এ আর রাহমান সুর করেন না, তবে...

‘জয় হো’ গানের জন্য অস্কার পেয়েছেন এ আর রাহমান। ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া
‘জয় হো’ গানের জন্য অস্কার পেয়েছেন এ আর রাহমান। ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া

‘কারও মধ্যে যদি দেওয়ার বাসনা থাকে, তাহলেই তিনি কঠোর পরিশ্রম করে যেতে পারেন। শিল্পীদের ক্ষেত্রে এ সুবিধা অপার। আপনি গানকে দিচ্ছেন, এই শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা লাখ লাখ মানুষকে দিচ্ছেন, দেশ-বিদেশের কোটি কোটি শ্রোতাকে দিচ্ছেন। এই দেওয়া আপনাকে ক্রমাগত সামনের দিকে নিয়ে যেতে পারে। বিপদ ঘটে যখন আপনার মধ্যে নেওয়ার বাসনা জেগে ওঠে। আপনি যখন দিতে থাকেন, তখন সেটা আপনাকে শুধু সামনেই এগিয়ে নিয়ে যায় না, আপনার মধ্যে আনন্দের জন্ম দেয়। কারণ জীবন তখন আপনার সামনে একটি অর্থ নিয়ে এসে দাঁড়ায়।’ বললেন ভারতীয় সুরকার, গায়ক, গীতিকার এ আর রাহমান।

২০১৪ সালে প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বছরের পর বছর সংগীতাঙ্গনে টিকে থাকা এবং ক্রমাগত সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে বলেছিলেন তিনি। উপমহাদেশের গুণী এই শিল্পীর আজ জন্মদিন। ৫৩ পেরিয়ে আজ ৫৪ বছর ছুঁয়েছেন দু-দুটো অস্কারজয়ী সুরকার ও সংগীতজ্ঞ এ আর রাহমান।

১৯৬৭ সালের ৬ জানুয়ারি মাদ্রাজের এক সংগীত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এ এস দিলীপ কুমার। মাদ্রাজের নাম এখন চেন্নাই, এ এস দিলীপ কুমারের নাম এ আর রাহমান। পুরো নাম ‘আল্লাহ রাখা রাহমান’।

লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে এ আর রাহমান। ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া
লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে এ আর রাহমান। ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া

কৈশোরে পরিবারের দায়িত্ব
বাবা আর কে শেখর ছিলেন তামিল এবং মালায়ালাম সুরকার। ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে স্টুডিওতে ঘুরতে যেতেন ছেলে দিলীপ কুমার। ৪ বছর বয়সেই তিনি পিয়ানো শিখেছিলেন। ওই সময় থেকে ছোট্ট দিলীপের ঝোঁক ছিল ইলেকট্রনিকসের প্রতি। তবে বাবা যখন একটি মিউজিক সিনথেসাইজার কিনে আনেন, তখন সংগীতের প্রতি তাঁর আগ্রহ বেড়ে যায়। এর আর রাহমানের (তখন নাম ছিল দিলীপ) বয়স যখন ৯ বছর, তখন হঠাৎ বাবা মারা যান।
বাবার মৃত্যুর পর ৯ বছরের বালক দিলীপের ওপর পরিবারের আর্থিক দায়ভার নেমে আসে। বাবার গানের বাদ্যযন্ত্র এবং শব্দযন্ত্রগুলো ভাড়া দিয়ে কোনো ভাবে দিন কাটছিল তাঁদের। মা কারীমার (পূর্বনাম কস্তূরী) কষ্টে-সৃষ্টে বড় করছিলেন তাঁদের। ১১ বছর বয়সে কি-বোর্ড শিল্পী হিসেবে ইলাইয়া রাজার দলে যোগ দেন। ছোটবেলার বন্ধু শিভামনি, জন অ্যান্থনি, সুরেশ পিটার, জোজো ও রাজার সঙ্গে ‘রুটস’ নামের একটি ব্যান্ড গড়ে তোলেন দিলীপ। চেন্নাইভিত্তিক এই রক ব্যান্ডের নাম দেওয়া হয় ‘নেমেসিস অ্যাভিনিউ’।
সংগীতে এ আর রাহমানের হাতেখড়ি ওস্তাদ ধনরাজের হাত ধরে। দ্রুত ভোকাল, গিটার, পারকিউশন, ড্রাম, ফিংগার বোর্ড, কিবোর্ড, পিয়ানো, অ্যাকর্ডিয়ন, ড্রাম প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রে দক্ষ হন তিনি। তার প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে এম এস বিশ্বনাথন, রমেশ নাইড়ু, রাজ কোটির মতো নামি সুরকারও দিলীপকে তাঁদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ দেন। ওস্তাদ জাকির হোসেন, কুন্নাকুড়ি বাইদ্যোনাথন এবং এল শংকরের সঙ্গে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা সে বয়সে হয়। পরে মাদ্রাজে পড়ালেখা করার সময় স্থানীয় একটি স্কুল থেকে ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিকে ডিপ্লোমা করেন তিনি।
১৯৮৪ সালে দিলীপের ছোট বোন মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন এক ঘটনায় ১৯৮৯ সালে পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে ধর্মান্তরিত হন ২৩ বছরের দিলীপ। নামও পরিবর্তিত হয়ে দিলীপ কুমার থেকে হয়ে যায় আল্লাহ রাখা রাহমান, সংক্ষেপে এ আর রাহমান।

