ঋত্বিক ঘটকের ভিটা ভেঙে ফেলার প্রতিবাদ

ঋত্বিক ঘটক ও ভেঙে ফেলা তাঁর পৈতৃক বাড়ি। ছবি: সংগৃহীত
ঋত্বিক ঘটক ও ভেঙে ফেলা তাঁর পৈতৃক বাড়ি। ছবি: সংগৃহীত

সাইকেল গ্যারেজ তৈরির জন্য বাংলা চলচ্চিত্রের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক বাড়ি ভেঙে ফেলছে রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ। জানা গেছে, এরই মধ্যে বাড়ির একটি অংশের পুরোটা ভেঙে ইট, সিমেন্ট ও সুরকি সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

এ ঘটনার জানাজানি হওয়ার পরই প্রতিবাদ জানাচ্ছেন বাংলার চলচ্চিত্রপ্রেমীরা। ঋত্বিক ঘটকের বাড়ি ভাঙার প্রতিবাদে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। প্রতিবাদে সম্মিলিত ব্যানারে রাজশাহীতে মানববন্ধনের ডাক দিয়েছে ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটি, রাজশাহী ফিল্ম সোসাইটি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ এবং বরেন্দ্র ফিল্ম সোসাইটি। আজ মঙ্গলবার প্রতিবাদলিপি পাঠিয়েছেন ১২ চলচ্চিত্র নির্মাতা।

ঋত্বিক ঘটক জীবনের শুরুর সময়টা কাটিয়েছেন পৈতৃক বাড়ি রাজশাহীতে। এই বাড়িতে থাকার সময় তিনি রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল ও রাজশাহী কলেজে পড়েছেন। রাজশাহী কলেজ এবং মিঞাপাড়ার সাধারণ গ্রন্থাগার মাঠে প্রখ্যাত সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে নাট্যচর্চা করেছেন। ওই সময় ‘অভিধারা’ নামে সাহিত্যের কাগজ সম্পাদনা করেছেন ঋত্বিক। তাঁকে ঘিরেই তখন রাজশাহীতে সাহিত্য ও নাট্য আন্দোলন বেগবান হয়। এই বাড়িতে থেকেছেন ঋত্বিক ঘটকের ভাইঝি বরেণ্য কথাসাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী। এই বাড়ির ৩৪ শতাংশ জমি ১৯৮৯ সালে এরশাদ সরকার রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজকে ইজারা দেয়।

ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক বেলায়াত হোসেন মামুন জানান, বহু স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়ি। তাই স্বাভাবিকভাবেই এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। বাড়িটিকে সংরক্ষণের দাবি নতুন নয়। রাজশাহীতে ক্রিয়াশীল ঋত্বিক ঘটক চলচ্চিত্র সংসদ, রাজশাহী চলচ্চিত্র সংসদ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ এই বাড়িটিকে উদ্ধার ও সংরক্ষণের দাবিতে তিন বছর আগেই সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে। কিন্তু কোনো প্রতিকার হয়নি। সম্প্রতি এই বাড়ির একটি অংশ ভেঙে সেখানে একটি গ্যারেজ স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ।’

জানা গেছে, ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটি ঋত্বিক কুমার ঘটকের পৈতৃক বাড়িকে হেরিটেজ ঘোষণা করার দাবিতে আজ মঙ্গলবার বিকেলে রাজশাহীর সাহেব বাজার জিরো পয়েন্টে মানববন্ধন কর্মসূচির আহ্বান করেছে। এ ছাড়া ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশের উদ্যোগে ২৮ ডিসেম্বর বিকেল চারটায় রাজধানীর জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনের সামনে চলচ্চিত্র সংসদকর্মী, চলচ্চিত্রকর্মী ও সংস্কৃতিকর্মীদের মানববন্ধন করার ঘোষণা দিয়েছে।

নির্মাতা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ প্রথম আলোকে বলেন, বহু আগে থেকেই আমরা ঋত্বিক ঘটকের শৈশব, কৈশোর ও তারুণ্যের স্মৃতিবিজড়িত এই ভিটায় ‘ঋত্বিক ফিল্ম সেন্টার’ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে এসেছি।

ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক বাড়ির একাংশ। ছবি: সংগৃহীত
ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক বাড়ির একাংশ। ছবি: সংগৃহীত

নাসির উদ্দীন ইউসুফসহ ১১ জন নির্মাতা ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক ভিটা ভেঙে ফেলার প্রতিবাদে আজ একটি বিবৃতি দিয়েছেন। বিবৃতিটি হুবহু তুলে ধরা হলো:

বিশ্ববরেণ্য বাঙালি চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক বাড়ি রাজশাহীর মিঞাপাড়ার ভবনটি ভেঙে ফেলার ঘৃণ্য উদ্যোগকে আমরা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করি। পরিত্যক্ত ওই বাড়িতে একটি ‘ঋত্বিক চলচ্চিত্র কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা দেশের চলচ্চিত্রকর্মীদের দীর্ঘদিনের দাবি। কিন্তু সেনাশাসন ও স্বৈরশাসনকালে সে স্থানে একটি হোমিওপ্যাথ কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। রাজশাহীর ‘ঋত্বিক চলচ্চিত্র সংসদ’ কর্মীরা সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের কাছে ঐতিহ্যবাহী বাড়িতে একটি চলচ্চিত্রকেন্দ্র করার জন্য দাবিপত্র জমা দেয়। কিন্তু গত তিন বছরে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। ২১ ডিসেম্বর কলেজ কর্তৃপক্ষ সাইকেল স্ট্যান্ড করার অজুহাতে ভবনের একটি অংশ গুঁড়িয়ে দেয়। আমরা এ হীন কাজের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। বিষয়টি আজ সংস্কৃতিমন্ত্রীর গোচরে এলে তিনি দ্রুত জেলা প্রশাসককে ভাঙার কাজ স্থগিত করতে আশু পদক্ষেপ গ্রহণে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান। নির্দেশমতো ভাঙার কাজ স্থগিত হয়েছে। কিন্তু এটা সাময়িক ব্যবস্থা।

আমরা অনতিবিলম্বে ‘ঋত্বিক ফিল্ম সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করে আমাদের চলচ্চিত্রের ঐতিহ্য রক্ষার জন্য ভবনটিকে ‘হেরিটেজ’ ঘোষণা করে স্থায়ী সমাধানের আহ্বান জানাচ্ছি। দেশ–বিদেশের চলচ্চিত্র প্রদর্শন, গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও উৎসব আয়োজনের মধ্য দিয়ে উত্তরবঙ্গে একটি ভিন্ন মাত্রার চলচ্চিত্র আন্দোলন এই প্রস্তাবিত প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে। আর এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললে আমাদের চলচ্চিত্র সংস্কৃতির বিকাশ সাধিত হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। আমাদের জোর দাবি, হোমিওপ্যাথি কলেজটি ভিন্ন একটি স্থানে স্থানান্তর করে ‘ঋত্বিক চলচ্চিত্র কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা করা হোক।

বিবৃতিদাতা নির্মাতারা হলেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ, তানভীর মোকাম্মেল, মানজারে হাসীন মুরাদ, মোরশেদুল ইসলাম, এনায়েত করিম বাবুল, অঞ্জন জাহিদুর রহমান, আকরাম খান, শামীম আখতার, নূরুল আলম আতিক, এন রাশেদ চৌধুরী ও ফৌজিয়া খান।