ছোট্ট চেনা মুখেরা

>এ প্রজন্মের শিশুরা বেড়ে উঠছে প্রযুক্তির জালে জড়িয়ে। মুঠোফোন, ট্যাব, টিভি, ল্যাপটপ—তাদের চোখ আটকে থাকছে একেক সময় একেক পর্দায়। কিন্তু এসবের মধ্যেও এই সব জাল আর অন্তর্জাল থেকে বেরিয়ে কয়েকজন গান গেয়ে পেয়েছে পরিচিতি। এইটুকু বয়সেই এখন তাদের চেনে অনেকে। ফেসবুক–ইউটিউবে তারা ভাইরাল। সারা দিন ফেসবুক–ইউটিউব নিয়ে পড়ে না থেকে, তারা নিজেরাই হয়ে উঠেছে খুদে ভাইরাল তারকা। লিখেছেন তানজিনা আকতারী
ঋতুরাজ ও তার বাবা শুভাশীষ। ছবি: খালেদ সরকার
ঋতুরাজ ও তার বাবা শুভাশীষ। ছবি: খালেদ সরকার

বাপ–বেটার যুগলবন্দী
বাবা গিটারে সুর তুলে গানের কিছু অংশ গাইছেন, পাশেই ছোট ছেলে তালে তাল মিলিয়ে গেয়েই চলেছে গান। সবচেয়ে নজরকাড়া ব্যাপার হলো, বাবা আর ছেলের পোশাক একই রকম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওর জের ধরে এই বাবা আর ছেলেকে এখন অনেকেই চেনে। ‘বাপ কা বেটা’ নামে ব্যান্ডও করেছে তারা। এই দলে ‘বেটা’ নামে পরিচিত ঋতুরাজ ভৌমিক, আর তার বাবা শুভাশীষ ভৌমিক হলেন এই দলের ‘বাপ’। ঋতুরাজের মা মৌসুমী সাহা ক্যামেরার পেছন থেকে এই কলকাঠি নাড়েন প্রতিটি গানের, প্রতিটি পরিবেশনার।

ছোট্ট ঋতুরাজের বয়স এখন ছয়বছর। অস্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের স্ট্যান্ডার্ড ওয়ানে পড়ে সে। ঋতুরাজের বাবা শুভাশীষ বলেন, ছেলের বয়স যখন ছয়মাস তখন থেকে ওর সামনে গিটার নিয়ে গান করতেন বাবা। এরপর যখন একটু বড় হয়ে ঋতু ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া শুরু করল, তখন ছেলে যেন বাংলা সংস্কৃতি ভুলে না যায় আর অতিরিক্ত প্রযুক্তি ব্যবহার না করে, এ জন্য ওর গানের তালিম দেওয়া শুরু করেন বাবা। 

চলতি বছর থেকে ঋতুরাজ ও তার বাবা জনপ্রিয় গানের কভার করা শুরু করেন এবং তা ফেসবুকে ছাড়তে শুরু করেন। ‘পেন্সিল’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপেও ‘বাপ কা বেটা’র গান তোলা হলে দেখা গেল মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে সেখানে প্রায় ২৫০ মন্তব্য আর কয়েক হাজার শেয়ার। মন্তব্যগুলোর মধ্যে নেই কোনো বাজে কথা। এরপর উৎসাহ বেড়ে যায় বাবা আর ছেলের। তারপর থেকে প্রতি সপ্তাহে একটি করে আসতে থাকে নতুন গান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাড়তে থাকে ছোট্ট ঋতুর পরিচিতি।

ঋতুরাজের ইচ্ছা বাবা ছাড়াও তাহসানের সঙ্গে একদিন যুগলে গান গাইবে সে। কিছুদিন আগে একটি মুঠোফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনে মডেল হয়েছে এই ভাইরাল ‘বাপ-বেটা’ জুটি। প্রতিদিন সন্ধ্যারাতে ঘুমিয়ে গেলেও নতুন কিছু করার জন্য সে রাত প্রায় আড়াইটা পর্যন্ত শুটিং করে গেছে দারুণ আনন্দে। বড় হয়ে একসঙ্গে অনেক কিছু হতে চায় ঋতুরাজ—বিজ্ঞানী, আর্মি অফিসার, পাইলট আর গায়ক তো অবশ্যই।

আরুশি গাইছে বাবার সঙ্গে
আরুশি গাইছে বাবার সঙ্গে

হরিণছানা এখন বড় হয়েছে
এটা বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা। দূরপ্রবাসে বসে ‘হরিণছানার বাংলাদেশ’ গান দিয়ে হঠাৎ আলোচনায় উঠে আসে ছোট্ট অবারিতা আরুশি। ইউটিউবে থাকা গানের ভিডিওতে দেখা যায়, বাবার পাশে বসে ছোট্ট মেয়ে হাত–পা নেড়ে মিষ্টি কণ্ঠে গেয়ে চলেছে গান। মা–বাবার সঙ্গে আরুশি এখন যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা। ছোট্ট হরিণছানার এ সময়ের কথা জানতে চাইলে ওর বাবা যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস টেক ইউনিভার্সিটির ল্যান্ডস্কেপ আর্কিটেকচারের সহকারী অধ্যাপক মুন্তাজার মনসুর হেসে জানালেন, ‘সে তো এখন আর ছোট্ট নেই, এখানকারই একটি স্কুলের ফোর্থ গ্রেডে পড়ছে।’

