সুচিত্রা সেনের শেষ দিনগুলো

সুচিত্রা সেনের সমাদর দুই বাংলাতেই আছে। বাংলা ছবির জনপ্রিয় নায়িকা, সুঅভিনেত্রী—এসব ছাপিয়ে তিনি এখন কিংবদন্তি। বাঙালির স্বপ্নপূরণের নায়িকা ছিলেন সুচিত্রা। ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা শহরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর বাঙালি আবার উপলব্ধি করেছিল, কিংবদন্তির মৃত্যু নেই।

শেষ ২৬ দিন হাসপাতাল এবং সেখান থেকে বাড়ি হয়ে কেওড়াতলা মহাশ্মশান, সুচিত্রার শেষ দিনেগুলোর সাক্ষী ছিল কলকাতা শহরের অগণিত মানুষ। আজ ১৭ জানুয়ারি তাঁর চলে যাওয়ার দিনে সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে বারবার। শেষ দিনগুলোও কেমন যেন নাটকীয় ছিল। জীবনের শেষ ২৬টি দিন তিনি হাসপাতালেই ছিলেন।

গল্লির ধারে বেল ভিউ নার্সিং হোম

সুচিত্রা সেন: জন্ম: ৬ এপ্রিল ১৯৩১ মৃত্যু: ১৭ জানুয়ারি ২০১৪। ছবি: সংগৃহীত
সুচিত্রা সেন: জন্ম: ৬ এপ্রিল ১৯৩১ মৃত্যু: ১৭ জানুয়ারি ২০১৪। ছবি: সংগৃহীত

শহরের আচার্য জগদীশচন্দ্র বোস রোডের পাশে মিন্টোর পার্ক এলাকায় ঠিক পার্কের কিনারে প্রতিষ্ঠানটি। স্থানীয় লোকজন বেল ভিউ নার্সিং হোম নামেই জানেন। পরিসরে খুব একটা বড় না হলেও নামডাক অনেক। এখানেই ছিলেন বাঙালির চিরকালের মহানায়িকা সুচিত্রা সেন।

বলছি ২০১৪ সালের প্রথম মাস জানুয়ারির কথা। সেবারও এ বছরের মতো শীতের দাপট ছিল। কলকাতায় ছিল রেকর্ড পরিমাণ ঠান্ডা। এই সময়টাতে সকালের দিকে শহরের রাস্তায় মানুষের ভিড় তুলনামূলকভাবে কম দেখা যায়। কিন্তু নগরীর গোর্কি সদনের পাশের রাস্তায় মিন্টো পার্কের সামনে বেসরকারি হাসপাতাল বেল ভিউ সামনের চিত্রটা ভিন্ন। সেখানে শত মানুষের ভিড়। সাধারণ মানুষতো ছিলেনই, একই ভিড়ে শামিল হয়েছিলেন সংবাদকর্মীরা। নির্দিষ্ট সীমানা পর্যন্ত তাঁদের প্রবেশ সংরক্ষিত। হাসপাতালের ভেতর থেকে হাসপাতালের নার্স কিংবা চিকিৎসক—কাউকে আসতে দেখলেই সবার মনোযোগ তাঁর ওপর, ‘এখন কেমন আছেন দিদি?’ কখনো উত্তর মিলেছে, কখনো মিলেনি। ভেতরে জীবন আর মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন মহানায়িকা সুচিত্রা সেন।

১৭ জানুয়ারি কলকাতার মিন্টোরপার্ক এলাকার বেল ভিউ নার্সিং হোমের সামনে। ছবি: সংগৃহীত
১৭ জানুয়ারি কলকাতার মিন্টোরপার্ক এলাকার বেল ভিউ নার্সিং হোমের সামনে। ছবি: সংগৃহীত

উৎকণ্ঠার সময়গুলোকে মেডিকেল বুলেটিন যেন বাঁচিয়ে রেখেছিল। দিনে বেশ কয়েকবার মেডিকেলের পক্ষ থেকে সংবাদমাধ্যমকে জানানো হচ্ছে বিস্তারিত। এই সূত্র ধরেই হাসপাতালের পাশেই নির্ধারিত স্থান থেকে শহরের বিভিন্ন চ্যানেলের প্রতিবেদকের পরস্পরবিরোধী পরিবেশনা আরও উৎকণ্ঠা বাড়িয়েছিল। একদিকে বলছেন ‘স্থিতিশীল’, আবার বলছেন ‘আশঙ্কাজনক’। মহানায়িকার সংকটজনক শারীরিক অবস্থার ওঠা–নামা করেছে শেষ দিনগুলোতে।

