আলোহীনেরা দ্যুতি ছড়ালেন জাতীয় নাট্যশালায়

বৃহস্পতিবার লটারি নাটকের মঞ্চায়নের মধ্যে শেষ হয় নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের নতুনের উৎসব । ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
বৃহস্পতিবার লটারি নাটকের মঞ্চায়নের মধ্যে শেষ হয় নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের নতুনের উৎসব । ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

সাত দিনের নাট্য উৎসবের সর্বশ্রেষ্ঠ নাটক ‘লটারি’ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের নিয়ে অসাধারণ কাজ! বুকের পাটা বটে! অভিনন্দন মোস্তাফিজ শাহীন ভাই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এভাবেই নিজের অনুভূতি প্রকাশ করেন নাট্যকর্মী শামিমা আক্তার মুক্তা। আরেকজন প্রতিষ্ঠিত নাট্য নির্দেশক বাকার বকুল লিখেছেন, দৃষ্টিহীন মানেই অন্ধত্ব নয়, দারুণ ছিল ‘লটারি’।

গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে এমন মুগ্ধতা ছিল জাতীয় নাট্যশালায় কয়েক শ দর্শকের। এদিন সাতটি নতুন নাটক দেখার আনন্দ দিয়ে শেষ হলো নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের ‘নতুনের উৎসব’।

গতকাল শেষ দিন আলোয় ভরা ছিল উৎসব মঞ্চ। জাতীয় নাট্যশালায় আলো ছড়িয়েছেন তাঁরা, যাঁদের নিজের ভুবন আলোহীন। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী একদল শিল্পী দর্শকদের চমকে দিয়েছেন তাঁদের ‘লটারি’ নাটক দিয়ে। এটি ছিল উৎসবের ব্যতিক্রমী সংযোজন।

শেষ দিন চার গুণী শিল্পীকে সম্মাননা জানানো হয় নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের পক্ষে। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
শেষ দিন চার গুণী শিল্পীকে সম্মাননা জানানো হয় নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের পক্ষে। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

কাল শুরুতেই আলো ছড়ালেন মঞ্চে বছরের পর বছর অবদান রেখেছেন এমন চার মহীয়সী নারী—ফেরদৌসী মজুমদার, জ্যোৎস্না বিশ্বাস, লাকী ইনাম ও শিমূল ইউসুফ। সম্মাননা জানানো হয় এই চার গুণী শিল্পীকে। নাগরিকের সহসভাপতি আবুল হায়াতের সভাপতিত্বে এ সময় মঞ্চে ছিলেন নাট্যকার আবদুস সেলিম, নাট্যব্যক্তিত্ব তারিক আনাম খান, পান্থ শাহরিয়ার, ফারুক আহমেদ প্রমুখ।

নিজের ভালো লাগার অনুভূমি জানানোর পাশাপাশি সহযোদ্ধা আলী যাকেরকে মিলনায়তনে দেখতে না পাওয়ার কষ্টের কথাও জানালেন ফেরদৌসী মজুমদার। তাঁর আশা, রোগমুক্ত হয়ে আলী যাকের আবার মঞ্চে ফিরবেন। এত গুণী শিল্পীদের সঙ্গে সম্মাননা পেয়ে আনন্দ প্রকাশ করলেন জ্যোৎস্না বিশ্বাস। লাকী ইনাম বললেন, এই নাগরিকে তাঁর শেখা, পথচলা শুরু। গানের ভুবন থেকে নাটকের ভুবনে নিয়ে আসাতে ফেরদৌসী মজুমদার ও সারা যাকেরের অবদানের কথা স্মরণ করলেন শিমূল ইউসুফ। এ পর্বে মহিলা সমিতির বয়োবৃদ্ধ পরিচ্ছন্নতাকর্মী শেখ শামউদ্দিন সাজাহান এবং ক্যানসারে আক্রান্ত আবৃত্তিশিল্পী ফখরুল ইসলামকে এক লাখ টাকা করে অনুদান দেওয়া হয়।

লটারি নাটকে অভিনয়শিল্পীদের বেশির ভাগই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ছবি: প্রথম আলো
লটারি নাটকে অভিনয়শিল্পীদের বেশির ভাগই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ছবি: প্রথম আলো

সম্মাননা পর্বের পরের সময়টা ছিল শুধুই মুগ্ধতার। মঞ্চে দেখা যায়, স্ত্রী আর এক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে শহরের নিম্ন মধ্যবিত্ত মাহবুব হোসেনের টানাপোড়েনের সংসার। একদিন ভুলবশত অন্য এক ছেলেকে অপহরণ করতে গিয়ে মাহবুবের ছেলে মাহতাবকে অপহরণ করে ছিঁচকে অপহরণকারীর দল। এ নিয়েই এগিয়ে যায় নাটক। ‘লটারি’ নাটকে রূপকভাবে হাস্যরসাত্মক ভঙ্গিমায় সমাজের নানা অসংগতি তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে দৃষ্টিহীন শিল্পীরা দৃষ্টিহীনতাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন মঞ্চের বাইরে।

