নায়করাজের স্মরণে তিন নায়িকা

>১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি জন্মেছিলেন নায়করাজ রাজ্জাক। আজ ৭৯তম জন্মদিন উপলক্ষে তাঁকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করলেন চলচ্চিত্র দুনিয়ার তাঁর তিন সঙ্গী অভিনয়শিল্পী কবরী, ববিতা ও শাবানা।

সেই দিনগুলো যদি আবার ফিরে আসত

কবরী
রাজ্জাকের সঙ্গে আমার লম্বা সফর। গাড়িতে যেতে যেতে কত গল্প হতো। তবে বেশির ভাগই ছিল সিনেমা নিয়ে। মাঝেমধ্যে আমরা পরিচালককে ফাঁকি দিয়ে হারিয়ে যেতাম। রাঙামাটি, বান্দরবানে। আমি ভাবতাম, পরিচালককে না বলে এলাম, ঠিক হলো কি না। রাজ্জাক বলত, ‘ধুর, রাখ তো! আমাদের কখনো আলাদাভাবে আনন্দ করার সময়ই হয়ে ওঠে না!’ আমি অবাক হতাম। রাজ্জাক যখন বলতেন, ‘জীবন কি শুধু বৈষয়িক চিন্তা? স্বামী–সংসার সবার জন্য দায়িত্ব থাকে। আমরা বরং এটুকুই উপভোগ করি।’ আজ রাজ্জাক কাছে নেই। কিন্তু মনের ভেতরে একটু জায়গা দখল করে তো আছে। সেই স্মৃতি রাজ্জাকের জন্মদিনে আমাদের যে কী আনন্দ দিচ্ছে! আহা! সেই দিনগুলো যদি ফিরে আসত! আবার যদি আমরা পাহাড়–জঙ্গলে লুকিয়ে থাকতে পারতাম! বয়স যেন মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে। বয়স যদি আরও কম হতো! অনেকে তো তখন বলত, ‘রাজ্জাক–কবরী জুটির বিয়ে হলে ভালো হতো।’ ধুর! বিয়েটিয়ে আমার পছন্দ না। রাজ্জাক, জি না। আমি আপনাকে বিয়ে করতাম না। আমার যদি বয়সটা কম হতো, আমাদের আনন্দের মাত্রাটা, দুষ্টুমির মাত্রাটা আরও বেশি উপভোগ করতে পারতাম। আজকে আমার সে কথাটিই মনে পড়ছে।

তিনি আমাদের পরিবারের একজন

ববিতা
জহির (জহির রায়হান) ভাই তাঁকে (রাজ্জাক) চলচ্চিত্রজগতে নিয়ে এসেছিলেন। আমিও জহির ভাইয়ের হাত ধরে এসেছি। রাজ্জাক ভাইকে কখনো তথাকথিত নায়ক বা হিরো ভাবতাম না। আমি ভাবতাম, তিনি আমাদের পরিবারের একজন। আমাদের সুখে–দুঃখে পাশে ছিলেন। এখনো খুব অবাক লাগে। আটাশি সালে যখন বন্যা হলো, তখন রাজ্জাক ভাই আর ভাবি রিকশায় করে এসেছিলেন। এটা দেখতে যে ববিতা ভালো আছে কি না। ওই দিন আমি খুব অভিভূত হয়েছিলাম। এত পানি। সুচন্দা আপার বাড়িতে গিয়েছি বজরা নৌকায় করে।
রাজ্জাক ভাইয়ের বেশির ভাগ নিজের প্রযোজনায় আমাকে নেওয়া হতো। এ রকমই একটা ছবি অনন্ত প্রেম। এটি করেছিলাম কাপ্তাইয়ের দিকে পাহাড়ি অঞ্চলে। এটা প্রেমের ছবি ছিল। এত ভেতরে শুটিং করতে হতো যে হেঁটে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে যেতাম। তখন রাজ্জাক ভাই আমার জন্য ছোট একটা পালকি বানিয়ে দিলেন। তখন দুজন লোক পালকিতে করে আমাকে নিয়ে যেতেন। রাজ্জাক ভাই পালকিবাহকদের জিজ্ঞেস করতেন, ‘পালকি বয়ে নিচ্ছ। কেমন লাগছে?’ লোকেরা বলত, ‘ভাই অসুবিধা নেই। এ তো হরিণের বাচ্চা।’

