ঢাকায় বিচিত্র শিল্পকলার আন্তর্জাতিক মহোৎসব

চতুর্থ ঢাকা আর্ট সামিট ঘুরে দেখছেন দর্শনার্থীরা। ছবি: সংগৃহীত
চতুর্থ ঢাকা আর্ট সামিট ঘুরে দেখছেন দর্শনার্থীরা। ছবি: সংগৃহীত

পায়ের নিচে প্রায় ৪০ কোটি বছরের পুরোনো ফসিল। এগুলোর ওপর দিয়ে হেঁটে ঢুকতে হবে বর্তমানের পথে। নানা চিন্তার খোরাক ও ভাবনার উপকরণ ছড়িয়ে রয়েছে ভেতরে। সেসব নিয়ে বিশ্বের ৪৪টি দেশের পাঁচ শতাধিক প্রতিষ্ঠিত ও প্রতিভাবান তরুণ শিল্পী এখন ঢাকায়। শিল্পকর্ম প্রদর্শনী ও চিত্রকলায় দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকলার মিলনমেলায় অংশ নিতে এসেছেন তাঁরা। সঙ্গে এনেছেন নিজেদের শিল্পকর্ম। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা সংলগ্ন স্কাল্পচার গার্ডেনের দিকে তাকালেই যে ধারণা করে পাওয়া যাবে। ভেতরে অপেক্ষারত শিল্পের এক মহাযজ্ঞ। আগামী শুক্রবার সেখানে শুরু হতে যাচ্ছে ৫ম ঢাকা আর্ট সামিট।

সামিটে থাকবে বাংলাদেশ, ভারত, আফগানিস্তান, ফ্রান্স, ইতালি, ইরান, শ্রীলঙ্কা, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের পরিচিত শিল্পীদের শিল্প প্রকল্প। যোগ দেবেন দেশ-বিদেশের শিল্প-সমালোচক, শিল্প-সংগ্রাহক। এবারের আর্ট সামিটের বিষয়বস্তু আন্দোলন বা সঞ্চারণ। এটি সাজানো হয়েছে একক প্রদর্শনী, জনসম্পৃক্ত শিল্প প্রকল্প, কিউরেটেড এক্সিবিশন, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, একক ও দলীয় বক্তৃতা, নিরীক্ষাধর্মী চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, লাইভ আর্ট পারফরম্যান্স, পাপেট শো, প্রিন্টমেকিং ওয়ার্কশপসহ শিল্প ও শিল্পকলার নানা বিষয় দিয়ে। এ ছাড়া সামদানী আর্ট অ্যাওয়ার্ড হিসেবে থাকছে রেসিডেন্সি প্রোগ্রাম। এ প্রসঙ্গে আয়োজক প্রতিষ্ঠান সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশনের শিল্পনির্দেশক ডায়না ক্যাম্পবেল বেটানকোর্ট প্রথম আলোকে জানান, এই দেশের মানুষ নানা সময় নানা রকম আন্দোলনের মাধ্যমে এ পর্যায়ে পৌঁছেছে। সেগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল মুক্তিযুদ্ধ। এ যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষে আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের আন্দোলনকে এক ছাদের নিচে সাজিয়েছি।

দ্বিতীয় ঢাকা আর্ট সামিটে দর্শনার্থীদের একাংশ। ছবি: সংগৃহীত
দ্বিতীয় ঢাকা আর্ট সামিটে দর্শনার্থীদের একাংশ। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা আর্ট সামিটের সার্বিক দায়িত্ব পালন করছেন সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশনের পরিচালক নাদিয়া সামদানী। রুক্সমিনি আর কিউ চৌধুরী ও তেরাসা আলবরসহ দেশ-বিদেশের ৩২ জন কিউরেটরের সমন্বয়ে গঠিত ঢাকা আর্ট সামিটের প্রধান কিউরেটরের দায়িত্ব পালন করছেন ডায়না ক্যাম্পবেল বেটানকোর্ট।