হাসপাতালের সামনে সাধারণ মানুষেরে চেয়ে সেখানে সংবাদকর্মীই বেশি। এমনও দেখেছি, দিনের পর দিন ছিলেন কেউ কেউ। কেউ টানা ৭২ ঘণ্টা জেগে। কেউ চার দিন বাড়ি যাননি। এভাবে কেটে যায় ২৬টি দিন। এই কটি দিন হাসপাতালের কার্ডিওলজি, পালমোনোলজিস্ট, ক্রিটিক্যাল কেয়ার স্পেশালিস্ট—সবারই ধ্যানজ্ঞান আবর্তিত হয়েছিল সুচিত্রাকে ঘিরে।

শুধু চিকিৎসকেরাই দিনরাত এক করে লড়েছেন বললে অবশ্য ভুল হবে; সুচিত্রার সংকটমুক্তির যুদ্ধে শামিল নার্স থেকে শুরু করে হাসপাতালের বিভিন্ন স্তরের কর্মীরাও। সুচিত্রার ইচ্ছায় তাঁর পরিচর্যার দায়িত্বে থাকা তিনজন নাসের ছুটি বাতিল করা হয়েছিল৷ তবুও তাঁদের হাসিমুখে অশীতিপর নায়িকার সঙ্গে লড়াইয়ে শামিল থাকতে দেখেছি। সুচিত্রা পরিচিত নার্স ছাড়া অন্যদের দেখলে বিরক্ত হতেন। চিকিৎসা নিতে চাইতেন না।

কলকাতার কেওড়াতলা মহাশ্মশানে দুই মেয়েকে নিয়ে মুনমুন সেন। ছবি: প্রথম আলো
কলকাতার কেওড়াতলা মহাশ্মশানে দুই মেয়েকে নিয়ে মুনমুন সেন। ছবি: প্রথম আলো

১৭ জানুয়ারি সকাল সাতটা। সেদিন শুক্রবার। আগের দিনের খবর ছিল, মহানায়িকার শরীর একটু ভালোর দিকে। এমনকি বাড়ি ফেরার প্রস্তুতিও চলছিল। কিন্তু শুক্রবার ভোর থেকে আবারও সংকটে। হঠাৎ হলেও দ্রুত খবর ছড়িয়ে পড়ে। নানা রকমের খবর আসছিল হাসপাতালের ভেতর থেকে। মিডিয়াও প্রস্তুত। শোনা গেল, মহানায়িকার পালস রেট কমে গেছে একদম। তার মানে ছাব্বিশ দিনের লড়াই শেষ হতে চলেছে? আটটায় বন্ধ হলো হৃৎস্পন্দন। ডাক্তারি পরিভাষায় যাকে বলে, ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। মুনমুন কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে আর্তস্বরে ডাকছেন, ‘মা, মা।’ নাতনি রাইমার অঝোরে চোখ দিয়ে পানি ঝরছে, ফোঁপাচ্ছেন।

চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে সকাল ৮টা ২৫ মিনিটে চলে গেলেন সুচিত্রা। হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এ ঘোষণা দিলেন তখনকার (বর্তমানও) পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। টানা ২৬ দিনের লড়াইও শেষ। এদিনই যে শহরের কেওড়াতলা শ্মশানে সুচিত্রা সেনের শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে, হাসপাতাল চত্বরে দাঁড়িয়ে তা ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী। খবরটা শুনে যেন কৈশোর, যৌবনের আবেগের মৃত্যু ঘটল অনেকের। কনকনে শীতের সকালে হাসপাতালের অনতিদূরে দেখেছি, এক তরুণ মনের অজান্তেই গেয়ে উঠলেন, ‘আরও কিছুটা সময় না রহিতে...।’ চোখ তাঁর ছলছল।

