মনে পড়ে গেল সেই অনুষ্ঠানের কথা

মুক্তিযোদ্ধা, সাংসদ ও চিত্রনায়ক ফারুকের সঙ্গে কাওসার চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত
মুক্তিযোদ্ধা, সাংসদ ও চিত্রনায়ক ফারুকের সঙ্গে কাওসার চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত

গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটার দিকে আমার মামাতো ভাই মাহতাবের ফোনে দিবানিদ্রা ভেঙে গেল। ওর স্বভাব অনুযায়ী গলার স্বরটি সর্বোচ্চ গ্রামে চড়িয়ে খুব দ্রুত জিজ্ঞেস করল, আমি এখন কোথায় আছি, কী করছি! একটু ভড়কে গেলাম ওর টেনশন জড়ানো কণ্ঠ আর প্রশ্ন শুনে। আজকাল তো চারদিকে প্রিয়জনদের চলে যাওয়ার খবর পাচ্ছি কেবল। ভাবলাম, সে রকম কোনো দুঃসংবাদ দেবে নাকি আবার! কিন্তু না, মিষ্টি হেসে বলল, ‘মাইটিভিতে আপনার উপস্থাপনায় একটি অনুষ্ঠান দেখাচ্ছে। সঙ্গে আছেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। গানও হচ্ছে। বাসায় থাকলে টিভি চালিয়ে দেখুন।’ আমি ওকে ধন্যবাদ জানিয়ে আলাপ সমাপ্ত করি।

শীতের ওম লাগা সন্ধ্যায়, দিবানিদ্রা ছেড়ে টেলিভিশনের পর্দায় নিজের মুখ দেখার আগ্রহ খুব একটা অনুভব করলাম না ভেতর থেকে। নিজের ভিলেন মার্কা মুখ (কেউ কেউ বলে থাকেন) দেখার আগ্রহ-প্যারামিটারের নিচের দাগে অবস্থান করছিল। কিন্তু সেদিনের সেই অনুষ্ঠানে আমার অতিথি ছিলেন দেশের কিংবদন্তিসম গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার। সর্বোপরি আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার— বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান, এর সম্মান আর মাহাত্মই আলাদা। গায়ের চাদর এক টানে সরিয়ে লিভিং রুমে টিভি সেটের সামনে এসে বসার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ গেল চলে। ফিরে আসে মিনিট পাঁচেক পর। এর মধ্যে টিভির পর্দা দখল করে নিয়েছে রকমারি বিজ্ঞাপন।

এই অনুষ্ঠানের শুরুর দিকের কাহিনি একটু বলে রাখি। সময়টা সম্ভবত ২০১৬ অথবা ২০১৭ সাল হতে পারে। মাইটিভির বিজয় দিবসের জন্য ১৬টি অনুষ্ঠান আমি উপস্থাপনা করেছিলাম। সেই বছরে তো বটেই, এর পরের বছরগুলোতেও তারা ডিসেম্বরের ১ থেকে ১৬ তারিখ পর্যন্ত সেই ষোলোটি অনুষ্ঠান পুনঃপ্রচার করে।

যত দূর মনে পড়ে, ‘ফিরে ফিরে আসে’ শিরোনামের সেই অনুষ্ঠানের ব্যাপ্তি ছিল ৪০ মিনিটের মতো। প্রতিটি অনুষ্ঠানে দেশের প্রথিতযশা একজন ব্যক্তি উপস্থিত থাকতেন কথা বলার জন্য, যিনি অবশ্যই একজন মুক্তিযোদ্ধা কিংবা মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। সঙ্গে থাকতেন এই প্রজন্মের একজন সংগীতশিল্পী, যিনি সেই অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের গান এবং দেশের গান পরিবেশন করেছেন। অনুষ্ঠানের অতিথিদের মধ্যে যাঁদের নাম এই মুহূর্তে স্মরণ করতে পারছি তাঁরা হলেন লেখিকা সেলিনা হোসেন, নাট্যকার নির্দেশক ও অভিনেতা মামুনুর রশীদ, অভিনেতা নির্দেশক তারিক আনাম খান, গণসংগীতশিল্পী ফকির আলমগীর, চিত্রনায়ক ফারুক, নাট্যজন ম হামিদ, সংবাদব্যক্তিত্ব হারুন হাবিব, শহীদের সন্তান তৌহীদ রেজা নূর, মেঘনা গুহঠাকুরতা, জাহিদ সুমন (প্রয়াত), একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর—যিনি খুলনার শিরোমণির যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। শিরোমণির যুদ্ধে অংশ নেওয়া মেজর সাহেবের নাম এবং যাঁদের নাম এই মুহূর্তে স্মরণ করতে পারলাম না, তাঁদের কাছে জোড় হাতে ক্ষমা চাইছি।

ফিরে আসি গতকালের অনুষ্ঠানে। বিজ্ঞাপন বিরতির পর অনুষ্ঠান শুরু হলো পুনরায়। এই পর্বে গাজী ভাইয়ের ‘একতারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল’ গানটির বাণী এবং এই গানের জন্মের কথা নিয়ে আলাপ করছিলাম ওনার সঙ্গে। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, দেশের কথা বলার দায়িত্ব শুধু ‘একতারার’ ওপরেই ছেড়ে দিয়েছিলেন কেন? গাজী ভাই বললেন, স্বাধীনতার পরপরই এই গান রচনা করেন তিনি। স্বাধীনতা–পরবর্তী সময়ে কারও কারও সঙ্গে অনেক ভুল–বোঝাবুঝি, অনেক মান–অভিমান, অনেক অনুযোগ——এসব নিয়ে মনের মাঝে জমে থাকা অনেক আবেগকে কেন্দ্র করে গানটির রচনা। এরপর আরও অনেক কথা, সে অনেক আবেগভরা কাহিনি। এসব ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধকালে, তার পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সময়ের কয়েকটি গান (দেশের গান) নিয়েও অনেক কথা হলো।

এর আরও কিছুক্ষণ পরে, আলাপ শেষে ওনার লেখা বিখ্যাত সেই ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ গানের বাণীর উদ্ধৃতি দিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টেনেছিলাম।

১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ১৬টি অনুষ্ঠান আবারও দেখানো হবে। মাইটিভিতে প্রতিদিন সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটায় ‘ফিরে ফিরে আসে’ অনুষ্ঠানটি শুরু হয়। হাতে যথেষ্ট সময় থাকলে আপনারাও দেখতে পারেন অনুষ্ঠানগুলো।