শেখার জন্য প্রয়োজন শৃঙ্খলা অধ্যবসায় ও সংকল্প

তবলাশিল্পী পণ্ডিত শুভঙ্কর ব্যানার্জি
তবলাশিল্পী পণ্ডিত শুভঙ্কর ব্যানার্জি

বাংলাদেশে তবলা বাজান অনেকেই। তাঁদের শুদ্ধতা, সংগতে আরও যোগসূত্র বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন। বাংলাদেশে গভীর মনোযোগী তবলাশিল্পী তৈরির জন্য বিশেষ একটি কর্মশালার আয়োজন করেছে তারা।

বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের আমন্ত্রণে তবলা কর্মশালা পরিচালনা করতে গত অক্টোবর থেকে পরপর তিনবার ঢাকায় এসেছেন খ্যাতিমান তবলাশিল্পী পণ্ডিত শুভঙ্কর ব্যানার্জি। ঢাকার লালমাটিয়ার বেঙ্গল বই ভবনে অনুষ্ঠিত কর্মশালায় সারা দেশ থেকে বাছাই করে ৪০ জন তবলাশিল্পীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবলাবাদনের প্রসার ও একে উৎসাহিত করতে পণ্ডিত সুরেশ তালওয়ালকারের তত্ত্বাবধানে বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয় শাস্ত্রীয়বাদন প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে। পাশাপাশি বাদনশৈলী উন্নীতকরণের জন্য পণ্ডিত শুভঙ্কর ব্যানার্জির তত্ত্বাবধানে নতুন এই কর্মশালা। উভয় ক্ষেত্রেই ছাত্রছাত্রীরা বিনা মূল্যে প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছেন।

একক বা সংগত শিল্পী—দুই হিসেবেই শুভঙ্কর ব্যানার্জি অভাবনীয়। সংগতকার হিসেবে বাঁশরিয়া পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া বা খেয়ালশিল্পী রশিদ খানের প্রথম পছন্দ তিনি। আর একক বাদনের জন্য পৃথিবীর নানা দেশ থেকে আমন্ত্রণ পান। সেসব জায়গায় গিয়ে তবলার বাদনে বাতাসে ছবি আঁকেন এই শিল্পী। এরই মধ্যে তিনটি একক অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশে তবলার শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে অনেক পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। জোর দিয়েছেন ‘থ্রি ডি’— ডিসিপ্লিন (শৃঙ্খলা), ডেডিকেশন (অধ্যবসায়), ডিটারমিনেশন (সংকল্প)–এর ওপর। লক্ষ্য ঠিক রেখে চর্চা চালিয়ে যেতে বলেছেন। এভাবে সাধনা ও চিন্তাভাবনা চালিয়ে নেওয়ার পর বাকিটা নির্ভর করবে ভাগ্যের ওপর। তিনি বলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছু বদলালেও একটা জায়গায় পৌঁছানোর জন্য ২৪ ঘণ্টা চিন্তা ও চর্চার মধ্যে থাকার ব্যাপারটা পাল্টায়নি।

শুভঙ্কর ব্যানার্জির মা শিল্পী কাজলরেখা। তিন বছর বয়সে বেনারস ঘরানার পণ্ডিত মানিক দাসের কাছে সন্তানকে তুলে দেন। পরে ফারুখাবাদ ঘরানার পণ্ডিত স্বপন শিবের কাছে শুভঙ্কর ব্যানার্জি শিখেছেন প্রায় ২৫ বছর। তাঁর স্ত্রী নিবেদিতা একজন শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী। তাঁদের দুই সন্তান আহিরি ও অর্চিকও যথাক্রমে কণ্ঠসংগীত, তবলার শিক্ষার্থী। পরিপূর্ণ সংগীত পরিবারের এই সদস্য মনে করেন, শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পীদের অনেকেই পরিবার বা সমাজ থেকে সাংঘাতিক সমর্থন পাননি। কিন্তু তাঁরা বেরিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, অনেক ধরনের সাপোর্ট পেলেও কিন্তু হয় না। এটা কষ্ট করেই হওয়ার বিষয়, আরাম করে হওয়ার নয়। কষ্ট করতে পারলেই মূল্যবোধ তৈরি হয়। অনেকেই আছেন, যাঁরা তাঁদের বাবা-দাদার মতো হতে পারেননি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সুযোগ বুমেরাং হয়ে গেছে। আজকের দিনের এই পরিবেশের মধ্যে যারা শিখছে, তাদের হয়তো শতভাগ পথ পাড়ি দেওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু ৭০ ভাগ তো সম্ভব!

