এখনো শেফালী ঘোষ

শেফালী ঘোষের কণ্ঠে কর্ণফুলীর দুই তীরের মানুষের আনন্দ–বেদনার গল্প সুর হয়ে উঠেছিল। ছবি: প্রথম আলো
শেফালী ঘোষের কণ্ঠে কর্ণফুলীর দুই তীরের মানুষের আনন্দ–বেদনার গল্প সুর হয়ে উঠেছিল। ছবি: প্রথম আলো

উৎসবে, পার্বণে, মেলায় এখনো শেফালী ঘোষের গান ছাড়া কোনো অনুষ্ঠান জমে না চট্টগ্রামে। শুধু চট্টগ্রাম নয়, বাংলাদেশের যেকোনো অঞ্চলে তরুণ উদীয়মান শিল্পীরা শেফালীর গান গেয়ে দর্শক–শ্রোতাদের মাতিয়ে রাখেন। ২০০৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর তাঁকে হারিয়েছি আমরা। মৃত্যুর পর এক যুগেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে। কিন্তু শেফালী ঘোষ এখনো বেঁচে আছেন তরুণ শিল্পীদের সাধনায়, মানুষের প্রাণে প্রাণে।

শেফালী ঘোষের কণ্ঠে কর্ণফুলীর দুই তীরের মানুষের আনন্দ–বেদনার গল্প সুর হয়ে উঠেছিল। এই জনপদের সংস্কৃতি, জীবনাচার এবং মানুষের মনের কথা প্রতিধ্বনিত হয়েছে বারবার তাঁর গানে। তাই সেসব গান আজও বাতাসে ভেসে বেড়ায়। কর্ণফুলী যত দিন বয়ে চলবে, তত দিন শেফালী থাকবেন। কেননা, তাঁর গানে সূর্য ওঠার অসাধারণ বর্ণনার সঙ্গে প্রিয় বিরহের বেদনা একাকার যেমন হয়েছে, তেমনি চিরপ্রবহমান জলধারা কর্ণফুলীর কথাও উঠে এসেছে—‘সূর্য উডের অভাই লাল মারি/ রইস্যা বন্ধু যারগই আমার বুকে সেল মারি’ (চারদিকে লাল আভা ছড়িয়ে দিয়ে সূর্য উদিত হচ্ছে/ এ সময় আমার বুকে সেল মেরে যেন রসিক বন্ধু চলে যাচ্ছে)। ‘ছোড ছোড ঢেউ তুলি পানিত, লুসাই পাহাড়ত্তুন লামিয়ারে যারগই কর্ণফুলী’। (জলে ছোট ছোট ঢেউ তুলে, লুসাই পাহাড় থেকে নেমে কর্ণফুলী ধেয়ে যাচ্ছে) শেফালী ঘোষ বেশির ভাগ গান গেয়েছেন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায়। কিন্তু তাঁর সেই গানের সুর ছড়িয়ে পড়েছে চট্টগ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।

শুরুতে নজরুলগীতি ও আধুনিক গান করতেন শেফালী ঘোষ। ছবি: প্রথম আলো
শুরুতে নজরুলগীতি ও আধুনিক গান করতেন শেফালী ঘোষ। ছবি: প্রথম আলো

