্গলবার মঞ্চস্থ হবে প্রাচ্যনাটের ‘খোয়াবনামা’। আফ্রিকান গল্প অবলম্বনে শুভাশিস সিনহার নির্দেশনায় বুধবার মঞ্চস্থ হবে মণিপুরি থিয়েটারের নাটক ‘ও মনপাহিয়া’। সমাপনী দিন মঞ্চস্থ হবে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিল্পীদের অভিনীত নাটক ‘লটারি’। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় প্রযোজনা। নির্দেশনা দিয়েছেন মোস্তাফিজ শাহীন। নাটকটির নির্দেশনা উপদেষ্টা সারা যাকের।

বৃহস্পতিবার উৎসবের সমাপনী দিন। এদিন চার জ্যেষ্ঠ নাট্যব্যক্তিত্ব ফেরদৌসী মজুমদার, জ্যোৎস্না বিশ্বাস, লাকী ইনাম ও শিমূল ইউসুফকে সম্মাননা জানানো হবে।