ওই ছবিতে আমাদের একটা চুমুর দৃশ্য ছিল। একটা ইমোশনাল দৃশ্য। আমি বিষ খেয়েছি। ওই বিষ রাজ্জাক ভাই চুমু দিতে গিয়ে খেয়ে ফেলেন, তারপর দুজনেই মারা যাব। ইমোশনাল হয়ে কিসিং শট দিলাম। সবাই হাততালি দিল। অসাধারণ অভিনয় হয়েছে। রাতের বেলা রাজ্জাক ভাইকে বলা হলো, ববিতা তো কাঁদছে। তিনি আমাকে বললেন, ‘পপ, তোমার কী হয়েছে, কাঁদছ কেন?’ তিনি আমাকে পপ বলে ডাকতেন। আমার নাম তো পপি। আমি বললাম, ‘রাজ্জাক ভাই, আপনার সঙ্গে আমি তো চুমুর শট দিলাম। এখন আমাকে তো কেউ বিয়ে করবে না।’ তারপর রাজ্জাক ভাই বললেন, ‘দেখো, তুমি ঘাবড়িও না। যদি দেখতে খারাপ লাগে তাহলে এই দৃশ্য আমি কোনো দিন রাখব না।’ পরে তিনি এই দৃশ্য অন্যভাবে দেখিয়েছেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, ছবিটি এত সুপারডুপার হয়েছিল যে আমরা যেখানে এই শট দিয়েছিলাম, সেই টিলার নাম হয়ে গিয়েছিল ববিতা টিলা। আমি একবার কাপ্তাই যাওয়ার পরে লোকেরা বলল, ‘আপনি কি জানেন আপনার নামে একটি টিলা আছে?’ আমি বলি, ‘না তো ভাই।’ তাঁরা বললেন, ‘আপনার অনন্ত প্রেম ছবির দৃশ্যটা এত সুন্দর হয়েছে যে লোকে পাগল হয়ে ওই টিলার নাম দিয়েছে ববিতা টিলা।’

আমি আছি, তুমি আছ, আর কী লাগে

শাবানা
তিনি কত বড়মাপের শিল্পী ছিলেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা গল্প করছি। রাজ্জাক ভাইকে বললাম, ‘রাজ্জাক ভাই, আমি যদি একটি সিনেমা বানাই কেমন হয়?’ তিনি বললেন, ‘করো করো’। বললাম, ‘রাজ্জাক ভাই, এটা তো বড় একটা ব্যাপার। কীভাবে কী করব।’ তিনি বললেন, ‘তুমি এত চিন্তা করছ কেন? আমি আছি না? আমি আছি। তুমি আছ। আর কী লাগে।’ বললাম, ‘রাজ্জাক ভাই, কী গল্প থাকবে। কী করব বলেন তো?’ তিনি বলেন, ‘গল্প থাকবে তোমার আর আমার।’ এভাবেই কথায় কথায় আমাদের প্রযোজনা সংস্থা তৈরি হয়েছিল। রাজ্জাক ভাই আমাদের যেভাবে সহযোগিতা করেছেন, তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। আমার প্রোডাকশনের প্রথম ছবি মাটির ঘর। মাঝেমধ্যে এমনভাবে তিনি কাজ করতেন, মনে হতো এটা তাঁরই ছবি। নিজেই ইনিশিয়েটিভ নিয়ে কাজ করতেন। বলতেন, ‘শোনো, এটা শাবানার ছবি। তোমরা কিন্তু ভালোভাবে কাজ করবা।’ এভাবে গল্প করতে করতেই আমার প্রযোজনা হাউসটা গড়ে উঠেছে। তাই ব্যাপারটি বেশি স্মরণীয়।