'বাংলা একাডেমি আজ এক আলোকবৃক্ষের নাম'

শা‌ন্তির প্রতীক পায়রা ও বেলুন উড়িয়ে ৬৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর উদ্বোধন ঘোষণা করেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।  ছবি: প্রথম আলো
শা‌ন্তির প্রতীক পায়রা ও বেলুন উড়িয়ে ৬৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর উদ্বোধন ঘোষণা করেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। ছবি: প্রথম আলো

মাতৃভাষা আন্দোলনের গৌরবকে মহত্তম তাৎপর্যে তুলে ধরে বাংলা ভাষার সার্বিক পরিচর্যার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলা একাডেমি। এই প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির মাধ্যমে ঐতিহ্যভিত্তিক একটি নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল সৃষ্টি হয়। একাডেমির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু ১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর। সেদিন বর্ধমান হাউসের বটতলায় তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার বাংলা একাডেমির উদ্বোধন করেছিলেন। জাতির আবেগ, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত এ প্রতিষ্ঠান নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সেই উদ্দেশ্যে কাজ করে চলেছে। আজ ৩ ডিসেম্বর ছিল এ প্রতিষ্ঠানের ৬৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। দিনব্যাপী নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিনটি উদ্‌যাপন করা হয়।

সকালে একাডেমি প্রাঙ্গণে সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে দিনের কর্মসূচি শুরু হয়। জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন একাডেমির সভাপতি আনিসুজ্জামান, বাংলা একাডেমির পতাকা উত্তোলন করেন মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী। শান্তির প্রতীক পায়রা ও বেলুন উড়িয়ে ৬৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর উদ্বোধন ঘোষণা করেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। এরপর মহান ভাষা আন্দোলনের অমর শহীদদের স্মৃতির প্রতি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এবং বাংলা একাডেমির স্বপ্নদ্রষ্টা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌র সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করা হয়।

বিকেল সাড়ে চারটায় একাডেমির রবীন্দ্রচত্বরে বসে আলোচনা পর্ব। এতে ‘বাংলা একাডেমি ও আমাদের সমাজ’ শীর্ষক বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী বক্তৃতা-২০১৯ দেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলা একাডেমির সচিব মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী। অনুষ্ঠানের শুরুতে আজ সকালে প্রয়াত ভাষাসংগ্রামী রওশন আরা বাচ্চুর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

সন্ধ্যায় আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সমবেত পরিবেশনা। ছবি: প্রথম আলো
সন্ধ্যায় আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সমবেত পরিবেশনা। ছবি: প্রথম আলো

একক বক্তা অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, বাংলা একাডেমির স্বপ্নদ্রষ্টা যদি কেউ হয়ে থাকেন, তিনি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌। মুক্তিযুদ্ধ থেকে প্রেরণা নিয়ে বাংলা একাডেমির পরিসর এখন সবদিক দিয়ে প্রশস্ত হয়েছে। প্রকাশনা একাডেমির একটা বড় কাজ। একাডেমি থেকে বহু ধরনের অভিধান প্রকাশিত হয়েছে এবং তার অধিকাংশই বিস্ময়করভাবে জনপ্রিয় হয়েছে। অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি থেকে সম্পাদিত বাংলা সাহিত্যকর্মের প্রকাশ এর আরেকটি কাজের দিক। লোকসংস্কৃতির নমুনা সংগ্রহ ও সম্পাদনায় একাডেমি বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছে। একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে গ্রন্থমেলা এখন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জীবনের অপরিহার্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠান সমাজকে সংস্কৃতিপ্রিয় হতে সাহায্য করে। সমাজেও সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসার একটা ক্ষেত্র থাকতে হবে, তবেই তার মধ্যে অবস্থিত প্রতিষ্ঠান থেকে সে গ্রহণ করতে সমর্থ হবে। বাংলা একাডেমি নিঃসঙ্গ দ্বীপের মতো নয়। সমাজে তার অবস্থান, সমাজেই তার ভিত্তি। সেই ভিত্তিটা যত শক্ত হয়, উভয়ের ততই মঙ্গল। পথচলায় কিছু নেতিবাচক দিকও তুলে ধরেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তাঁর মতে, এ প্রতিষ্ঠানের সংকীর্ণতার সবচেয়ে বড় উদাহরণ রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপনে অনীহা। পৃথিবীর সর্বত্র যখন এই অনুষ্ঠান সাড়ম্বরে পালিত হয়, তখন পাকিস্তান সরকারের ইঙ্গিতে বাংলা একাডেমি ছিল নিরুদ্যম। তবে বেশি দিন এই অবস্থায় বাংলা একাডেমিকে বেঁধে রাখা যায়নি।

হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলেন, ‘ছয় দশকের পরিক্রমায় বাংলা একাডেমি আজ এক আলোকবৃক্ষের নাম। বাংলা একাডেমিকে ঘিরে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা এতটাই বিপুল যে আমাদের সীমিত সাধ্যে তা তাৎক্ষণিকভাবে পূরণ করা সম্ভব নয়। তবু আমরা বাঙালির এই প্রাণের প্রতিষ্ঠানকে জাতির মনন-আকাঙ্ক্ষার উপযুক্ত করে গড়ে তোলার জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’ স্বাগত ভাষণে একাডেমির সচিব মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, বাংলা একাডেমি বাঙালি জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষ এবং সাংস্কৃতিক অগ্রসরমাণতার প্রতীক প্রতিষ্ঠান।

আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে স্মৃতিচারণায় অংশ নেন একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক, সচিব, পরিচালক ও উপপরিচালকবৃন্দ। ছবি: প্রথম আলো
আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে স্মৃতিচারণায় অংশ নেন একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক, সচিব, পরিচালক ও উপপরিচালকবৃন্দ। ছবি: প্রথম আলো

অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার, অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান, অধ্যাপক আনোয়ারুল করীম, উজবেকিস্তানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মসয়ুদ মান্নান, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেল প্রমুখ।

সন্ধ্যায় আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে স্মৃতিচারণা, সংবর্ধনা জ্ঞাপন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। স্মৃতিচারণায় অংশ নেন একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক, সচিব, পরিচালক ও উপপরিচালকবৃন্দ। সাবেক গুণীজনদের একাডেমি পরিবারের পক্ষে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। বাংলা একাডেমি জীবনের স্মৃতিচারণায় অংশ নেন একাডেমির বর্তমান সভাপতি অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, একাডেমির সাবেক সভাপতি ও মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ, সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, অধ্যাপক মনসুর মুসা, অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, অধ্যাপক আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ; সাবেক পরিচালক ফরহাদ খান, আবদুল হান্নান ঠাকুর, জাকিউল হক, নুরুল ইসলাম, এনায়েত করীম এবং সাবেক উপপরিচালক আনোয়ার হোসেন, আবদুল মজিদ, মুর্শিদুদ্দিন আহমেদ প্রমুখ।

দিনব্যাপী নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিনটি উদ্‌যাপন করা হয়। ছবি: প্রথম আলো
দিনব্যাপী নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিনটি উদ্‌যাপন করা হয়। ছবি: প্রথম আলো

সাংস্কৃতিক পর্বে বিতর্ক প্রতিযোগিতা, কবিতা আবৃত্তি এবং সংগীত পরিবেশনায় অংশ নেন বাংলা একাডেমির কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।