বেড়েছে সম্ভাবনা, কমেছে সিনেমা হল

আয়নাবাজি ছবিতে চঞ্চল চৌধুরী ও নাবিলা
আয়নাবাজি ছবিতে চঞ্চল চৌধুরী ও নাবিলা
>সিনেমার মতো সিনেম্যাটিক ছিল বাংলা চলচ্চিত্রের এই চলতি দশক। মূলধারার বাণিজ্যিক সিনেমা হেঁটেছে বন্ধুর পথ দিয়ে। সাফল্য–ব্যর্থতা সমান্তরালভাবে হেঁটেছে। আবার একের পর এক প্রেক্ষাগৃহে তালা ঝুলে যাওয়ায় শঙ্কায় ছিল চলচ্চিত্রের মানুষেরা। কিন্তু এই দশক আমাদের ছুঁয়ে দিলে মন, আয়নাবাজি, ঢাকা অ্যাটাক, দেবীর মতো সিনেমার ব্যবসায়িক সাফল্য দিয়ে আশাবাদীও করেছে, জাগিয়েছে সম্ভাবনা। এসব নিয়ে লিখেছেন শফিক আল মামুন

সাফল্য–সম্ভাবনার দশক

টেলিভিশন, ডুবসাঁতার, চোরাবালির মতো সিনেমাগুলো বদলের ডাক নিয়ে চলতি দশকের শুরু করেছিল। এরপর পুরো দশকজুড়ে—জাগো, ঘেটুপুত্র কমলা, ছুঁয়ে দিলে মন, অজ্ঞাতনামা, ডুব, হালদা, আয়নাবাজি, ঢাকা অ্যাটাক, জিরো ডিগ্রি, গেরিলা, দেবী, স্বপ্নজাল—এসব ভিন্নধারার ছবি দর্শকের মধ্যে সাড়া ফেলে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির দর্শকও একটু একটু করে আবার প্রেক্ষাগৃহমুখী হতে থাকেন। গত এক দশকের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে ভিন্ন ধারার বেশ কিছু ছবি ব্যবসার দিক থেকে মূলধারার বাণিজ্যিক ছবিকেও পেছনে ফেলেছে। এ ধরনের ছবির সাফল্য নিয়ে নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, ‘এই যে পরিবর্তনের কথা বলা হচ্ছে, এটা হুট করে আকাশ থেকে পড়া এই দশকের কোনো ঘটনা নয়। এর ওপর আশির দশকের বিকল্প চলচ্চিত্র আন্দোলনের প্রভাব আছে, নব্বই দশকের শেষ ভাগে বেসরকারি টিভি চ্যানেলের প্রভাব আছে; যার মূলে ছিল, নিজেদের গল্প নিজেদের মতো করে বলার তাড়না। ভিজ্যুয়াল মাধ্যমে নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় তৈরি করার একটা তাড়না নতুন শতাব্দীর শুরু থেকে নির্মাতা ও দর্শক দুই দলের মধ্যেই কাজ করেছে। এই তাড়না সাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদ এবং অন্যদের কল্যাণে আরও আগে শুরু হয়ে গেলেও চলচ্চিত্রে এটা ঘটতে একটু সময় লেগেছে।’

অশ্লীলতা বন্ধ, কমেছে পাইরেসি

নব্বই দশকের শেষের দিকে ঢাকার চলচ্চিত্র অশ্লীলতায় দূষিত হতে শুরু করে। এর ফলে দর্শক পরিবার নিয়ে প্রেক্ষাগৃহে যাওয়া কমিয়ে দেয়। একসময় রুচিশীল দর্শকেরা সিনেমা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। অশ্লীলতার সেই সংকট ২০০৭–০৮ সাল পর্যন্ত চরমে ছিল। ওই সময় চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতি ও সরকারের সহযোগিতায় অশ্লীলতা বন্ধের অভিযান শুরু হয়। পাশাপাশি দেশের প্রভাবশালী কিছু গণমাধ্যমও অশ্লীলতা বন্ধের অভিযানে ভূমিকা রাখে। তবে চলতি দশকে এসে প্রায় পুরোটাই অশ্লীলতামুক্ত হয় বাংলাদেশের চলচ্চিত্র।

অন্যদিকে অশ্লীলতার আগে সিনেমাকে হুমকির মুখে ফেলে দেয় পাইরেসি। সেটাও নব্বই দশকের শেষের দিকের কথা। নতুন শতাব্দীর শুরু থেকে পাইরেসি বন্ধে সচেতন হয় চলচ্চিত্রকর্মী ও সরকার–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এগিয়ে আসে র‌্যাব–পুলিশ। কমে আসে পাইরেসিও। তবে অশ্লীলতার মতো পুরোপুরি উপড়ে ফেলা যায়নি। সিডি ডিভিডির যুগ ফুরিয়ে গেলেও ইউটিউবে পাইরেসি রয়ে গেছে। তাই চলতি দশকেও অব্যহত ছিল ও আছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান।

