সারা দেশের শিল্পী নিয়ে বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক উৎসব

অতিথিরা জাতীয় নাট্যশালার সামনে রংবেরঙের বেলুন উড়িয়ে উৎসবের উদ্বোধন করেন।  ছবি: প্রথম আলো
অতিথিরা জাতীয় নাট্যশালার সামনে রংবেরঙের বেলুন উড়িয়ে উৎসবের উদ্বোধন করেন। ছবি: প্রথম আলো

বৃষ্টিভেজা শিল্পকলার সবুজ চত্বর। ভরা পৌষের সন্ধ্যায় শীতটাও বেশ জমেছে। এমন পরিবেশে জাতীয় নাট্যশালায় নানা দেশি–বিদেশি বাদ্যযন্ত্রে বেজে উঠল ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ গানের সুর। মুহূর্তেই যেন শীত পালাল। একটু পরেই আরেকটি গান, ‘আজ কেন মোর প্রাণ সজনি গো আমার মন করে উতলা’। গানের সঙ্গে দলীয় নৃত্য। গানের তালে তালে করতালি দিয়ে আর গেয়ে অনেকে শামিল হলেন গানে। শুরু হলো বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক উৎসব। বলা হচ্ছে, এটি এ–যাবৎকালের সর্ববৃহৎ সাংস্কৃতিক উৎসব। সারা দেশ থেকে আসা শিল্পীরা অংশ নিচ্ছেন এ উৎসবে।

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি বহুমুখী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। এর লক্ষ্য জাতীয় সংস্কৃতি ও কৃষ্টির উন্নয়ন, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও প্রসারের মাধ্যমে শিল্প-সংস্কৃতিঋদ্ধ সৃজনশীল মানবিক বাংলাদেশ গঠন। এরই ধারাবাহিকতায় শুক্রবার শুরু হলো ‘বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক উৎসব ২০২০’। দেশের ৬৪টি জেলা, ৬৪টি উপজেলা এবং জাতীয় পর্যায়ের পাঁচ হাজারের বেশি শিল্পী ও শতাধিক সংগঠনের অংশগ্রহণে ২১ দিনব্যাপী একাডেমির নন্দন মঞ্চে এ উৎসব চলবে।

পরিকল্পনা ছিল শিল্পকলা একাডেমির খোলা চত্বরের নন্দন মঞ্চে হবে উৎসবের উদ্বোধন। কিন্তু সে পরিকল্পনায় সায় ছিল না আবহাওয়ার। বৃষ্টির ঝাপটায় অনুষ্ঠান যেন ভিজে না যায়, তাই জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে স্থানান্তর করা হয়।

উদ্বোধনী আয়োজনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবু হেনা মোস্তফা কামাল। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন একাডেমির সচিব মো. বদরুল আনম ভূঁইয়া। অতিথিরা জাতীয় নাট্যশালার সামনে বেলুন উড়িয়ে উৎসবের উদ্বোধন করেন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘জাতিগঠনের মূল ভিত্তি আমাদের সংস্কৃতি। বর্তমান পৃথিবীতে চীনের যে উত্থান, তার পটভূমি কিন্তু সাংস্কৃতিক বিপ্লব। এই বাংলার বাইরে সারা বিশ্বে আমাদের সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান ছড়িয়ে আছে। আজকের যে স্বাভাবিকতা, স্বাধীনতা আমরা ভোগ করছি, এর কারণ আমরা বাঙালি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছি। আমি আশ্বস্ত করছি, আমার যেটুকু সাধ্য, আমি সহযোগিতা করব।’ তিনি ইতিহাস ঐতিহ্যমুখী বাস্তবসম্মত প্রকল্প হাতে নেওয়ার অনুরোধ জানান শিল্পকলা একাডেমির কাছে।

