স্বাগত নতুনেরা : রসায়ন, পদার্থ আর মডেলিংয়ের শিলা

শিরিন আক্তার শিলা
শিরিন আক্তার শিলা

‘আপু আপনি কেন বাসে যাচ্ছেন?’
ইদানীং এমন প্রশ্ন প্রায়ই শুনতে হয় শিলাকে। শিরিন আক্তার শিলা, যিনি সদ্যই বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করে এসেছেন মিস ইউনিভার্সের মঞ্চে। অনেকের চোখে তাঁর বাসযাত্রা না মানালেও তিনি ক্লাস করতে যান বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে চড়ে। বললেন, ‘আমি জীবনটাকে সাধারণ মানুষ হিসেবে উপভোগ করতে চাই।’

সবাই হয়তো ভাবে, মিস ইউনিভার্স বাংলাদেশ গাড়ি থেকে নেমে ক্লাস করবেন, আবার গাড়ি করে বাড়ি ফিরে যাবেন। শিলা হেসে দিয়ে বললেন, ‘সবে খেতাব পেয়েছি। এখনই কীভাবে বাড়ি–গাড়ি করব? আরও অনেক কিছু করতে হবে।’ মিস ইউনিভার্স বাংলাদেশ ২০১৯–এর সঙ্গে আড্ডাটা তখন জমে উঠছে। 

যেখানে শিলার শুরু
কী কী করতে হবে, জানার আগে শিলার জীবনবৃত্তান্তটা একটু জানতে চাইলাম। অকপটে বলে ফেললেন, ‘আমি গ্রামের মেয়ে। ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জে জন্ম ১৯৯৯ সালে। বাবা বিজিবিতে চাকরি করায় বদলি হতে হয়েছে বেশ কয়েকবার। প্রথম পাঁচ বছর পীরগঞ্জে থাকার পর জামালপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, আবার ঠাকুরগাঁওয়ে থেকে ঢাকায় এসেছি ২০১৪ সালে।’ শিলা এখন পড়ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে, স্নাতক তৃতীয় বর্ষে। পরিবারে আছেন বাবা আবদুল গফুর, মা মোহসিনা আক্তার ও ভাই শাহিন হোসেন। এ ছাড়া একই ছাদের নিচে থাকেন খালা–খালু আর একগাদা খালাতো ভাইবোন। হইহুল্লোড় আর আনন্দে কাটে পরিবারিক সময়টা। সবার সমর্থনেই কি তাহলে এত দূর আসা শিলার? ‘আসলে প্রথমে কারও সমর্থন পাইনি। আমাদের পরিবারে কেউ আগে কখনো গণমাধ্যমের সঙ্গে জড়িত ছিল না, বিনোদনজগতের সঙ্গে তো না–ই। সবার এই পরিসরটা নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব ছিল। পড়াশোনায় ক্ষতি হবে ভেবে মা–বাবাও রাজি ছিলেন না। একমাত্র বড় ভাইয়ের সমর্থনে সাহস করে এত দূর এসেছি। তারপর মিস ইউনিভার্স বাংলাদেশ হওয়ার পর থেকে সবাই যেমন সমর্থন করে, তেমনই গর্ব করে।’ 

শিরিন আক্তার শিলা
শিরিন আক্তার শিলা

পদার্থবিদ্যা বনাম মডেলিং
এখন মিস ইউনিভার্সের যাত্রার গল্পটা তো জানতে হয়। নড়েচড়ে বসে শিলা শুরু করলেন গল্প বলা, ‘যাত্রা কিন্তু মিস ইউনিভার্স বাংলাদেশ দিয়ে শুরু হয়নি।’ তাহলে? ‘শুরু হয়েছে মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ ২০১৮ দিয়ে।’ তারপর? ‘মুকুটটা ঐশী জিতে নিল’, হেসে দিয়ে বললেন শিলা। তবে ২০১৯ সালে মডেল খোঁজার প্রতিযোগিতা ‘ফেস অব বাংলাদেশ’–এ চ্যাম্পিয়ন হয়ে ‘ফেস অব এশিয়া’–তে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ঠিক এর পরপরই সুযোগ আসে মিস ইউনিভার্স বাংলাদেশের। ফলাফল এখন ইতিহাস। হঠাৎ করে পরিকল্পনা ছাড়া ২০১৮ সালে মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিলেন শিলা। এরপর থেকে শুরু করেন মডেলিং। পদার্থবিদ্যা পড়ে মডেলিং সামলানোটা চাট্টিখানি কথা! অথচ দিব্যি সব সামলে নিচ্ছেন শিলা। বললেন, ‘ক্লাস করছি নিয়মিত। তবে যেদিন কাজ থাকে, সেদিন ক্লাস করা হয় না। বন্ধুরা পরে সাহায্য করে।’ মডেলিং করে শিলা হয়তো কঠিন বিষয় নিয়ে পড়তে পারবেন না—একটা সময় শিক্ষকেরা এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করতেন। কিন্তু এখন খুব গর্ব করেন তাঁদের শিক্ষার্থীকে নিয়ে। যদিও রসায়ন ছিল শিলার প্রিয় বিষয়, কিন্তু ভাগ্যে ছিল পদার্থবিজ্ঞান। কী আর করা!