শুরুতে নজরুলগীতি ও আধুনিক গান করতেন শেফালী ঘোষ। ১৯৬৩ সালের কথা। বয়স তখন ২২। তখন চট্টগ্রাম বেতারের আঞ্চলিক পরিচালক ছিলেন আশরাফুজ্জামান। তিনি শেফালী ঘোষ আর আঞ্চলিক গানের সম্রাট শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবকে ডেকে পাঠালেন। প্রস্তাব দিলেন আঞ্চলিক ভাষায় গান গাওয়ার। দুজনে রাজি হলেন। ডেকে আনা হলো মলয় ঘোষ দস্তিদারকেও। তিনি এই দুই শিল্পীর জন্য গান বাঁধলেন। এ গানের কথায় মানুষের অন্তরের আকুলতা যেন কর্ণফুলীর ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছে—‘নাইয়র গেলে বাপর বাড়ি আইস্য তাড়াতাড়ি/ তোঁয়ারে ছাড়া খাইল্যা ঘরত থাইক্যুম কেন গরি?’ (বাপের বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছ, ফিরে এসো তাড়াতাড়ি। তোমাকে ছাড়া একা ঘরে কেমন করে থাকব?)। শেফালী ঘোষ আর শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবের সেই দ্বৈতকণ্ঠের গান নিয়ে হইচই পড়ে গেল। শেফালী ঘোষকেও আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান তাঁকে জনপ্রিয়তার এমন শীর্ষ এক পর্যায়ে নিয়ে গেল যে কোনো পালাগান, অনুষ্ঠান শেফালী ছাড়া জমল না। গ্রামে, গঞ্জে, পাড়ায় ছেলে-বুড়ো–যুবক সবার মুখে শেফালীর গান। তাই তো তাঁর জন্য গান লিখলেন উপমহাদেশ খ্যাত রমেশ শীল, আবদুল গফুর হালী, এম এন আখতার, কবিয়াল এয়াকুব আলী, সৈয়দ মহিউদ্দিন, অচিন্ত্য কুমার চক্রবর্তী, চিরঞ্জিত দাশ, মোহাম্মদ নাসির, মোহন লাল দাশরা। তাঁদের লেখা সেসব গান শেফালীর জাদুকরি কণ্ঠে এসে মানুষের হৃদয় কেড়ে নিল, আর তাদের মুখে ফিরতে ফিরতে একধরনের লোকগানের মর্যাদায় অমর হয়ে গেল। মানুষ কি ভুলবে সেই কথাগুলো—‘আঁধার ঘরত রাত হাডাইয়ুম হারে লই’, ‘ওরে সাম্পানওয়ালা তুই আমারে করলি দেওয়ানা’, ‘পালে কী রং লাগাইলিরে মাঝি’, ‘সাম্পানে কি রং লাগাইলি’, ‘নাতিন বরই খা বরই খা হাতে লইয়া নুন’।

১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের পর উপকূলে মানুষের হাহাকার। ঝড়ের ধ্বংসযজ্ঞের পর তখনো হতবিহ্বল মানুষ ও প্রকৃতি। ঠিক সেই সময় তিনি গাইলেন এক অসাধারণ গান।
গর্কি, তুয়ান, বইন্যা, খরা, মহামারি, ঘূর্ণিঝড়
ভাসাই মারে, ধ্বংস গড়ে
মাইনস্যে তো আর বই ন রয়
অক্কল হামর ধান্দা চলের,
আবার নতুন সৃষ্টি হর।
(গর্কি, তুফান, বন্যা, খরা, মহামারি আর ঘূর্ণিঝড় এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, ধ্বংস করে দেয়। মানুষ তারপরও বসে থাকে না। সব কাজের গতি থেমে নেই। নতুন করে আবার সৃষ্টি হচ্ছে)

শিল্পী হিসেবে শ্রেষ্ঠ যে পুরস্কারটি তিনি পেয়েছেন, তা হচ্ছে অগুনতি মানুষের ভালোবাসা। ছবি: সংগৃহীত
শিল্পী হিসেবে শ্রেষ্ঠ যে পুরস্কারটি তিনি পেয়েছেন, তা হচ্ছে অগুনতি মানুষের ভালোবাসা। ছবি: সংগৃহীত

সৈয়দ মহিউদ্দিনের লেখা এটি এক আশ্চর্য উদ্দীপক গান। ধ্বংসস্তূপ থেকে মাথা তুলে দাঁড়াতে এই সুরেলা প্রেরণা সেদিন শেফালী ঘোষের কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এসেছে। সেই গানেরই একটি কথা ...
‘ভাঙা গাছর নয়া টেইল/ পাতা মেতিল দেহার খেইল/ পঙ্খি আবার উডের ঘুরের, চুপপে প্রেমর কথা হর’ (ভাঙা গাছের নতুন শাখায় নতুন পাতা মেলে কী খেলা দেখাচ্ছে। পাখিরা আবার উড়ছে, ঘুরছে। চুপিসারে প্রেমের কথা বলছে)

শুনতে শুনতে গায়ে শিহরণ জেগেছিল। অগুনতি মানুষের কান্নার ভেতর, হাহাকারের ভেতর, বিলাপের ধ্বনির ভেতর এই গান শুনে সেদিন প্রতি রোমকূপে জীবনের পুলক জেগেছিল।

আমাদের গৌরবময় ঐতিহ্যের হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো রয়ে যাবে শেফালীর গানে। শিল্পী হিসেবে শ্রেষ্ঠ যে পুরস্কারটি তিনি পেয়েছেন, তা হচ্ছে অগুনতি মানুষের ভালোবাসা। অবশ্য ২০০৬ সালে মৃত্যুর এক বছর পর রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছিলেন একুশে পদক।