উদ্বোধকের বক্তব্যে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘যতবার এই মঞ্চে দাঁড়াই, ততবারই জাতির পিতার কথা মনে পড়ে। কারণ, তিনি এই শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেছেন। বছরের প্রথমেই এ উৎসব শুরু হতে যাচ্ছে। এরপর আমরা ৬৪টি জেলায় সাংস্কৃতিক উৎসব আয়োজন করব। সর্বশেষ উৎসব হবে ঢাকায়। এভাবে সব জেলা উপজেলায় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’

জাতীয় নাট্যশালায় ‘বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক উৎসব ২০২০’–এর উদ্বোধনীতে সমবেত নৃত্য পরিবেশনা। ছবি: শিল্পকলা একাডেমির সৌজন্যে।
জাতীয় নাট্যশালায় ‘বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক উৎসব ২০২০’–এর উদ্বোধনীতে সমবেত নৃত্য পরিবেশনা। ছবি: শিল্পকলা একাডেমির সৌজন্যে।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব বলেন, ‘মুজিব বর্ষ উদ্‌যাপনের প্রাক্কালে বড় এ আয়োজনে প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিল্পীদের মেলবন্ধনের চেষ্টা করা হয়েছে। সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডকে মানুষের কল্যাণে কাজে লাগানোর জন্য আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা দরকার। সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে জাগিয়ে তোলা দরকার। মানুষের দেহের পুষ্টি খাবার, মনের পুষ্টি সংস্কৃতি। বিভিন্ন পরিবেশনার মধ্য দিয়ে নগরবাসী সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদানের সঙ্গে পরিচিত হবে, মনের ক্ষুধা মিটবে।’

সভাপতির বক্তব্যে মহাপরিচালক লিয়াকত আলী বলেন, ‘এটি হবে এ–যাবৎকালের সর্ববৃহৎ সাংস্কৃতিক উৎসব। শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে, মানবিক মূল্যবোধে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালন যে সংস্কৃতির কথা বলেছেন, বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্নটা দেখেছিলেন, তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে চলেছি।’

লিয়াকত আলী আরও জানান, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক উৎসবের পরিবেশনার মধ্যে থাকবে সমবেত সংগীত, যন্ত্রসংগীত, ঐতিহ্যবাহী লোকজ খেলা, পালা, একক সংগীত, বাউলসংগীত, ঐতিহ্যবাহী লোকনাট্য, যাত্রা, সমবেত নৃত্য, অ্যাক্রোবেটিক, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা, পুতুল নাট্য, একক আবৃত্তি, শিশুদের পরিবেশনা, বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সংগীত ও নৃত্য, নাটকের কোরিওগ্রাফি, বৃন্দ আবৃত্তি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের পরিবেশনা, আঞ্চলিক ও জেলা ব্র্যান্ডিং–বিষয়ক সংগীত ও নৃত্য এবং জেলার ঐতিহ্যবাহী ভিডিও চিত্র প্রদর্শনী। উৎসবে প্রতিদিন তিনটি জেলা, তিনটি উপজেলা, জাতীয় পর্যায়ের শিল্পী ও সংগঠনের পরিবেশনা থাকবে। এ ছাড়া একাডেমি প্রাঙ্গণে প্রতিদিন রাত আটটা থেকে একটি লোকনাট্য পরিবেশিত হবে।

জাতীয় নাট্যশালায় ‘বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক উৎসব ২০২০’–এর উদ্বোধনীতে শিল্পকলা একাডেমির শিল্পীদের সমবেত নৃত্য পরিবেশনা। ছবি: প্রথম আলো
জাতীয় নাট্যশালায় ‘বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক উৎসব ২০২০’–এর উদ্বোধনীতে শিল্পকলা একাডেমির শিল্পীদের সমবেত নৃত্য পরিবেশনা। ছবি: প্রথম আলো

আজ প্রথম দিনে উদ্বোধনী আয়োজনের পর ময়মনসিংহ ও গোপালগঞ্জ জেলার পরিবেশনা অনুষ্ঠিত হয়। জেলার পরিবেশনা শেষে একাডেমি প্রাঙ্গণে রাত আটটায় শুরু হয় ঝিনাইদহ যাত্রাদলের যাত্রাপালা।