শিলার অনেক স্বপ্ন
‘আমার স্বপ্ন অনেক, সেগুলো আবার বদলায়ও’, শিলার চোখেমুখে আত্মবিশ্বাসের ঝলক। জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে কি শুধু মডেল হতে চাননি? হাসতে হাসতে বললেন, ছোটবেলা থেকেই একেক সময় একেকটা হতে ইচ্ছা করে। কখনো ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড়, কখনো অভিনেত্রী, কখনোবা ইচ্ছা করে কারাতে শিখতে। এ রকম আরও অনেক কিছু। মনে হয় এখন সময় এসেছে স্বপ্নগুলো ধীরে ধীরে সত্যি করার। অবাক করে দিয়ে জানালেন, শুধু মডেল নন, শিক্ষকও হতে চান তিনি। অন্য দেশের সব মিস ইউনিভার্সদের মতো সমাজসেবা করার স্বপ্নও আছে তাঁর। বৃদ্ধদের নিয়ে কাজ করতে চান তিনি। তবে একা এই যুদ্ধে পেরে ওঠা সম্ভব নয়। তাই শিলা সাহায্য চান সবার কাছে।

যা আছে পরিকল্পনায়
আপাতত তেমন কোনো পরিকল্পনা নেই শিলার মাথায়। পড়ালেখা আর মডেলিং চালিয়ে যাবেন মন দিয়ে। অভিনয়ে আসবেন কি না, জানতে চাইলে বলেন, ‘ইচ্ছা আছে, তবে এর আগে অভিনয় শিখতে চাই। এখন ভাবছি শেখার জন্য কোনো স্কুলে ভর্তি হওয়া যায় কি না।’

দিনলিপি
শিলার দিন হয় দুই ধরনের। একটা কাজের দিন, আরেকটা ক্যাম্পাসের দিন। যেদিন কাজ থাকে, সেদিন আর ক্যাম্পাসে যাওয়া হয় না। সারা দিন কাজেই চলে যায়। বাসায় ফিরে পরিবারের সবার সঙ্গে আড্ডা আর হইচই করে কাটানো হয়। আর যেদিন কাজ থাকে না, সেদিন সকাল সাতটায় বাসে করে শ্যামলী থেকে রওনা হন ক্যাম্পাসের উদ্দেশে। সারা দিন ক্লাস থাকলে সেদিন ক্লাস শেষে বাসায় ফিরে যান। যেদিন দুপুরের মধ্যে ক্লাস শেষ হয়, সেদিন জমে বন্ধুদের সঙ্গে জম্পেশ আড্ডা। আড্ডাতেই বোঝা গেল আড্ডা দিতে কতটা ভালোবাসেন তিনি। ৫ ফুট ১১ ইঞ্চির এই মডেল নিয়মিত জিমে যান না। যেন অপরাধীর মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, ‘মাঝে মাঝে যাই।’ 

‘জিরাফ’ শিলা
রাস্তাঘাটে বের হয়ে এখনো খ্যাতির বিড়ম্বনায় পড়েননি আমাদের মিস ইউনিভার্স বাংলাদেশ। ক্যাম্পাসে গেলে যখন দূর থেকে কেউ চিৎকার করে বলে, ‘ওই যে শিলা, শিলা’, তখন নাকি ভালোই লাগে তাঁর। বন্ধুরা শিলা নামে কমই ডাকে। বললেন, ‘বন্ধুরা মজা করে কখনো ডাকে খাম্বা, কখনো ডাকে জিরাফ। কেউ আবার ডাকে তালগাছ।’ না, একদম বিব্রত হন না তিনি। বরং ‘জিরাফ’ নামটা বেশ পছন্দ তাঁর। শিলার মতে জিরাফ একটা ‘কিউট’ প্রাণী।