নারী পরিচালকদের সঙ্গে হলিউডের আড়ি

বছরের আলোচিত ছবি ফেয়ারওয়েল–এর নির্মাতা লুলু
বছরের আলোচিত ছবি ফেয়ারওয়েল–এর নির্মাতা লুলু

অবহেলা নাকি জোর করে দাবিয়ে রাখা—নারী পরিচালকদের সঙ্গে হলিউডের আচরণ ঠিক কোন বৈশিষ্ট্যের মধ্যে পড়ছে, তা নিয়ে এখন জোর আলোচনা চলছে। গোল্ডেন গ্লোবের সাম্প্রতিকতম আসর এই আলোচনাটি নতুন করে উসকে দিয়েছে। গবেষণা বলছে, হলিউডে নারী পরিচালকের সংখ্যা ও তাঁদের কাজের পরিমাণ দিনকে দিন বাড়ছে। আর নিন্দুকেরা বলছেন, সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নারী পরিচালকদের উপেক্ষা করার হার। কারণ, পুরো পৃথিবীর মতোই হলিউড এখনো পুরুষশাসিত, নারী নেতৃত্বের স্বীকৃতি তাই সেখানে সুদূর পরাহত।

গোল্ডেন গ্লোবে কী ঘটেছে?
হলিউড ফরেইন প্রেস অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত এই পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে পুরুষ প্রাধান্যের এক ‘নির্লজ্জ’ প্রদর্শনী হয়েছে এবার। একাধিক বিভাগে নারী পরিচালকদের তৈরি ছবি মনোনয়ন পেলেও, সেরা পরিচালক বিভাগে মনোনয়নের ছোট্ট তালিকায় জায়গা হয়নি কোনো নারীর। এ নিয়ে গত ডিসেম্বর মাস থেকেই শোরগোল শুরু হয়। ওই সময় মনোনয়ন তালিকা প্রকাশিত হয়েছিল। ৬ জানুয়ারি পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের পর সেই শোরগোল প্রচণ্ড ক্ষোভে পরিণত হয়েছে। এরই মধ্যে বাফটা অ্যাওয়ার্ডের মনোনয়ন তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। তাতেও চিত্র একই। নারীদের কাজের স্বীকৃতি দেওয়াতে বাফটা কর্তৃপক্ষও ঠিক ততটাই কৃপণ! 

নিশ্চয়ই কেউ কেউ প্রশ্ন তুলবেন, নারী পরিচালকেরা কী এমন হাতি-ঘোড়া মেরেছেন শুনি? হ্যাঁ, সেই প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। গেল ২০১৯ সালে নারী পরিচালকদের তৈরি কয়েকটি ছবি বেশ আলোচিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে হাসলারস, লিটল উইমেন, দ্য ফেয়ারওয়েল, আ বিউটিফুল ডে ইন দ্য নেইবারহুড ইত্যাদি। বক্স অফিসে সাফল্যের পাশাপাশি সমালোচকেরাও এসব ছবির প্রাণখুলে প্রশংসা করেছেন। কিন্তু পুরস্কারের মঞ্চে তার কোনো প্রতিফলনই নেই। সেই প্রত্যাখ্যানের ভাষা এতটাই তীব্র যে মনোনয়নের তালিকাও বাদ যাচ্ছে না। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করারও সুযোগ পাচ্ছেন না নারী পরিচালকেরা। 

এশীয়–মার্কিন নারী হিসেবে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো গোল্ডেন গ্লোব জিতেছেন আকুয়াফিনা
এশীয়–মার্কিন নারী হিসেবে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো গোল্ডেন গ্লোব জিতেছেন আকুয়াফিনা

বেড়েছে অংশগ্রহণ, বেড়েছে বৈষম্যও
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, হলিউডে ছবি পরিচালনায় নারীদের অংশগ্রহণ আগের চেয়ে কয়েক গুণ বেড়েছে। ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যানেবার্গ ইনক্লুশন ইনিশিয়েটিভ এই গবেষণাটি করেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, গত বছরের শীর্ষ ১০০টি ছবির ১১৩ জন পরিচালকের মধ্যে ১২ জন ছিলেন নারী। হলিউডের শুরু থেকেই পরিচালনায় নারীরা ছিলেন বিরল। সংখ্যাবৃদ্ধির পরও নারী পরিচালকের সংখ্যা যত, সেটিকে ঠিক সমতার সংজ্ঞায় ফেলা যায় না। অর্থাৎ, বিগত বছরগুলোর তুলনায় ২০১৯ সালে নারীর পরিচালনায় ছবি বেশি হলেও, তা পুরুষের তুলনায় নিতান্তই কম।