গন্তব্য কেওড়াতলা মহাশ্মশান
সকালেই যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয় মিন্টো পার্কের রাস্তায়। সকাল থেকে সাইরেন বাজিয়ে আসতে থাকেন পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন মন্ত্রী। বেলুর মঠ থেকে হাসপাতালে এসে পৌঁছান তিন সন্ন্যাসী—স্বামী বিমলাতআনন্দ, স্বামী সুদেবানন্দ ও স্বামী গুরুদশানন্দ। সুচিত্রার মরদেহের গলায় শ্রীরামকৃষ্ণের প্রসাদী মালা পরিয়ে দেওয়া হয়। পরানোর জন্য মুনমুনের হাতে সারদা দেবীর প্রসাদী শাড়ি তুলে দেওয়া হয়। সেখানে গিয়েছিলেন তখনকার বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার আবিদা রহমান।

সুচিত্রা সেনের মরদেহ বহনকারী গাড়ির পাশে শত শত ভক্ত। ছবি: প্রথম আলো
সুচিত্রা সেনের মরদেহ বহনকারী গাড়ির পাশে শত শত ভক্ত। ছবি: প্রথম আলো

বেলা ১১টার মধ্যেই হাসপাতালের সামনে শববাহী গাড়ি পৌঁছায়। ততক্ষণে মহানায়িকাকে শেষযাত্রার পোশাক পরানো হয়, কেবিনেই। সাদা বেনারসি। তার ওপরে সোনালি গরদের চাদর জড়ানো। মাথায় ঘোমটা, কপাল থেকে চিবুক পর্যন্ত দেখা গেছে। কফিনে বন্ধ মরদেহ ফুল দিয়ে সাজানো গাড়িতে তোলা হলো দুপুর সাড়ে বারোটায়। শেষযাত্রায় বাড়ির মাটি ছোঁয়ানোর নিয়ম, তাই হাসপাতাল থেকে নিয়মরক্ষার বালিগঞ্জের বাড়িতে মিনিট পাঁচেকের জন্য দেহ নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে সোজা কেওড়াতলা শ্মশানে। স্থানীয় মেয়রের তত্ত্বাবধানে জোগাড় হয় ৫০ কেজি চন্দন কাঠ ও বিপুল পরিমাণে গাওয়া ঘি।
বেলা ১টা ৪০ মিনিটে মুখাগ্নি হয় মুনমুনের হাতে। এর আগে মুনমুন ও রাইমা-রিয়া মিলে মরদেহে ঘি মাখিয়ে আচার-অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন। ঠিক চার ঘণ্টা পরে মুনমুন মায়ের চিতাভস্ম নিয়ে বাবুঘাটে যান।

জীবনের শেষ তিন দশক লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকলেও সুচিত্রা সেনের আকর্ষণ যে প্রজন্মের সীমারেখার তোয়াক্কা করে না, সেদিনের শ্মশানের আবহই তার প্রমাণ দেয়। শ্মশানের বাইরে বা হাসপাতালে ভিড় করা ভক্তরা ছাড়াও জনপ্রিয় নায়ক মিঠুন চক্রবর্তী ছাড়া দেব, সৃজিত মুখার্জি, দেবর্ষি সোহমদের মতো টালিগঞ্জের প্রবীণদের মধ্যেও অনেকে এসেছিলেন।

চলে যাওয়ার পরের কয়েকটি দিন
কথা ছিল, ১৮ জানুয়ারি শনিবার হয়তো হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হতে পারে সুচিত্রা সেনকে। নিজেও মনেপ্রাণে চাইছিলেন এ বাড়িতে ফিরতে। কিন্তু ফেরা হলো না। ২৬ দিনের লড়াই শেষ হয়ে আগের দিন শুক্রবার তিন দশক নিজেকে লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখার পর চির অন্তরালে চলে গেলেন মহানায়িকা। এর যেন তিনি নতুন করে ফিরে এলেন। শনিবার থেকে কলকাতাবাসীর কাছে আগ্রহের বিষয় ছিল সুচিত্রা। তাঁর বাসভবন, টালিগঞ্জের মেকআপ রুম তো আলোচনা আর আগ্রহের বিষয় ছিল—সারা শহরেই যেন তাঁকে নতুন করে খুঁজে বেড়িয়েছে। পাড়া, মহল্লায়, অলিগলিতে, দোকানে, ক্লাবে দেখা গেছে সেই চিরচেনা রহস্যময় হাসির সুচিত্রার সাদাকালো প্রতিকৃতি। সেখানে নানান রকমের ফুল।

শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন সুচিত্রা সেনের মেয়ে মুনমুন সেন। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি, কলকাতা
শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন সুচিত্রা সেনের মেয়ে মুনমুন সেন। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি, কলকাতা

পরের কয়েক দিন সুচিত্রা সেনের বাড়ির সামনে গিয়ে দেখা যায়, ভেতরে সুনসান নীরবতা। বাইরে উৎসুক নানা বয়সী মানুষের ভিড়। সবার নজর বাড়িটির দিকে। যেখানে সুচিত্রা সেনের কেটেছে দীর্ঘদিন। রবীন্দ্র সদন থেকে শুরু করে শহরের নানা জায়গায় দেখা গেল সুচিত্রা সেনের বিশাল বিশাল প্রতিকৃতি। মূল রাস্তা থেকে যেসব ছোট গলি চলে গেছে, সেসব গলিগুলোর মুখে মূলত ছিল প্রতিকৃতিগুলো। অনেকে সকালে দৈনন্দিন পূজা শেষে সেখানে এসে ফুল দিয়েছেন। পুরো কলকাতায় সুচিত্রার ঠোঁটে স্থান পাওয়া পুরোনো চলচ্চিত্রের গানগুলো বাজতে শোনা গেছে। এমনকি নিউমার্কেটের পাশে যে পানের দোকানটিতে সব সময় মোহাম্মদ রফির গান শোন যেত, সেই দোকানে শোনা গেছে সুচিত্রার ঠোঁটে স্থান পাওয়া গানগুলো। ভিডিও–সিডির দোকানে হঠাৎ করে পুরোনো ছবির সিডিগুলো বিক্রি বেড়ে গিয়েছিল।

জীবনের শেষ ৩০ বছর নিজের জীবন সম্পর্কে যে রকম গোপনীয়তা রক্ষা করেছিলেন সুচিত্রা, তাঁর পারলৌকিক কাজেও সেই গোপনীয়তা ছিল। মেয়ে মুনমুন সেন মায়ের অন্তরালের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই দায়িত্ব পালন করেছেন। বালিগঞ্জের বেদান্ত নামের বাড়িতে সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, পরিচিতদের প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত ছিল। অনাড়ম্বর ছিল সে আয়োজন।


একজীবনে সুচিত্রা সেন

‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে উত্তম কুমারের সঙ্গে সুচিত্রা সেন।
‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে উত্তম কুমারের সঙ্গে সুচিত্রা সেন।

এই কিংবদন্তি ছুঁয়ে আছে দুই বাংলাকেই। আজকের বাংলাদেশের পাবনা শহরে জন্মেছিলেন করুণাময় ও ইন্দিরা দাশগুপ্তের পঞ্চম সন্তান। তখন নাম রাখা হয় কৃষ্ণা। জন্মের তারিখটা ৬ এপ্রিল ১৯৩১।
সুচিত্রাও সেই নারী, যিনি সম্মোহনী সৌন্দযের্র আগল ভাঙলেন না। বয়সের সঙ্গে নিজেকে পাল্টে গড়ে নিলেন না নতুনতর চরিত্র, পা রাখলেন না নিরীক্ষার আঙিনায়। পর্দার অভিনয়জীবনে নিজের যে চূড়ান্ত রোমান্টিক প্রতিমাটি গড়ে তুলেছিলেন, স্বেচ্ছা-অন্তরালের জীবনে তাকেই পরিণত করলেন সসম্ভ্রম নস্টালজিয়ায়।

অনেকেই বলে থাকেন সুচিত্রা তাঁর সমসাময়িক সত্যজিৎ, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেনের মতো পরিচালকের কাছেও পরীক্ষিত নন। তিনি হয়ে ওঠেননি ‘মেঘে ঢাকা তারা’র নীতা, ‘চারুলতা’ বা ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’-এর কুন্তী। এই না-হওয়া, না-পাওয়া থেকেই কি ক্রমেই সরে গেলেন প্রকৃতির নিয়মে।