ভাইরাল নয়, ভাই

সাজু ভাই কি অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরেছেন? লিংকন ভাই কবে বাবা হলেন? নতুন অ্যালবাম নিয়ে কী বললেন সেজান ভাই? ফয়সাল ভাই কি নতুন কোনো ভিডিও ফেসবুকে দিয়েছেন? আর্টসেলভক্তদের সব খবরই জানা। ভাইরাল নয়, ‘ভাই’ হিসেবে শ্রোতাদের কাছের মানুষ হয়েছেন আর্টসেল ব্যান্ডের সদস্যরা। গত ২০ বছরে একটু একটু করে তাঁদের গান পৌঁছে গেছে শ্রোতাদের কান থেকে প্রাণে।

এ বছর ৭ মার্চের ঘটনা। জয় বাংলা কনসার্টে সবার শেষে মঞ্চে উঠেছিল আর্টসেল। রাত প্রায় ১১টা। আর্মি স্টেডিয়ামের মাঠ তখনো কানায় কানায় পূর্ণ। একসময় কনসার্ট শেষ হলো, আর্টসেল মঞ্চ ছাড়ল। কিন্তু আর্টসেলভক্তরা তখনো মাঠ ছাড়েননি। শ পাঁচেক তরুণ চিৎকার করে গাইতে শুরু করলেন ‘অনিকেত প্রান্তর’। আসর ভাঙা মঞ্চে দাঁড়িয়ে হতভম্বের মতো দৃশ্যটা দেখছিলেন আর্টসেলের ড্রামার সাজু।

১৩ ডিসেম্বর, রাজধানীর বসুন্ধরায় আর্টসেলের প্র্যাকটিস প্যাডে বসে তাঁদের সঙ্গে আড্ডার শুরুতেই ঘটনাটা মনে করিয়ে দিই। সাজু বলেন, ‘এটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল। আমরা সেদিন “অনিকেত প্রান্তর” গাইনি। এমন নয় যে সে জন্য ভক্তরা রেগে গেছেন। ব্যাপারটা অনেকটা এমন—তোমরা গাওনি তো কী হয়েছে, আমরাই গেয়ে দিই।’
আর্টসেলভক্তরা এমনই। গত ২০ বছরে অনেক ‘ধূসর সময়’ পেরিয়েও আর্টসেল যেমন হারায়নি, তেমনি ‘লীন’ হয়ে যায়নি ভক্তদের ভালোবাসা। ১৯৯৯ সালে অনেকটা ‘গন্তব্যহীন’ভাবেই শুরু হয়েছিল প্রোগ্রেসিভ মেটাল ঘরানার ব্যান্ডটির ‘পথচলা’। ভোকাল লিংকন বলেন, ‘আমরা নিজেদের ভালো লাগার জন্য গান করতাম। আমাদের ভালো লাগা যে শ্রোতাদেরও ভালো লাগবে, সেটা তখন মাথায় ছিল না।’

গান বা অ্যালবাম নিজেদের জন্য করলেও এবার স্রেফ ভক্তদের জন্যই কনসার্ট আয়োজন করছে আর্টসেল। সবকিছু ঠিক থাকলে ২৪ ডিসেম্বর রাজধানীর বসুন্ধরার আইসিসিবি এক্সপো জোনে অনুষ্ঠিত হবে ‘টোয়েন্টি ইয়ারস অব আর্টসেলিজম’। টিকিটের জন্য নাম নিবন্ধন করতে হবে এই লিংকে: shohoz.com/events/20-years-of-artcellism/। মূল্য—৫০০ টাকা। লিংকন বলছিলেন, ‘টিকিটের একটাই দাম। ভিআইপি টিকিট বলে কিছু নেই। যাঁরা টিকিট কেটে গান শুনতে আসবেন, আমাদের কাছে তাঁরা সবাই ভিআইপি।’

আর্টসেলের চার সদস্য—ফয়সাল, লিংকন, সেজান ও সাজু। ছবি: সুমন ইউসুফ
আর্টসেলের চার সদস্য—ফয়সাল, লিংকন, সেজান ও সাজু। ছবি: সুমন ইউসুফ

অন্য সময়
‘আহা! এই মুহূর্তের জন্যই তো গানের জগতে এসেছিলাম!’ গত ২০ বছরে এমন অনুভূতির মুখোমুখি কখনো হয়েছেন? লিংকন বলেন, ‘অসংখ্যবার’। স্বভাবসুলভ মজা করেই একটা গল্প শোনালেন তিনি, ‘অনেক বছর আগের কথা। কোনো একটা আন্ডারগ্রাউন্ড শোতে প্রথম অডিয়েন্সের মধ্যে “আর্টসেল আর্টসেল” চিৎকার শুনে আমি রীতিমতো ঘাবড়ে গেলাম। মনে আছে, মেটালিকার এন্টার স্যান্ডম্যান গেয়েছিলাম। ভয়ে আমি উল্টাপাল্টা বাজানো শুরু করেছিলাম। যেই প্লাকিং দিয়ে গানটা শুরু হয়, সেটাও ভুল হয়ে গেল। আসলে কখনো কল্পনাও করিনি এভাবে সবাই আর্টসেল আর্টসেল বলা শুরু করবে।’

ব্যান্ডের বেইজিস্ট সেজানের কাছে ‘স্মৃতিস্মারক’ হয়ে আছে ২০০২ সালে ধানমন্ডির আরসিসি মিলনায়তনের অনুষ্ঠিত এক কনসার্টের গল্প। ‘তখন অনুশীলন অ্যালবামে মাত্রই আমাদের “দুঃখবিলাস” গানটা মুক্তি পেয়েছে। কনসার্টে গান শুরু করতে না–করতেই দেখি সবাই আমাদের সঙ্গে গাইছে। আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম,’ বলছিলেন তিনি।