ভালো সংগীতজ্ঞই নন, অসম্ভব বিনয়ী এ আর রাহমান। ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া
ভালো সংগীতজ্ঞই নন, অসম্ভব বিনয়ী এ আর রাহমান। ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া

ভেবেছিলেন ‘রোজা’ তাঁর প্রথম ও শেষ ছবি
শুরুর দিকে এ আর রাহমান ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে প্রামাণ্যচিত্রের জন্য সংগীত পরিচালনা করতেন। ১৯৮৭ সালে তিনি ঝুঁকে পড়েন বিজ্ঞাপনের দিকে। ১৯৮৯ সালে ‘পাঞ্চাথান রেকর্ড ইন’ নামের ছোট একটি স্টুডিওর মাধ্যমে নিজস্ব সংগীত জগতের সূচনা করেন। পরে এটি ভারতের অন্যতম সেরা সাউন্ড রেকর্ডিং স্টুডিও হিসেবে নাম করে।
ওই সময় অ্যাডভারটাইজিং অ্যাওয়ার্ডের এক অনুষ্ঠানে এ আর রাহমানের সঙ্গে দেখা হয় ভারতের অন্যতম সেরা পরিচালক মণি রত্নমের। এ আর রাহমান নিজের তৈরি কিছু সুরের নমুনা দেখান মণি রত্নমকে। সেই সুরগুলো মণি রত্নম এতটাই পছন্দ করেন, সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে নিজের পরবর্তী তামিল ছবি ‘রোজা’র গানের সুরকার ও সংগীত পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেন। এই সিনেমা তাঁকে দেশজোড়া খ্যাতি, সাফল্য আর পরিচিতি এনে দেয়।
অবশ্য নিজেও ভাবেনি প্রথমেই এতটা সফলতা তাঁর ক্যারিয়ারে আসবে। প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপেই তিনি বলেছিলেন, ‘তখনো আমার মাথায় এমন কোনো ভাবনা একেবারেই ছিল না যে ভবিষ্যতে আমি আরও কোনো ছবি করার সুযোগ পাব। আমি ভেবেছিলাম, “রোজা” আমার প্রথম ও শেষ ছবি। ফলে ব্যাপারটা আমার কাছে ছিল অনেকটা এ রকম, অবসর নেওয়ার আগে জীবনের শেষ ছবিতে সংগীতের কাজটুকু সেরে নাও। যতটা সম্ভব একেবারে সেরা উপায়ে।’
তিনি বলেন, ‘তখন আমার মধ্যে একধরনের আধ্যাত্মিক অনুভবের উন্মেষ ঘটছিল। সুফি-জাতীয় বিষয়াদির সঙ্গে আমি জড়িয়ে পড়েছিলাম। একটি অজানা প্রত্যয় আমার মধ্যে ভর করেছিল। গানগুলোর সুর যেন ঠিক আমি নিজেই করিনি, বরং গানগুলো আমার মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল।’
১৯৯৫ সালে এ আর রাহমান তাঁর প্রথম হিন্দি ভাষার সিনেমা ‘রঙ্গিলা’র গানের সুর ও সংগীত পরিচালনা করেন। ‘রঙ্গিলা’র দুর্দান্ত সাফল্য বলিউডে তাঁর যাত্রা শুভ করে। একে একে তিনি ‘বোম্বে’, ‘দিল সে’, ‘তাল’, ‘জুবাইদা’, ‘লগন’-এর মতো দারুণ ব্যবসাসফল সব চলচ্চিত্রের গানের সুর ও সংগীত পরিচালনা করে নিজের অবস্থান পোক্ত করেন।

