২০০ পেরিয়ে 'পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়'

>সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক রচিত এবং আবদুল্লাহ আল-মামুন নির্দেশিত কাব্যনাট্য পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। যাকে বলা হয় মহান মুক্তিযুদ্ধের এক অনবদ্য দলিল। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট এবং সেই সময়কার গল্পগুণেই সমৃদ্ধ ‘থিয়েটার’–এর এই প্রযোজনা। ১৬ ডিসেম্বর নাটকটির ২০০তম প্রদর্শনী দেখে লিখেছেন মাসুম আলী
নাটকের শুরুর দিকের মঞ্চায়নে ফেরদৌসী মজুমদার
নাটকের শুরুর দিকের মঞ্চায়নে ফেরদৌসী মজুমদার

নতুন দেশের জন্মযন্ত্রণায় মানুষ তখন উন্মাতাল। সে বড় আনন্দের ক্ষণ, সে বড় কষ্টের সময়। সেটা জাগরণের সময়। সেই জাগরণের কথাই উঠে এসেছে মহাকাব্যিক সেই সময়ের অনবদ্য কাব্যনাট্য পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়–এ। দেশ-বিদেশের মঞ্চে ১৯৯ বার ঘুরে ২০০তম মঞ্চায়ন হলো নাটকটির। আর তা হলো, মহান বিজয় দিবসে। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয়ের ৪৮তম বার্ষিকীতে নাটকটি মঞ্চায়নের বয়স হলো ৪৩।

১৯৭৬ সালের ২৫ নভেম্বর ঢাকার মহিলা সমিতি মিলনায়তনে দর্শক প্রথম শুনেছিল কবিতার মতো সংলাপগুলো। সেদিন সেই মঞ্চে লেখা হয়েছিল এক অনন্য ইতিহাস। সেদিন প্রথম অভিনীত হলো কালজয়ী কাব্যনাট্য পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। যা এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘকাল ধরে মঞ্চায়িত নাটক। 

গত সোমবার পরীক্ষণ থিয়েটার মিলনায়তনের করিডরে পাশাপাশি দুটি প্রতিকৃতি। ফ্রেমে বাঁধা সৈয়দ শামসুল হক ও আবদুল্লাহ আল-মামুন। তাঁদের সামনে গাঁদা, গোলাপ আর রজনীগন্ধার পাপড়ি দিয়ে লেখা হয়েছে ২০০। সেখানে জ্বলছিল প্রদীপ। সাজসজ্জা আর মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতিতে উৎসব উৎসব ভাব ছিল। 

নাহ্‌, কোনো উৎসব ছিল না। সেই অর্থে ঢাকঢোল পিটিয়ে ২০০তম প্রদর্শনীর আয়োজন করেনি থিয়েটার। এরপরও মিলনায়তন ভরে গিয়েছিল দর্শকের উপস্থিতিতে। সেখানে নিয়মিত দর্শকের পাশাপাশি নতুন নতুন মুখ দেখা গেছে। এমন একজন কলেজশিক্ষক শাওনী চন্দ। বললেন, ‘সময় হয়েছে, সুযোগ হয়নি। আসলে টিকিট পাইনি একবারও। এবার সাধ মিটল।’

নাটক শুরু হয় নির্দিষ্ট সময়েই। দেড় ঘণ্টার নাটকে পুরো সময় ছিল মুগ্ধতার। মুক্তিযুদ্ধের সময় এক রাতে একটি গ্রামের নারী-পুরুষেরা এসেছে মাতবরের কাছে। তাদের চোখে-মুখে উৎকণ্ঠা। গত রাতেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন মাতবরের সঙ্গে দেখা করেছে জানিয়ে সবাইকে আশ্বস্ত করেছে সে। পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর ভরসা রাখতে বলছে উপস্থিত লোকজনকে। গ্রামবাসী সহজে আশ্বস্ত হতে পারে না। সৈয়দ শামসুল হকের লেখা কালজয়ী নাটক পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়-এর পটভূমি এটি।

প্রদর্শনীতে উপস্থিত ছিলেন নাটকের প্রযোজনা উপদেষ্টা ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটের সাম্মানিক সভাপতি রামেন্দু মজুমদার। তিনি বলেন, পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় মঞ্চস্থ করার আগে কাব্যনাট্য সম্পর্কে আমাদের ধারণা ছিল এটা কেবলই কবিতা, নাটকের আবেদন নেই। মহড়ার সময় আমাদের কেবলই আবৃত্তির মতো হয়ে যেত। নির্দেশক আবদুল্লাহ আল মামুন শেখালেন কী করে সংলাপের মতো করে কাব্যভাষা বলতে হবে। কোথাও কোথাও সংলাপের সঙ্গে তালবাদ্য যুক্ত করলেন। পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় হয়ে উঠল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য আখ্যান।

আগে মা, এখন মেয়ে

২০০২ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত নাটকটির প্রদর্শনী বন্ধ ছিল। ১০ বছর বিরতি দিয়ে আবার শুরু হয় এই নাটকের প্রদর্শনী। নতুন প্রযোজনায় নির্দেশনার দায়িত্ব দেওয়া হয় সুদীপ চক্রবর্তীকে। নবীন ও প্রবীণদের সমন্বয়ে দলকে গঠন করে আবার মঞ্চে নিয়ে আসা হয় ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’। 