অবারিতা আরুশিকে মা–বাবা গান শোনানো শুরু করেন বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য, দেশের কথা জানানোর জন্য। খুব ছোটবেলা থেকেই আরুশি গান ভালোবাসত। বাবা মুন্তাজার বলেন, ‘২০১১ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্রে চলে এলাম তখন ওর বয়স ১৮ মাস। একদিন আমরা সবিস্ময়ে লক্ষ করলাম, আমি গিটারে যে সুরই বাজাই অবারিতা সঙ্গে সঙ্গেই গুনগুন করে উঠছে। শব্দের গাঁথুনি তখনো ওর তৈরি হয়নি, শুধু সুর বেরোচ্ছিল। পুরো বিষয়টা বেশ মজার ছিল। ২০১৩ সালে অবারিতার এ রকম একটা গানের সুরে আমি কথা বসিয়ে লিখেছিলাম ‘বাঘ আর হরিণছানা’। নিজের ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেলে সেই গান আপলোড করার পর ইন্টারনেটে যে হুলুস্থুল পড়ে যাবে, তা কল্পনাও করিনি।’

মা রোজালিন সামিরা ও বাবা মুন্তাজার মনসুর প্রবাসে থেকেও মেয়েকে বাংলা গানের সঙ্গে জুড়ে রেখেছেন। লেখাপড়ার বাইরে প্রায় তিন বছর ধরে আরুশি শিখছে ভরতনাট্যম। সেখানকার বাংলা বর্ষবরণ বা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান ও নাচে সব সময় অংশ নেয় আরুশি। বাংলায় গান করে, নাচে বাংলা গানের তালে।

সুতপা মণ্ডল। ছবি: আনন্দ
সুতপা মণ্ডল। ছবি: আনন্দ

সুতপার গানে মুগ্ধ শ্রোতা দিলেন লাখ টাকা
সাদাসিধে পোশাক পরা শান্ত একটি মেয়ে অবলীলায় খালি গলায় গেয়ে চলেছে লতা মঙ্গেশকর আর আশা ভোসলের বিভিন্ন গান। ফেসবুকে ওর গান শুনে অনেকেই তাকে ‘লতাকণ্ঠী’ বলেও সম্বোধন করছে। সুতপা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে হয়ে উঠেছে হাজারো শ্রোতার কাছে পরিচিত। সুতপা মণ্ডলের গান তারই স্কুলের শ্রেণিশিক্ষক ফোনে ধারণ করে ফেসবুকে তুলে দেন। এমন মধুর কণ্ঠে গাওয়া গান তোলপাড় তোলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে থাকা গানপ্রেমীদের মনে। 

সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলার কোদন্ডা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী সুতপা। ছোটবেলা থেকেই মোবাইল ফোনে রেকর্ড করা গান শুনে গাইত, এখনো গায়। প্রায় তিন বছর ধরে আনুষ্ঠানিকভাবে নিচ্ছে গানের তালিম। মৃণাল কান্তি মণ্ডল ও সুমনা মণ্ডলের দুই সন্তানের মধ্যে সুতপা বড়। 

‘ভাইরাল’ হয়ে ওঠার কল্যাণে এক ব্যক্তি সুতপার গানে মুগ্ধ হয়ে ওর লেখাপড়ার জন্য ১ লাখ টাকা উপহার হিসেবে পাঠিয়েছেন। এ তথ্য দিলেন সুতপার শিক্ষক বাবা। এমনকি ফেসবুক–ইউটিউবের গণ্ডি পেরিয়ে মূলধারার গানের জগতেও এরই মধ্যে নাম লেখা হয়ে গেছে তার। গেল দুর্গাপূজায় কবির বকুলের লেখা ও কুমার বিশ্বজিতের সুরে ‘মুখোমুখি’ নামে একটি মৌলিক গানে কণ্ঠ দিয়েছে সুতপা।

লিউনা তাসনিম। ছবি: আবদুস সালাম
লিউনা তাসনিম। ছবি: আবদুস সালাম

লিউনাকে এখন সবাই চেনে
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের কল্যাণে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া জামালপুরের পরিচিত মুখ লিউনা তাসনিম, ডাকনাম সাম্য। সে ২৮ নম্বর উত্তর মেলান্দহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। এই বয়সেই সে প্রায় ৭০টি গান মুখস্থ করে ফেলেছে। গানের পাশাপাশি লিউনা নাচে, আঁকে ও কবিতা আবৃত্তি করে। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় জাতীয় ও বিভাগীয় পর্যায়ে প্রথম স্থান অধিকারের পুরস্কারও আছে তার অর্জনের ঝুলিতে।

লিউনার বাড়ি জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার পিংনা এলাকায়। তবে বাবা আজমত আলী মেলান্দহ উপজেলায় সমাজসেবা অধিদপ্তরের অফিস সহকারী ও কম্পিউটার অপারেটর। তিনি জানান, একদিন লিউনার সহপাঠী ও বন্ধুর বাবা মেলান্দহ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তামিম আল ইয়ামীন ছোট্ট লিউনার একটি গান ভিডিও করে ফেসবুকে তুলে দেন। তারপর একে একে বিভিন্নজন গানের ভিডিওটি শেয়ার করতে থাকে। রাতারাতি ভাইরাল হয়ে ওঠে লিউনার গান। তার গান এতটাই খ্যাতি পায় যে জামালপুর থেকে ঢাকায় আসতে হয় লিউনাকে, গান গাইতে হয় পরিচিতজনদের অনুরোধে। গানের চর্চা চালিয়ে যেতে চায় লিউনা।