এক ছাদের নিচে বিশ্বের নানা প্রান্তের, নানা মেজাজ ও শিল্পের নানা মাত্রার কাজ দেখার বিরল সুযোগ করে দিতে ২০১২ সাল থেকে আন্তর্জাতিক এই প্রদর্শনীর আয়োজন করে আসছে সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশন। আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টায় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা মিলনায়তনে ৯ দিনের প্রদর্শনী ‘ঢাকা আর্ট সামিট-২০২০’ (ডিএএস) উদ্বোধন করবেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি থাকবেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ। এ সময় আরও উপস্থিত থাকবেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী, ঢাকা আর্ট সামিটের সাংগঠনিক কমিটির চেয়ারম্যান ফারুক সোবহান এবং সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশনের পরিচালক নাদিয়া সামদানী।

আজ মঙ্গলবার দুপুরে জাতীয় চিত্রশালা মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে সামিটের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা রাজীব সামদানী ও নাদিয়া সামদানী। এ সময় উপস্থিত ছিলেন শিল্পকলা একাডেমির সচিব বদরুল আলম ভূঁইয়া। প্রদর্শনীর বিষয়বস্তু তুলে ধরেন সামিটের অন্যতম কিউরেটর চিত্রশিল্পী বিশ্বজিৎ গোস্বামী।

চতুর্থ ঢাকা আর্ট সামিটে এসেছিলেন সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া বার্নিকাট। ছবি: সংগৃহীত
চতুর্থ ঢাকা আর্ট সামিটে এসেছিলেন সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া বার্নিকাট। ছবি: সংগৃহীত

প্রথম দিনের আয়োজন

উদ্বোধনী দিন প্রথম পরিবেশনা অনুষ্ঠিত হবে চিত্রশালার ৬ নম্বর গ্যালারিতে। ওই দিন সকাল ১০টায় সামদানী আর্ট অ্যাওয়ার্ড পারফরম্যান্সে অংশ নেবেন বাংলাদেশের আরিফুল কবির। সন্ধ্যা ৭টায় একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা প্লাজায় ‘টুগেটার (ঢাকা সংস্করণ)’ শিরোনামে পারফরম্যান্সে অংশ নেবেন করাকৃত অরুনাদ্ধচল এবং অ্যালেক্স ভোজিও।

বঙ্গবন্ধুর টাইমলাইন
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে সাজানো হয়েছে একটি বিশেষ প্রদর্শনী। একাডেমির জাতীয় চিত্রশালার প্রথম তলায় ‘লাইটিং দ্য ফায়ার অব ফ্রিডম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ শিরোনামে এই প্রদর্শনীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে রয়েছে সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই) এবং সহায়তা দিয়েছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক আলোকচিত্রের বিশাল সংগ্রহ দেখা যাবে এখানে।

ঢাকা আর্ট সামিটে ঢাকা ও বিদেশের শিল্পীরা
ঢাকা আর্ট সামিটে অংশ নেওয়া শিল্পী, সমালোচক ও আলোচকদের মধ্যে রয়েছেন দিলারা বেগম জলি, রোকেয়া সুলতানা, সেলিমা কাদের চৌধুরী, লুইস হ্যান্ডারসন, বিশ্বজিৎ গোস্বামী, আরিফুল কবির, ইয়াসমিন জাহান নূপুর, হেক্টর জামোরাহ, সালেহ হাসান, রাফেল হেফটি, টনি কোকস, রশিদ চৌধুরী, শেনাই জাভেরি, থেরেসে চৌধুরী খান, মরগান কোয়ানট্যান্সে, আয়ো আকিনবেদ, রেহানা জামান, এসি এশুন, অর্নব বিশ্বাস, সাজেদুল হক, অ্যানা পাই, আনিয়কায় ইগনে, ফায়হাম ইবনে শরীফ, আলফ্রেড সান্টানা, শিন অ্যান্ডারসন, ফারহান করিম, সাইম সুন, নূরুর রহমান খান, জয়দেব রওজা, অঞ্জলিকা সাগর, রানিয়া স্টেফেন, কৌদ ইশুন, মুস্তাফা জামান, স্নেহা রাগাভান, শায়লা শারমিন, মাহমুদুল হাসান দুলাল, ইফতিখার দাদি, সামিনা ইকবাল, মিং টিয়ামপো, রাফায়েল গ্রিসে, বোবা টোরে, লুটা-তা কাবা ইন্দ্রি, শিমুরেনজা, সালমান নাওয়াতি, কাদ্দু ইয়ার্যা ক্স, হ্যাডিল অ্যাশলি, মোহাম্মদ হার্ব, এলিজাবেথ প্রভিনীল, জন টাইন, চৌং-ডাল বো, লোট্টে হিয়েক, এলিজাবেথ জর্জিস, সংযুক্ত স্যান্ডারসন প্রমুখ।