গবেষকেরা বলছেন, গত বছর সবচেয়ে বেশি ব্যবসা করা হলিউডের চলচ্চিত্রগুলোর ১০ শতাংশের বেশি পরিচালনা করেছেন নারীরা। ২০১৮ সালের তুলনায় ব্যবসাসফল নারী পরিচালকের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে ২০১৯-এ। আর গেল দশকের হিসাবে এ হারই হলিউডের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। ২০১৯ সালের এসব ব্যবসাসফল ছবির তালিকায় রয়েছে ক্যাপটেন মার্ভেল, ফ্রোজেন টু, হাসলারস, অ্যাবোমিনেবল, লিটল, লিটল উইমেন এবং কুইন অ্যান্ড স্লিম। 

অন্যদিকে সান ডিয়েগো স্টেট ইউনিভার্সিটির আওতাধীন সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব উইমেন ইন টেলিভিশন অ্যান্ড ফিল্মের প্রধান মার্থা লজেন একই বিষয় নিয়ে পৃথক একটি গবেষণা চালিয়েছেন। তাতে দেখা গেছে, চলচ্চিত্র নির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় নারীদের অংশগ্রহণ আগের চেয়ে বেড়েছে, ১৬ থেকে হয়েছে ২০ শতাংশ। অনেকে বলছেন, ২০১৯ সাল চলচ্চিত্র নির্মাণে নারীদের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে একটি ঐতিহাসিক বছর। যদিও মার্থা লজেন বলছেন, এখনই এ নিয়ে এত মাতামাতির কিছু নেই। কারণ আগের চেয়ে বহুগুণে বাড়লেও, এখনো হলিউডে চলচ্চিত্র নির্মাণে নারী-পুরুষের মধ্যকার বৈষম্য চরম। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ কমতেও দেখা যাচ্ছে। সুতরাং এখনই বলা যাচ্ছে না যে নারী পরিচালকের হার অব্যাহতভাবে বাড়ছে। এ জন্য ২০২১ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আর তার সঙ্গে মেটাতে হবে হলিউডে নারী-পুরুষ বৈষম্য। 

নির্মাতা জুটি জেনিফার লি ও ক্রিস বাক ফ্রোজেন ছবির জন্য জিতেছিলেন অস্কার
নির্মাতা জুটি জেনিফার লি ও ক্রিস বাক ফ্রোজেন ছবির জন্য জিতেছিলেন অস্কার

উপেক্ষিত নারী নির্মাতা, প্রশংসিত তাঁদের কাজ
এবার সেই বৈষম্যের চিত্রই প্রকাশ্যে আনল গোল্ডেন গ্লোব কর্তৃপক্ষ। নিন্দুকেরা বলছেন, সেরা পরিচালক বিভাগে গ্রেটা গারউইগের (লিটল উইমেন) মনোনয়ন পাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু মার্টিন স্করসিস, কুয়েন্টিন টারান্টিনোদের পাশে জায়গাই পেলেন না গ্রেটা। এর আগে ২০১৭ সালে লেডি বার্ড ছবির জন্য সেরা ছবির পুরস্কার পেলেও, সেবারও সেরা পরিচালক বিভাগে তিনি মনোনয়ন পাননি। অথচ তাঁর তৈরি ছবিতে অভিনয় করেই এবার সেরা অভিনেত্রীর মনোনয়ন পেয়েছেন সার্সা রোনান। অন্যদিকে দ্য ফেয়ারওয়েল ছবির জন্য চলচ্চিত্র শাখার সেরা অভিনেত্রীর বিভাগে পুরস্কারও জিতেছেন আকোয়াফিনা, যদিও ছবিটির নারী পরিচালক লুলু ওয়াং কোনো স্বীকৃতি পাননি। 