দেবী ছবিতে জয়া আহসান
দেবী ছবিতে জয়া আহসান

জয়ার দশক জয়

চলতি দশকের শুরুতে ডুবসাঁতার, গেরিলা, চোরাবালি, পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনী, এরপর জিরো ডিগ্রি, ফিরে এসো বেহুলা ছবিতেঅভিনয় করে জয়া আহসান বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে নিজের জায়গা পোক্ত করে নেন। ২০১৩ সালে কলকাতার ছবি আবর্ত মুক্তির পর জয়ার হিসাব–নিকাশ পাল্টে যায়। তিনি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে পাশের দেশে ভারতেও নিজের দ্যুতি ছড়ান। তাঁকে ঘিরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নির্মাতাদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হতে থাকে। একটি বাঙালি ভূতের গপ্পো, রাজকাহিনী, ঈগলের চোখ, বিসর্জন, ক্রিসক্রস, বিজয়া, এক যে ছিল রাজা কণ্ঠ ছবির মধ্য দিয়ে নিজের মেধার ছাপ রেখে চলছেন জয়া। পাশাপাশি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জন্যও এই অভিনেত্রী হয়ে উঠেছেন এক অপরিহার্য নাম। ২০১৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত জয়া অভিনীত ও প্রযোজিত দেবী ছবির ব্যবসায়িক সাফল্য তাঁকে নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়। দেশের রাষ্ট্রীয় সম্মাননার পাশাপাশি ভারতের ফিল্মফেয়ার পুরস্কার, জি সিনে অ্যাওয়ার্ড ও টেলি সিনে অ্যাওয়ার্ড ঘরে তুলে জয়া বাংলাদেশ ও ভারতে একাধারে ‘টক অব দ্য টাউন’ হয়ে ওঠেন।

নিজের এই এক দশকের যাত্রা নিয়ে জয়া আহসানের সঙ্গে কথা হলো। তিনি বলেন, ‘এই দশকেই তো চলচ্চিত্রের জয়া আহসানের জন্ম। ডুবসাঁতার দিয়ে শুরু হয়েছিল। এখনো এই যাত্রা চলছে। এই সময়ে নিজের চরিত্র, নিজের সিনেমা আর কাজের সঙ্গে আপস করিনি। প্রতিটি কাজে নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। গড্ডলিকাপ্রবাহে গা না ভাসিয়ে শিল্পী হিসেবে নিজেকে আরও উৎকৃষ্ট করার জন্য পরিশ্রম করে গেছি, সামনের দশকে এই চেষ্টা অব্যাহত রাখতে চাই।’

কমেছে সিনেমা হল, বেড়েছে মাল্টিপ্লেক্স

অশ্লীলতা আর পাইরেসির কারণে সিনেমা হলের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমতে থাকে। ২০০১–০২ সালেও সারা দেশে প্রায় ১ হাজার ৩০০ প্রেক্ষাগৃহ ছিল। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিবেশক ব্যবস্থাপক সমিতির প্রকাশিত নথি থেকে জানা গেছে, ২০০৭ সাল পর্যন্ত প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ১৫৪। ২০১০ সালের পর থেকে ভয়াবহ হারে সেই সংখ্যা কমতে খাকে। গত ৯ বছরে সক্রিয় প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ১০০–এর ঘরে। প্রদর্শক সমিতির বর্তমান উপদেষ্টা মিয়া আলাউদ্দিন বলেন, ‘অশ্লীলতা ও পাইরেসি আমাদের প্রেক্ষাগৃহের বেশি ক্ষতি করেছে। এর কারণে প্রেক্ষাগৃহে দর্শক কমতে শুরু করে। বন্ধ হয়ে যায় অনেক সিনেমা হল। পরবর্তীকালে মূলধারার মানসম্মত বাণিজ্যিক সিনেমার নির্মাণও কমে আসায় চরম দর্শকশূন্যতায় পড়ে যায় অবশিষ্ট সিনেমা হলগুলো।’

