ভিউ গুনে পার করল গানের ভুবন

এ বছর রুনা লায়লার সুর করা ও গাওয়া ‘ফেরাতে পারিনি’ গানের ভিডিওতে মডেল হয়েছেন নিলয় ও নাদিয়া।  ছবি: সংগৃহীত
এ বছর রুনা লায়লার সুর করা ও গাওয়া ‘ফেরাতে পারিনি’ গানের ভিডিওতে মডেল হয়েছেন নিলয় ও নাদিয়া। ছবি: সংগৃহীত

এক দিনে অমুক শিল্পীর গানের ভিউ ১০ লাখ। আবার দুই দিনে ১৫ লাখ ভিউর মাইলফলক স্পর্শ করেছে তমুক শিল্পীর গান। কোনো কোনো গান আবার লাখ, মিলিয়ন কিংবা কোটি ভিউ স্পর্শ না করলেও গানগুলো দর্শক-শ্রোতাদের ঠিকই ভালো লেগেছে। ইদানীং গানে ভিউ মানদণ্ড হিসেবে ধরার একটা প্রবণতা কাজ করেছে। এখন পর্যন্ত এভাবে কেটেছে বছরের সংগীতাঙ্গন।

‘ভিউতে খুব ক্ষতি হচ্ছে। ভালো কিছু করার দিকে নজর নেই। ভালো কিছু হচ্ছে না, তা নয়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খারাপ কিছু, আজব কিছুই দেখি ভাইরাল হয়। এখন বেশির ভাগ এই সস্তা ভাইরালে মেতে আছে। এ বছরেও এমনটা চোখে পড়েছে।’ বললেন বরেণ্য শিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদী।

সংগীতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, বছরের শুরুতে কিছুটা স্থবির ছিল দেশের সংগীতাঙ্গন। বছরের শেষ দিকে চাঙা হওয়ার পথে এগিয়েছে বলে মনে করছেন সুরকার ও সংগীত পরিচালক প্রিন্স মাহমুদ। তাঁর কথার প্রমাণও মেলে। বছরের শেষ দিকে অডিও ইন্ডাস্ট্রিতে সবচেয়ে বড় চমক ছিল উপমহাদেশের বরেণ্য সংগীতশিল্পী রুনা লায়লা। গুণী এই সংগীতশিল্পীর সুরে দেশের সংগীতাঙ্গনে বাংলা গান নিয়ে অভিষেক ঘটে আশা ভোসলে, হরিহরণ, আদনান সামী ও রাহাত ফতেহ আলী খানের মতো শিল্পীদের।

এ ছাড়া বছরজুড়ে একক ও দ্বৈত গান নিয়ে নিয়মিত দর্শক-শ্রোতার সামনে হাজির হন বিভিন্ন প্রজন্মের শিল্পীরা। বিভিন্ন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের হিসাবমতে, ভিডিও, ভিডিও ছাড়া এ বছর হাজারখানেকের মতো গান প্রকাশিত হয়েছে। সিএমভির কর্ণধার শেখ সাহেদ আলী পাপ্পু বলেন, ‘ব্যবসায়িকভাবে বছরের শুরুতে একটা চিন্তা ছিল। এখন তা ভালোর দিকে যাচ্ছে। এ বছর আনুপাতিক হারে মানহীন কাজ কম হয়েছে। ভালো মানের শিল্পীদের গান প্রকাশের হার বেড়েছে। ভালো কথার গান নিয়েও সবাই ভাবছে। আগামী বছর সুফল ভোগ করবেন সবাই। দেশে গান শোনার প্রধান মাধ্যম ইউটিউব, অ্যাপ তৈরি হলে এই চিত্র আরও বদলে যাবে।’

ভালো আয় হলেই বেশি বিনিয়োগ করা যায়। ব্যবসায়িক ব্যাপারটা প্রত্যাশিত না হওয়ায় ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তারকা ও অভিজ্ঞ শিল্পীদের গানে বেশি মাত্রায় বিনিয়োগ করা যাচ্ছে না বলে মত দিয়েছেন ধ্রুব মিউজিকের কর্ণধার ধ্রুব গুহ। তিনি বলেন, ‘গানে এখন আয়ের বড় মাধ্যম রিংব্যাক টিউন। মুষ্টিমেয় হাতে গোনা কয়েকজন শিল্পীর গান রিংব্যাক টিউন হয়। ইউটিউব আয়ে অসামঞ্জস্য আছে। আমাদের ভিন্ন পথ খুঁজতে হবে। অ্যাপ হতে পারে আমাদের সেই নির্ভরতা। আয়ের বিষয়গুলো পরিষ্কার না হওয়ায় মানসম্পন্ন গান বেশি হচ্ছে না। তারকা ও অভিজ্ঞ শিল্পীর জন্য গান করতে গেলে সম্মানীও বড় একটা ব্যাপার। একজন নতুন শিল্পীর পেছনে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়, তারকা শিল্পী ও সত্যিকারের শিল্পীদের ক্ষেত্রে সংগত কারণে বিনিয়োগ বেশি হতে হয়।’

নতুন কোনো গান প্রকাশের খবর পেলেই ইউটিউবে শোনেন এবং দেখার চেষ্টা করেন গীতিকবি মোহাম্মাদ রফিকুজ্জামান। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, একটা করে গান হয়, ইউটিউবে চলে যায়। অনেক অনেক ভিউ হয়, কিন্তু তেমন সাড়া পাওয়া যায় না। সংগীতাঙ্গনে ২০১৯ সালের মূল্যায়ন করতে গিয়ে এই গীতিকবি বলেন, ‘ইদানীং আমাদের গানবাজনার বড় বেশি ক্ষতি হয়ে যাচ্ছ। শিল্পী, সংগীত পরিচালক সবাই আলাদা হয়ে যাচ্ছে। কখন, কোথায় গান হচ্ছে—কারও সঙ্গে কারও দেখা নেই, মতবিনিময় হয় না। এই একা হয়ে যাওয়াটা সংগীতজগতের জন্য অসম্ভব ক্ষতিকর। গান হচ্ছে, কিন্তু কারও সঙ্গে কারও সংযোগ নেই। সস্তা জনপ্রিয়তার দিকে ছুটছি, খুব ভয়ংকর।’

সৈয়দ আব্দুল হাদী বলেন, মানুষের জীবনবোধ, মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটেছে। সংস্কৃতি ক্ষেত্রেও শিল্প ও নান্দনিকতার জায়গা দখল করে নিচ্ছে নিছক বিনোদন। সংগীতের ওপরও এগুলোর প্রভাব পড়ছে। সংগীতও তাই নিছক বিনোদনমুখী হয়ে যাচ্ছে।

প্রিন্স মাহমুদের মতে, বছরের শুরুতে একটু স্থবির ছিল এই অঙ্গন। বছর শেষে আবার ভালোর দিকে যাচ্ছে বলে মনে হয়েছে।