শিল্পী আর শিল্পে মুখর জয়নুল উৎসব
সারি সারি দোকান। সেখানে রাজশাহীর শখের হাঁড়ি, নারায়ণগঞ্জের হাতপাখা, মাগুরার শোলাশিল্প, বিক্রমপুরের শীতলপাটি, রাজশাহীর টেপা পুতুলসহ আরও কত যে লোকজ শিল্পকর্ম! বাংলার লোকজ শিল্পের পসরা বসেছিল ব্যস্ত শহরের চারুকলা অনুষদের প্রাঙ্গণজুড়ে। পাশেই দেশের আধুনিক শিল্পকলার পথিকৃৎ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সমাধি। বেলা একটু বাড়তেই সমাধির সবুজ ঘাস ভরে গেল ফুলে ফুলে। শ্রদ্ধায় ও ফুলেল শুভেচ্ছায় শুরু হলো শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ১০৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ‘জয়নুল উৎসব ২০১৯’।
আজ রোববার সকালেই নবীন-প্রবীণ শিল্পীদের সম্মিলনে মুখর হয়ে ওঠে মনোরম ক্যাম্পাস। সব মিলিয়ে গোটা চারুকলা প্রাঙ্গণে এখন বিরাজ করছে উৎসবের আমেজ। দেশের আধুনিক শিল্পকলার পথিকৃৎ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ১০৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজন করা হয়েছে তিন দিনের এ উৎসব।
আজ সকাল ১০টায় ‘জয়নুল উৎসব’ উদ্বোধন করেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান। এতে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ–উপাচার্য (প্রশাসন) মুহাম্মদ সামাদ, ডিবিএল গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান এম এ রহিম ফিরোজ, বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার এ কে এম সাদেক নেওয়াজ এবং প্রকৌশলী ময়নুল আবেদিন।
উদ্বোধন অনুষ্ঠানে জয়নুল সম্মাননা প্রদান করা হয় তিন শিল্পীকে। তাঁরা হলেন ভারতের শিল্পী জনক ঝংকার নার্জারি এবং বাংলাদেশের শিল্পী মাহামুদুল হক ও হামিদুজ্জামান খান।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, ‘জয়নুল আবেদিন আমাদের চারুকলার বিকাশে যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন, তা বাঙালি জাতি কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করবে। তিনি যেমন ছিলেন মহান শিল্পী, তেমনই ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক। দেশের লোকজ শিল্প, চারুকলার বিকাশে তিনি নিরন্তর কাজ করে গেছেন। পাশাপাশি দেশের সামগ্রিক সংস্কৃতির বিকাশেও কাজ করে গেছেন।’
শিল্পাচার্যের জন্মদিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ প্রতিবছর এই উৎসবের আয়োজন করে থাকে। আগামী মঙ্গলবার পর্যন্ত উৎসব সবার জন্য উন্মুক্ত। অনুষদের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা উৎসবে অংশ নিয়ে নিজেদের তৈরি নানা শিল্পকর্ম ও কারুপণ্য প্রদর্শন ও বিক্রি করছেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কারুশিল্পীরাও উৎসবে স্টল নিয়েছেন।
তার আগে চারুকলা অনুষদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা সকালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। পরে অতিথিরা ঘুরে দেখেন বিভিন্ন কারুশিল্পীর স্টল। পাশাপাশি দেশ-বিদেশের শিল্পীদের চিত্রকর্ম নিয়ে গড়া জাদুঘরও অতিথিরা ঘুরে দেখেন।
চারুকলা অনুষদের ডিন শিল্পী নিসার হোসেন বলেন, ‘শিল্পাচার্যের জন্মদিন উপলক্ষে আমরা শুধু জয়নুল মেলা নয়, আয়োজন করেছি লোকশিল্প ও জয়নুলবিষয়ক সেমিনার। তিন দিনের উৎসবে থাকবে আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা কিছু।’
উৎসব প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা যায়, চারুকলার লিচুতলা ও আশপাশে রয়েছে ২৪টি স্টল। স্টলগুলোয় তৈরি হচ্ছে লোকজ শিল্পকর্ম। কোথাও টেপা পুতুল, কোথাও মাটির শিল্পকর্ম তৈরি হচ্ছে। কোথাওবা আঁকা হচ্ছে চিত্রকর্ম।
আজ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ১০৫তম জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা জানিয়ে জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ শিল্পীর সমাধিসৌধে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করে। আধুনিক শিল্পকলাচর্চার প্রাণপুরুষ শিল্পাচার্যের জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা প্রাঙ্গণে জাতীয় জাদুঘর ও জেলা প্রশাসন ময়মনসিংহের যৌথ উদ্যোগে শোভাযাত্রা, শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, চিত্রকলা প্রদর্শনী, লোকজ মেলা, লোকসংগীত এবং জয়নুলের শিল্প ও শিল্পচিন্তা শীর্ষক সেমিনার আয়োজন করা হয়।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জন্ম বৃহত্তর ময়মনসিংহে, ১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর। তিনি ১৯৩৩ সালে কলকাতা সরকারি আর্ট স্কুলে ভর্তি হন এবং পাঁচ বছর অধ্যয়ন শেষে সেখানেই শিক্ষকতায় যোগ দেন। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের আর্তমানবতার কালজয়ী চিত্রকলা রচনার মধ্য দিয়ে তিনি খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। দেশভাগের পর ১৯৪৭ সালে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। তিনি ১৯৪৮ সালে তাঁর কয়েকজন সহযোগী মিলে গড়ে তোলেন ইনস্টিটিউট অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফট। এটি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ। শিল্পাচার্য এর অধ্যক্ষের দায়িত্ব নিয়ে মাত্র এক দশকের মধ্যেই প্রতিষ্ঠানটিকে দেশের চারুকলা আন্দোলনের কেন্দ্রে পরিণত করে তোলেন।
শিল্পাচার্যের জন্মদিনে শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে নিয়মিতভাবে জয়নুল উৎসবের আয়োজন শুরু হয় ১৯৮৮ সাল থেকে। প্রথম দিকে ছাত্ররাই এর আয়োজন করতেন। উৎসবটি বড় আয়োজনে করা হচ্ছে ২০০৯ সাল থেকে। বার্ষিক শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর পাশাপাশি প্রবর্তন করা হয়েছে ‘জয়নুল সম্মাননা’। যাঁরা শিল্পকলাচর্চা ও শিল্পশিক্ষার প্রসারে অবদান রেখেছেন, তাঁদের সম্মানিত করা হচ্ছে।
জয়নুল আবেদিন ১৯৭৬ সালের ২৮ মে ৬২ বছর বয়সে মারা যান।