সাংস্কৃতিক জাগরণের প্রত্যয়ে বিজয় উৎসব শুরু

বিজয় উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সমবেত নৃত্যপরিবেশনা। ছবি: প্রথম আলো
বিজয় উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সমবেত নৃত্যপরিবেশনা। ছবি: প্রথম আলো

রক্তিম সূর্যটা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছিল। পশ্চিমে বিদায় নেওয়ার আয়োজন চূড়ান্ত করেছে সূর্য। এমন সময় মিনারের পাদদেশে সচকিত হলো গানে ‘বিজয় নিশান উড়ছে ঐ’। গানের তালে তালে নৃত্য। বিজয়ের আনন্দে, দেশের প্রতি ভালোবাসার এমন দারুণ অনুভূতির মধ্য দিয়েই আজ শুক্রবার বিকেল থেকে শুরু হয়েছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের বিজয় উৎসব। এবারের উৎসবের মূল প্রতিপাদ্য ‘বিজয়ের অঙ্গীকার, সাংস্কৃতিক অধিকার’।

শুক্রবার বিকেল চারটায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বেলুন উড়িয়ে বিজয় উৎসবের উদ্বোধন করেন রামেন্দু মজুমদার। পরে আলোচনা সভায় সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছের সভাপতিত্বে বক্তৃতা করেন মুক্তিযোদ্ধা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ, পথনাটক পরিষদের সভাপতি মান্নান হীরা। উপস্থিত ছিলেন জাতীয় কবিতা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ সামাদ, গণসংগীত সমন্বয় পরিষদের সভাপতি ফকির আলমগীর, আহাম্মেদ গিয়াস, আকতারুজ্জামান প্রমুখ। বিজয় উৎসবের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আহকাম উল্লাহ। স্বাগত বক্তৃব্য দেন সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ।

বর্ণিল বেলুন উড়িয়ে বিজয় উৎসবের উদ্বোধন করেন অতিথিরা। ছবি: প্রথম আলো
বর্ণিল বেলুন উড়িয়ে বিজয় উৎসবের উদ্বোধন করেন অতিথিরা। ছবি: প্রথম আলো

এ দেশের মানুষের সাংস্কৃতিক উন্নয়ন না ঘটলে, রাষ্ট্রে যত উন্নয়ন কর্মসূচিই হাতে নেওয়া হোক, সবই ভেস্তে যাবে বলে মন্তব্য করেছেন রামেন্দু মজুমদার। বিজয় উৎসবের উদ্বোধনী বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতু কতটা দৃশ্যমান হলো, তার চেয়ে বেশি জরুরি আমাদের মানুষের সাংস্কৃতিক উন্নয়ন কতটা হলো। আমরা চাই, সম্পদের সুষম বণ্টন হোক। অর্থনীতির বৈষম্য যেন কমে আসে। কেবল অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না, মানুষের সাংস্কৃতিক চেতনাকে জাগ্রত করতে হবে। মানুষের সাংস্কৃতিক অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি।’

অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, এবারের বিজয় উৎসবের স্লোগান ‘বিজয়ের অঙ্গীকার সাংস্কৃতিক অধিকার’। আর এবারের স্লোগান শুধু উৎসবসজ্জার বিষয় নয়, এর মধ্যে নিহিত রয়েছে নব সাংস্কৃতিক আন্দোলন সূচনার ইঙ্গিত। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পথ ধরে জীবনযাপন করতে পারাটাই হচ্ছে সাংস্কৃতিক অধিকার। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বিকশিত হয়েছে বাঙালির জাতিসত্তা। আর এই বাঙালির জাতিরাষ্ট্রের মূল ভিত্তি হচ্ছে সংস্কৃতি। অথচ সেই সংস্কৃতিচর্চা বৃত্তবন্দী হয়েছে কেবল রাজধানীসহ কয়েকটি শহরে। উপজেলা কিংবা গ্রাম পর্যায়ে সংস্কৃতিচর্চা একেবারেই হচ্ছে না। প্রান্তিক পর্যায়ে সংস্কৃতির আলো না পড়ার কুফল হিসেবে বিপথগামী হচ্ছে তরুণ প্রজন্ম। এ কারণে সারা দেশে সংস্কৃতির জাগরণ জরুরি।

সমবেত সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পীরা। ছবি: প্রথম আলো
সমবেত সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পীরা। ছবি: প্রথম আলো

এর আগে অনুষ্ঠানের শুরুতে শহীদ মিনারের বেদিতে ফুল দিয়ে এবং বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। সম্মিলিত কণ্ঠে ‘জাতীয় সংগীত’ ও ‘আমরা সবাই বাঙালি’ গান দুটো পরিবেশন করেন শিল্পীরা। এ ছাড়া আলোচনার ফাঁকে স্পন্দনের শিল্পীরা ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করেন। অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে সংগীত পরিবেশন করেন সমর পড়ুয়া, আরিফ রহমান। পথনাটক পরিবেশন করে সুবচন নাট্য সংসদ।

শহীদ মিনার থেকে শুরু হওয়া ২৯তম উৎসবটি ছড়িয়ে যাবে রাজধানীর নানা প্রান্তের আরও চারটি মঞ্চে। শনিবার থেকে ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবর, রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ, মিরপুর ও দনিয়ায় মঞ্চে সূচনা হবে উৎসবের। সব মিলিয়ে ১২৫টি সাংস্কৃতিক সংগঠনের আড়াই হাজার শিল্পী অংশ নেবেন আয়োজনে। গানের সুরে, কবিতার ছন্দে, নৃত্যের নান্দনিকতায়, পথনাটকের পরিবেশনায় এবং শিশুসংগঠনের পরিবেশনায় বর্ণিল হবে এবারের উৎসব। থাকবে স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পীদের সংগীত পরিবেশনা। সংগীত ও আবৃত্তিতে থাকবে একক এবং সম্মেলক পরিবেশনা। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস পর্যন্ত প্রতিদিন বিকেল চারটা থেকে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত পাঁচ মঞ্চে চলবে পরিবেশনা পর্ব। প্রতিবছরের মতো এবারও বিজয় দিবসের দিন সকাল সাড়ে ১০টায় ঢাকা শহীদ মিনার থেকে বের করা হবে বর্ণাঢ্য বিজয় শোভাযাত্রা। এ ছাড়া ১৪ ডিসেম্বর বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের বিশেষ আলোচনা।

১৯৯০ সালে স্বৈরাচার পতনের পর সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট প্রথম বিজয় উৎসব আয়োজন করেছিল। ওই সময় এই উৎসব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। তারপর ধীরে ধীরে এর বিস্তৃতি ঘটেছে।