শুভঙ্কর ব্যানার্জি বাজিয়েছেন সারা পৃথিবীতে। উল্লেখ করার মতো ছিল নোবেল শান্তি পুরস্কারের কনসার্ট, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলের ইন্ডিয়া উৎসব, জাপানের এশিয়া ফ্যান্টাসি কনসার্ট। লন্ডনে সিম্ফনি অর্কেস্ট্রার সঙ্গে বাজানোর অভিজ্ঞতাও অনন্য। কোলাবোরেশন করেছেন জন ম্যাকলাফলিনসহ অনেকের সঙ্গে। হলিউডের ছবি নাইট অব দ্য ওয়্যার, ডার্ক স্ট্রিটস-এর জন্য কাজ করেছেন তিনি। 

তরুণ শিল্পীদের তিনি একটি জিনিসে নজর দিতে বলেছেন। সেটা হলো—তন্ত্র বা দক্ষতা শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করানো যায়। শাস্ত্র বা শিক্ষা মগজে প্রবেশ করানো যায়। তারপর সেটা থেকে নতুন কিছু বের করে আনাটা কঠিন। যদি শেখার শুরুর দিন থেকে কেউ লেগে থাকে, কিছু না কিছু একটা হবেই। পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়াকে উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, অন্নপূর্ণা দেবীর কাছে যাওয়ার আগপর্যন্ত তিনি ডান দিকে বাঁশি বাজাতেন। দুজন গুরুর কাছে শিখেছিলেন। অন্নপূর্ণা বলেছিলেন, ‘আমি তোমায় শেখাতে পারব না। তুমি ইতিমধ্যে শিখেছ। তোমার হাতে, মাথায় ওসব বসে গেছে। শুরু থেকে তুমি শুরু করতে পারবে না।’ পণ্ডিতজি বলেছিলেন, ‘আমি আপনার কাছে শিখবই।’ অন্নপূর্ণা বললেন, ‘যদি বলি তুমি বাঁ দিক থেকে বাজাতে শুরু করো, পারবে?’ হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া রাজি হয়ে গেলেন। তারপর অচিন্তনীয় একটা সময়ের মধ্য দিয়ে তিনি গেছেন, যেখানে বাঁশি ছাড়া জীবনে আর কিছুই ছিল না তাঁর।

নিজের ছাত্রদের বাড়তি কিছু সুযোগ করে দেওয়ার জন্য ২০০৬ সাল থেকে রিদম ক্লাব চালু করেছেন শুভঙ্কর ব্যানার্জি। আধা ঘণ্টা করে একটা তবলা লহরা, কণ্ঠসংগীত ও যন্ত্রসংগীত পরিবেশিত হয় সেখানে। যে যেই এলাকায় থাকেন, সেখানকার লোকেরা হাজির হয়ে বিনা পয়সায় শোনার সুযোগ পান। তিনি বলেন, ‘কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় প্রতি মাসে এটা করা হয়। আলো, মাইক, লোকজন সামনে বসে থাকলে বাজাতে কেমন লাগে ছাত্ররা সেটা বুঝতে পারে। তা ছাড়া ছাত্রদের জন্য দেশের বাইরেও অনেক শো-এর আয়োজন করেছি।’