‘ফুটবল জাদুকর’ পেলের সঙ্গে এ আর রাহমান। ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া
‘ফুটবল জাদুকর’ পেলের সঙ্গে এ আর রাহমান। ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া

অগণিত পুরস্কার আর কোটি মানুষের ভালোবাসা
বলিউডে কাজ করার পাশাপাশি তিনি তার সুরের প্রভাব বিস্তার করা শুরু করেন হলিউডেও। ‘ইনসাইড ম্যান’ এবং ‘এলিজাবেথ: দ্য গোল্ডেন এজ’ চলচ্চিত্রে কাজ করেন। তবে ‘স্লামডগ মিলিয়নিয়ার’ চলচ্চিত্রের ‘জয় হো’ গানের মাধ্যমে পশ্চিমা দুনিয়ায় ভালো সাড়া ফেলেন তিনি। এই গানের জন্য তিনি অস্কার পান। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় সেরা সংগীত পরিচালক হিসেবে গোল্ডেন গ্লোব, ব্রিটিশ অ্যাকাডেমি ফর ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন আর্টস (বাফটা) প্রভৃতি আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হন। ‘জয় হো’র জন্য তিনি গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড পান।
সংগীতের জন্য তিনি পেয়েছেন অগণিত পুরস্কার ও কোটি মানুষের ভালোবাসা। চারবার ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং ছয়বার তামিলনাড়ু রাজ্য ফিল্ম পুরস্কার পাওয়া রাহমান দুবার ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘পদ্মভূষণ’ দেওয়া হয় তাঁকে।
‘টাইম’ ম্যাগাজিনে বিশ্বের শীর্ষ ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় জায়গা করে নেন তিনি।
বিশ্ব সংগীতে অবদান রাখার জন্য স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক অ্যাওয়ার্ড দেয়। তা ছাড়া মিডলসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়, আন্না বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে অনারারি ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। তাঁর নামে মার্কহাম, ওন্টারিও, কানাডায় সড়কের নামকরণ করা হয়।

বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত আছেন এ আর রাহমান। ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া
বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত আছেন এ আর রাহমান। ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া

মানবিক এ আর রাহমান
স্ত্রী সায়রা বানু এবং তিন সন্তান—খাদিজা, রাহিমা ও আমিনকে নিয়ে তাঁর সংসার। বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত আছেন। ২০০৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘স্টপ টিবি’ কার্যক্রমের বৈশ্বিক প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন। এ ছাড়াও ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’, ‘ইন্ডিয়ান ওশান’সহ কিছু উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেছেন। ২০০৪ সালে সুনামি আক্রান্ত মানুষের জন্য, বিভিন্ন সময় অনাথ শিশুদের সাহায্য করার জন্য কনসার্টের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করেছেন। দরিদ্র ও নিপীড়িত জনগণের সাহায্যে নির্মিত ফিচার ফিল্মে বিনা পারিশ্রমিকে সংগীত পরিচালনা করেছেন।

বিনয়ী এ আর রাহমান
শুধু ভালো সংগীতজ্ঞই নন, এ আর রাহমান অসম্ভব বিনয়ী। নিজের তৈরি গানের প্রসঙ্গে এ আর রাহমান বলেন, ‘সংগীত পরিচালকেরও আগে কিন্তু আমি একজন ভালো শ্রোতা। নিজের সুর করা গান শোনার সময়ও একেবারে তৃতীয় একজন ব্যক্তির মতো আমি তার বিচার করতে পারি। গানের ভালো-মন্দ বুঝতে এটি আমাকে অসম্ভব সাহায্য করে।’ 

তাঁর এমন মন্তব্য নিশ্চয় তরুণ সংগীতশিল্পীদের কাজে আসবে।