দর্শক আক্ষরিক অর্থেই মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখেন এই আলোহীন মানুষগুলোর পরিবেশনা। নাটকটি প্রযোজনা করেছে মঙ্গলদীপ ফাউন্ডেশন। এ নাটকে অভিনয়শিল্পীদের বেশির ভাগই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

দৃষ্টিহীন শিল্পীরা দৃষ্টিহীনতাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন মঞ্চের বাইরে। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
দৃষ্টিহীন শিল্পীরা দৃষ্টিহীনতাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন মঞ্চের বাইরে। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

গত ২৯ নভেম্বর শুরু হয় নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের আয়োজনে ‘নতুনের উৎসব’। উৎসব উদ্বোধন করেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, নাসির উদ্দিন ইউসুফ। সভাপতিত্ব করেন নাগরিকের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান।

নানা কারণে ব্যতিক্রম ছিল এই উৎসব। এবারই প্রথম কোনো উৎসবে সাতটি নতুন নাটক মঞ্চস্থ হলো। এ ছাড়া প্রথম কোনো দলকে নয়, ব্যক্তি তথা নির্মাতা ও নির্দেশককে প্রণোদনার মাধ্যমে নতুন নাটক সামনে আনার উৎসাহ দিয়েছেন আয়োজকেরা। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের দুজন সদস্য ছাড়া বাকি সবাই নিজ উদ্যোগে নিজের নাটকের শিল্পী থেকে শুরু করে যাবতীয় পরিকল্পনা করেছেন।

চার গুণীকে সম্মাননার পাশাপাশি গতকাল মহিলা সমিতির বয়োবৃদ্ধ পরিচ্ছন্নতাকর্মী শেখ শামউদ্দিন সাজাহান এবং ক্যানসারে আক্রান্ত আবৃত্তিশিল্পী ফখরুল ইসলামকে এক লাখ টাকা করে অনুদান দেওয়া হয়। ছবি: প্রথম আলো
চার গুণীকে সম্মাননার পাশাপাশি গতকাল মহিলা সমিতির বয়োবৃদ্ধ পরিচ্ছন্নতাকর্মী শেখ শামউদ্দিন সাজাহান এবং ক্যানসারে আক্রান্ত আবৃত্তিশিল্পী ফখরুল ইসলামকে এক লাখ টাকা করে অনুদান দেওয়া হয়। ছবি: প্রথম আলো

উৎসবের প্রথম দিন নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের নতুন প্রযোজনা ‘কালো জলের কাব্য’ মঞ্চস্থ হয়। নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন পান্থ শাহরিয়ার। উইলিয়াম শেক্‌সপিয়ারের ‘মার্চেন্ট অব ভেনিসের’ ভাবানুবাদে করা নাটকে অভিনয় করেছেন আসাদুজ্জামান নূর। পরদিন ৩০ নভেম্বর শনিবার মঞ্চস্থ হয় শামীম সাগর নির্দেশিত সুনামগঞ্জের বন্ধন থিয়েটার ও প্রসেনিয়াম থিয়েটারের যৌথ নির্মাণ ‘রাধারমণ’। ১ ডিসেম্বর রোববার মঞ্চস্থ হয় রতন সিদ্দিকী রচিত ও হৃদি হক নির্দেশিত নাগরিক নাট্যাঙ্গনের নাটক ‘আকাশে ফুইটেছে ফুল লেটো কাহন’। ২ ডিসেম্বর সোমবার প্রদর্শিত হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ও সাইদুর রহমান লিপন নির্দেশিত নাটক ‘অরূপ রতন’। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের উপন্যাসের নাট্যরূপে কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমনের নির্দেশনায় ৩ ডিসেম্বর মঙ্গলবার মঞ্চস্থ হয় নাটগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের নাটক ‘খোয়াবনামা’। আফ্রিকান গল্প অবলম্বনে শুভাশিস সিনহার নির্দেশনায় ৪ ডিসেম্বর বুধবার মঞ্চস্থ হয় মণিপুরি থিয়েটারের নাটক ‘ও মনপাহিয়া’। সমাপনী দিন গতকাল ৫ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার মঞ্চস্থ হয় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিল্পীদের অভিনীত নাটক ‘লটারি’।

দর্শনীর বিনিময়ে নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অন্যতম পথিকৃৎ নাট্য সংগঠন নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়। বাংলাদেশে মঞ্চ নাটকের ক্ষেত্রে ইতিহাস সৃষ্টিকারী এই সংগঠনটি ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৩ সালে বাদল সরকারের লেখা ‘বাকী ইতিহাস’ নাটক মঞ্চায়নের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শনীর বিনিময়ে নাট্যচর্চা শুরু করে নাট্যদলটি। এই সংগঠনটি ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর এবং দর্শনীর বিনিময়ের নাট্যচর্চার ৪৫ বছর উদযাপন করেছে। এ উপলক্ষে বছরব্যাপী চলছে নানা কর্মসূচি। চলতি বছরের শেষ উদ্যোগ হিসেবে ‘নতুনের উৎসব’ শীর্ষক নাট্য উৎসবের আয়োজন করছে দলটি।