অবশ্য নারী পরিচালকদের উপেক্ষা করার নজির আগেও দেখা গেছে গোল্ডেন গ্লোবে। এ পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৭৭টি আয়োজনে মাত্র পাঁচজন নারী পরিচালককে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র একজন নারী সেরা নির্মাতা হিসেবে পুরস্কার জিততে পেরেছিলেন। সেটিও ১৯৮৩ সালের ঘটনা। 

নির্মাতা গ্রেটা গারউইক
নির্মাতা গ্রেটা গারউইক

বিতর্কে সঞ্চালক
এমনই অবস্থায় পুরস্কারের মঞ্চে বিতর্কের আগুনে খাঁটি ঘি ঢেলে দিয়েছেন উপস্থাপক রিকি জারভেইস। পুরস্কার বিতরণের ফাঁকে হাস্যরসাত্মক মন্তব্য করে আসর জমিয়ে তুলতে দেখা যায় অনেক উপস্থাপককে। তা-ই করতে গিয়ে রিকি এক ‘উদ্ভট’ কথা বলেছেন। নারী পরিচালকদের মনোনয়ন না পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, এই সমস্যার সমাধান করতে হলিউডের এমন যুগে ফিরে যাওয়া যায়, যখন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো নারীদের পরিচালক হিসেবে নিয়োগই দিত না! রিকির এই মন্তব্যের সময় পুরো থিয়েটারে ছিল পিনপতন নীরবতা। 

সব মিলিয়ে এবারের গোল্ডেন গ্লোবের আসর নারী-পুরুষ সমতার ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে দিয়েছে। #মিটু আন্দোলনের পর থেকে হলিউড যে নতুন দিনের পথে হাঁটা শুরু করেছিল, তাতেও এটি কালো দাগ হয়েই থাকবে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ক্যামেরার পেছনে নারীর ভূমিকার স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে হলিউডের এই নাক সিটকানো স্বভাব আদতে কোনো ভালো ফল বয়ে আনবে না। লিঙ্গ বা বর্ণের বিচার না করে, নির্মোহভাবে মেধার স্বীকৃতি দেওয়াই বরং প্রগতির পথে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষণ। 

‘ফ্লিব্যাগ’ সিরিজের জন্য গত বছর এমি জিতেছিলেন নির্মাতা ফোবে ওয়েলার–ব্রিজ। এ বছর গোল্ডেন গ্লোবের পরিচালক বিভাগে আসেনি তাঁর নাম।  ছবি: এএফপি
‘ফ্লিব্যাগ’ সিরিজের জন্য গত বছর এমি জিতেছিলেন নির্মাতা ফোবে ওয়েলার–ব্রিজ। এ বছর গোল্ডেন গ্লোবের পরিচালক বিভাগে আসেনি তাঁর নাম। ছবি: এএফপি

অপেক্ষা অস্কারের 
গোল্ডেন গ্লোব তো গেল। এবার সবাই নজর দিচ্ছেন অস্কারের দিকে। গত অস্কার আসরে নারীদের স্বীকৃতি ছিল চোখে পড়ার মতো। ক্যামেরার সামনে ও ক্যামেরার পেছনে—সর্বত্রই নারীর অবদান স্বীকার করে নেওয়ার প্রবণতা দেখা গিয়েছিল অস্কারের ৯১তম আসরে। যৌন হয়রানির অভিযোগে জর্জর হলিউডে এর প্রয়োজনও ছিল। এবার কি তবে পুরুষ প্রাধান্যের ‘ট্যাবু’ ঝেড়ে ফেলার ইঙ্গিতও পাওয়া যাবে অস্কারে? এই প্রশ্নের উত্তর সময়ের খাতায় তোলা থাক। আর তো কটা দিন। ১৩ জানুয়ারি ঘোষণা করা হবে ৯২তম অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডের চূড়ান্ত মনোনয়ন। তখনই জানা যাবে, নারী-পুরুষ বৈষম্য কমাতে কতটা আগ্রহী হলিউড! 

তথ্যসূত্র: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, টাইম, ভক্স, বিবিসি, ওয়াশিংটন পোস্ট, ইন্ডিপেনডেন্ট, ভ্যারাইটি ও ফরচুন