তবে প্রেক্ষাগৃহ কমে গেলেও চলতি দশকে বেড়েছে সিনেপ্লেক্সের সংখ্যা। ২০০৪ সালে তিনটি পর্দা নিয়ে বসুন্ধরা শপিং মলে চালু হয় দেশের প্রথম মাল্টিপ্লেক্স। এরপর বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্সে ২০১২ সালে আরও একটি ও ২০১৫ সালে আরও দুটি পর্দা যোগ হয়। ২০১৩ সালে ৭টি পর্দা নিয়ে যমুনা ফিউচার পার্কে যাত্রা করে ব্লকবাস্টার সিনেমাস। চলতি দশকে ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রাম, বগুড়া, নারায়ণগঞ্জেও তৈরি হয়েছে মাল্টিপ্লেক্স। সব মিলিয়ে বর্তমান ২৫টি পর্দা নিয়ে ছয়টি মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা দেখার সুযোগ পাচ্ছেন দর্শক।

জানা গেছে, ২০২০ সালে মাল্টিপ্লেক্সের এই সংখ্যা আরও বাড়বে। ঢাকার উত্তরা ও মিরপুর; চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে চালু হবে নতুন নতুন মাল্টিপ্লেক্স।

আরিফিন শুভ ও মাহিয়া মাহির মতো শিল্পীদের এই দশকে পেয়েছে ঢালিউড
আরিফিন শুভ ও মাহিয়া মাহির মতো শিল্পীদের এই দশকে পেয়েছে ঢালিউড

যৌথ প্রযোজনার সিনেমার সাফল্য

আশির দশকে দূরদেশ ছবিটি দিয়ে যৌথ প্রযোজনার ছবি আলোচনায় আসে। এরপর মিস লংকা, অবিচার, মনের মাঝে তুমিরমতো সিনেমা দেশের বাজারে ভালো ব্যবসা করেছে। মাঝে অনেক দিনই যৌথ প্রযোজনার ছবি ছিল না। ২০১৪ সালে যৌথ প্রযোজনার ছবি আমি শুধু চেয়েছি তোমায় দর্শকের আলোচনায় আসে। এরপর অগ্নি ২, রক্ত, নিয়তি, আশিকী, প্রেম কি বুঝিনি, তুই শুধু আমার, শিকারি, নবাব, বাদশা, বস ২, রোমিও ভার্সেস জুলিয়েট নামের ছবিগুলো হলমুখী করে দর্শকদের। তবে ব্যবসায়িকভাবে প্রেক্ষাগৃহে মার খেয়েছে ভারত থেকে আমদানি করা ভারতীয় বাংলা সিনেমা।

নতুনদের আগমন

গত দশকের শেষ দিকে ঢাকার চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় লাক্স তারকা বিদ্যা সিনহা মিমের। ২০১০ সালে জাগো ছবিতে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে সিনেমায় নাম লেখান আরিফিন শুভ। ২০১২ সালে ভালোবাসার রঙ দিয়েচলচ্চিত্রে আসেন মাহিয়া মাহি ও বাপ্পী চৌধুরী। একই বছরে আসেন সাইমন সাদিক। চলতি দশকের মাঝামাঝিতে পরীমনি, রোশান, নুসরাত ফারিয়া, সিয়াম, তাসকিন, ইয়াস রোহান, পূজা চেরি বৈচিত্র্যের স্বাদ দিতে দেশীয় চলচ্চিত্রে নাম লেখান।

শাকিবের নতুন অধ্যায়

শাকিব খান
শাকিব খান

গত দশকের যখন শুরু, তখনো শাকিব খান ঢাকার চলচ্চিত্রের শীর্ষ নায়ক। একের পর এক ব্যবসাসফল ছবি তাঁর ঝুলিতে এসে জমছিল। কিন্তু ২০১০–এর দশকের শুরুর দিকে শাকিবের জনপ্রিয় ছবির সংখ্যা কমতে থাকে। ২০১৬ সালে এসে চলচ্চিত্রে শাকিবের নতুন জন্ম হয়। ওই বছর বাংলাদেশ–ভারতের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত শিকারি ছবিতে নতুন রূপে চারদিকে সাড়া ফেলে দেন শাকিব খান। পরের বছরই যৌথ প্রযোজনার ছবি নবাব দিয়ে আরও একধাপ এগিয়ে যান শাকিব। এর কলকাতায় পরপর তিনটি ছবিতে এক নতুন শাকিবকে পাওয়া যায়। তাঁর পারিশ্রমিকও বেড়ে হয় তিন গুণ। দেশে বসগিরি, শ্যুটার, রংবাজ, অহংকার, চিটাগাইঙ্গা পোয়া নোয়াখাইল্যা মাইয়া, সুপার হিরো, শাহেনশাহ, পাসওয়ার্ড ছবি দিয়ে এই দশকেও শাকিব নিজের শীর্ষ স্থান ধরে রাখেন।