‘তোমরা কেউ কি দিতে পারো প্রেমিকার ভালোবাসা’ গাইতে গিয়ে সেজানরা প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন, প্রেমিকার ভালোবাসা হোক না হোক, ভক্তদের ভালোবাসা তাঁরা পেতে শুরু করেছেন। সে সময় ফেসবুকের লাইক বা ইউটিউবের ‘ভিউ’য়ের হিসাব ছিল না। রাতারাতি ভাইরাল হয়ে যাওয়ার চল ছিল না। একটু একটু করে আর্টসেলের গান পৌঁছে গিয়েছিল শ্রোতাদের কান থেকে প্রাণে।

‘ভাইরাল’ প্রসঙ্গ আসতে একটু বোধ হয় বিরক্তই হলেন ব্যান্ডের সদস্যরা। সাজু বললেন সোজা ভাষায়, ‘আমরা কিন্তু ভাইরাল না। কখনো ভাইরাল হতে চাইনি, ভবিষ্যতেও চাইব না। “অনিকেত প্রান্তর” মুক্তি পেয়েছিল ২০০৬ সালে। আজকে ২০১৯ সালে এসে মানুষ “অনিকেত প্রান্তর” ট্রিবিউট করছে। একটা গান প্রায় এক যুগ ধরে মানুষ নিজের করে নিয়েছে।’

সত্যিই তো। ভাইরাল নয়, ‘ভাই’ হয়ে শ্রোতাদের কাছাকাছি পৌঁছেছেন লিংকন, সাজু, সেজান। এক বছর হলো এই দলে গিটারিস্ট হিসেবে যোগ দিয়েছেন ফয়সালও। সাজু ভাই কবে অস্ট্রেলিয়া থেকে দেশে ফিরলেন, লিংকন ভাই কবে বাবা হলেন, সেজান ভাই নতুন অ্যালবাম নিয়ে কোথায় কী বললেন, ফয়সাল ভাই ফেসবুকে নতুন কী ভিডিও আপলোড করলেন—ভক্তদের সব জানা।

শুধু একটা ব্যাপার জানা নেই কারও। কবে আসবে আর্টসেলের পরের অ্যালবাম? সেই ২০১০ সাল থেকে শোনা যাচ্ছে—আর্টসেলের নতুন অ্যালবাম শিগগিরই আসছে। মেঘে মেঘে কত বেলা গেল। লিংকনের চুল ছোট থেকে বড় হলো, সাজুর চুল হলো বড় থেকে ছোট। সেজান দুই সন্তানের বাবা হলেন। কিন্তু তৃতীয় অ্যালবামের দেখা নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে নানা রসিকতা চলে। ট্রল হয়। ‘ট্রল দেখে আমরাও মজাই পাই’, বলে লিংকন যোগ করলেন, ‘আবার মন খারাপও হয়। আমরা অ্যালবাম দিতে পারছি না, এটা তো ঠিক। মানুষ আমাদের ভালোবাসে বলেই তো এত কথা বলে।’

নতুন কোনো দিনক্ষণ ঘোষণা দেওয়ার ঝুঁকি লিংকন নিলেন না। তবে জানালেন, অ্যালবামের কাজ চলছে পুরোদমে। তাড়াহুড়ো করে কিছু করতে তাঁরা চান না। খুব যত্ন নিয়ে তৈরি হচ্ছে পরের অ্যালবাম। ভক্তদের সংশয় দূর করতে, এ বছর জয় বাংলা কনসার্টে আর্টসেল মুক্তি দিয়েছে অ্যালবামের একটি গান—‘সংশয়’। জানা গেল, আরও দুটো গান তৈরি আছে—‘অবিমৃশ্যতা’ ও ‘স্পর্শের অনুভূতি’।

মহড়ায় ব্যস্ত দলের সবাই
মহড়ায় ব্যস্ত দলের সবাই

হুংকারের অপেক্ষায়
লিংকন, সেজান, সাজু, ফয়সালদের এখন দম ফেলার ফুরসত নেই। প্রতিদিন চলছে অনুশীলন। কেবল গান নয়; এলইডি পর্দায় কী দেখানো হবে, মঞ্চ কেমন হবে, দর্শক কখন ভেন্যুতে ঢুকবেন—ভাবতে হচ্ছে প্রতিটা খুঁটিনাটি নিয়ে। জানা গেল, ২৪ ডিসেম্বর আর্টসেল মঞ্চে ওঠার আগে তাঁদের গানগুলোই কভার করবে বেশ কয়েকটি নবীন ব্যান্ড। নিজেদের প্রস্তুতির পাশাপাশি নবীন ব্যান্ডগুলোর অডিশন নিতেও ব্যস্ত সময় পার করছেন আর্টসেলের সদস্যরা। থাকবে আরও নানা চমক। সবটা ফাঁস না করলেও সেজান এককথায় বললেন, ‘আগে কখনো এমন কনসার্ট হয়নি। আগামী ১০ বছরও আমরা হয়তো এমন কিছু শ্রোতাদের দিতে পারব না।’

আর্টসেলের অনুশীলন চলছে। ভক্তরাও চাইলে ‘আর্টসেল আর্টসেল’ স্লোগান আর সঙ্গে হেডব্যাংয়ের অনুশীলনটা সেরে নিতে পারেন। আর তো মাত্র কটা দিন। তারপরই প্রমাণ হবে আর্টসেল একই আছে, নাকি বদলে গেছে এর স্বাদ!