নাটকে ফেরদৌসী মজুমদারের করা আলোচিত মাতবরের মেয়ে চরিত্রটি এখন করছেন তাঁরই মেয়ে ত্রপা মজুমদার। আর ফেরদৌসী মজুমদার অভিনয় করছেন একজন গ্রামবাসী বৃদ্ধার চরিত্রে। বরেণ্য এই অভিনেত্রী বলেন, ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সুলিখিত এবং শক্তিশালী এক পাণ্ডুলিপি। যত দিন বাংলাদেশ থাকবে, মুক্তিযুদ্ধ থাকবে, তত দিন এ নাটকটি সৈয়দ শামসুল হক ও আবদুল্লাহ আল মামুনকে বাঁচিয়ে রাখবে। কারণ পাণ্ডুলিপি শক্তিশালী হলে দর্শক নাটক গ্রহণ করবেই, কিন্তু পাণ্ডুলিপি ভালো না হলে যত শক্তিশালী অভিনেতাই হোক, দর্শক তা মনে রাখে না।’ তিনি বলেন, তারুণ্যে এ নাটকে কাজ শুরু করেছিলাম, আর এখন প্রায় বৃদ্ধা। এর মধ্যে ২০০টি প্রদর্শনীতে অভিনয় করেছি। কিন্তু কীভাবে এ দীর্ঘ সময় পার হলো টের পায়নি। আমি কখনো নাটকের সংখ্যা মনে রাখতাম না। সারা জীবন নাটক ভালোবেসেছি, অভিনয় ভালোবেসেছি, তাই যখনই যে চরিত্র করেছি, তাই নিয়ে মনোযোগী থেকেছি। 

পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় নাটকের দৃশ্যে বাঁ থেকে ফেরদৌসী মজুমদার, কেরামত মাওলা, ত্রপা মজুমদার, এরশাদ হাসান ও তোফা হোসেন। ছবি: সংগৃহীত
পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় নাটকের দৃশ্যে বাঁ থেকে ফেরদৌসী মজুমদার, কেরামত মাওলা, ত্রপা মজুমদার, এরশাদ হাসান ও তোফা হোসেন। ছবি: সংগৃহীত

শুরুতে ত্রপা মাতবরের মেয়ে চরিত্রে অভিনয় করতে রাজি হয়নি। তার কারণ ছিল, কোনো চরিত্রে একটা ইমেজ তৈরি হয়ে গেলে নতুন কিছু করা কঠিন। পরে ফেরদৌসি মজুমদার ত্রপাকে বুঝিয়েছেন, যারা আগে এ নাটকটি দেখেছে, তারা হয়তো এ বিচারে আসবে কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের যারা, তাদের সে সুযোগ নেই। তিনি বলেন, আমার মনে হয়, ত্রপা তার চরিত্রে সে সুঅভিনয় করেছে। দুই শত প্রদর্শনী হওয়ার পর আমার নিজেরও তাই মনে হয়েছে। কারণ ত্রপার নাটকের প্রতি অসম্ভব ভালোবাসা আছে। এ প্রসঙ্গে ত্রপা মজুমদার বলেন, ‘প্রথমত, আমার ভাগ্যের ব্যাপার। এটি একটি মুক্তিযুদ্ধের নাটক এবং বলাই যায় পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় নাটকটি ঢাকার মঞ্চে মুক্তিযুদ্ধের সেরা নাটক। দ্বিতীয়ত, আমার জন্য বিরাট প্রাপ্তি হলো আমার মা যে চরিত্রটি করতেন, সেই চরিত্র আমি করছি। এই চরিত্রটি সবার কাছে মায়েরই চরিত্র হিসেবে খ্যাত হয়ে গেছে। কেননা, মা এই চরিত্রটির একটা মাইলফলক তৈরি করেছেন।’

যাঁরা ছিলেন, যাঁরা আছেন 

গত ৪৩ বছরে বিভিন্ন সময়ে নাটকটির বিভিন্ন প্রদর্শনীতে অভিনয় করেছেন আবদুল্লাহ আল-মামুন, মোহাম্মদ জাকারিয়া, রামেন্দু মজুমদার, আফরোজা বানু, আবদুল কাদের, তারিক আনাম খান, মিতা চৌধুরী, তারানা হালিম, খায়রুল আলম সবুজ, ঝুনা চৌধুরী, নরেশ ভূঁইয়া, সুজা খন্দকার, তোফা হাসান, জুবায়ের জার্জিস, নাসরিন রিয়াজ, হাফিজুর রহমান সুরুজ, রিয়াজউদ্দিন বাদশা, ফরিদউদ্দিন, তৌকীর আহমেদ, আসিফ মুনীর, শিরীন বকুল, শান্তা ইসলাম, নাহিদ ফেরদৌস মেঘনা, তানভীন সুইটি প্রমুখ শিল্পী। বর্তমানে নাটকটিতে অভিনয় করছেন ফেরদৌসী মজুমদার, কেরামত মওলা, শফিউর রহমান মানু, নুরুল ইসলাম সানি, খুরশীদ আলম, রাশেদুল আওয়াল, জোয়ারদার সাইফ, তামান্না ইসলাম, সামিয়া মহসীন, শেকানুল ইসলাম শাহী, মারুফ কবির, তানভীর হোসেন সামদানী, কল্যাণ চৌধুরী, তানজুম আরা, কাওসার রাজীব, আতিকুর রহমান, এরশাদ হাসান, তোফা হোসেন ও ত্রপা মজুমদার।