চতুর্থ ঢাকা আর্ট সামিটে শিল্পপ্রেমীদের একাংশ। ছবি: সংগৃহীত
চতুর্থ ঢাকা আর্ট সামিটে শিল্পপ্রেমীদের একাংশ। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা আর্ট সামিটের গ্রহণযোগ্যতা

একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে ২০১২ সালে সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশন প্রথম ঢাকা আর্ট সামিটের আয়োজন করে। যেখানে প্রদর্শিত হয়েছিল ২৪০ জন দেশি ও বিদেশি শিল্পীর শিল্পকর্ম। এর ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের অনেক শিল্পীই আন্তর্জাতিক জাদুঘরগুলোতে নজিরবিহীন গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেন। তিন দিনের প্রথম ঢাকা আর্ট সামিটে এসেছিলেন প্রায় ২০ হাজার দর্শনার্থী। বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার শিল্পকলা অঙ্গনে এটি সৃষ্টি করে নতুন ইতিহাস। এক বছর পর পর আয়োজিত এ সামিটের সর্বশেষ আয়োজন করা হয় ২০১৮ সালে। নয় দিনের সেই প্রদর্শনীতে দর্শক এসেছিলেন প্রায় ৩ লাখ ১৭ হাজার দর্শক।

এ বছর ঢাকা আর্ট সামিটে বাংলাদেশ
ঢাকা আর্ট সামিটে বাংলাদেশি শিল্পীদের কিউরেটরের দায়িত্ব পালন করছেন চিত্রশিল্পী বিশ্বজিৎ গোস্বামী। তাঁর তত্ত্বাবধানে ‘রুটস’ শিরোনামে একটি বিশেষ প্রদর্শনীর রাখা হয়েছে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, শিল্পসাধক এস এম সুলতান, শিল্পী কামরুল হাসানসহ দেশের চিত্রকলার শিক্ষাদানে অসামান্য অবদান রেখেছেন, এমন শিল্পীদের জীবনকর্ম তুলে ধরা হবে সেই প্রদর্শনীতে।

এই প্রবেশপথেই বসছে ৪০ কোটি বছরের পুরোনো ফসিল। ছবি: প্রথম আলো
এই প্রবেশপথেই বসছে ৪০ কোটি বছরের পুরোনো ফসিল। ছবি: প্রথম আলো

সামদানী আর্ট অ্যাওয়ার্ড
সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে ১২ জন নির্বাচিত শিল্পীর সমন্বয়ে ‘সামদানী আর্ট অ্যাওয়ার্ড’ প্রদর্শনীর আয়োজন থাকছে এ প্রদর্শনীতে। এ আয়োজনের অংশীদার হিসেবে থাকবে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ডেলফিনা ফাউন্ডেশন, যারা দীর্ঘদিন ধরে মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার শিল্পবিনিময় পর্যবেক্ষণ করে আসছে। দ্বিবার্ষিক সামদানী আর্ট অ্যাওয়ার্ডের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশের ২২ থেকে ৪০ বছর বয়সী উদীয়মান ও প্রতিভাবান শিল্পীদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে সহায়তা করা। এ বছর এই অ্যাওয়ার্ডের সংক্ষিপ্ত তালিকায় আছেন আরিফুল কবির, আশফিকা রহমান, ফাইহাম ইবনে শরীফ, হাবিবা নওরোজ, নাজমুন নাহার কেয়া, পলাশ ভট্টাচার্যী, প্রমতি হোসেন, সোমা সুরভী জান্নাত, সৌনক দাস, সুমনা আক্তার, তাহিয়া ফারহিন হক ও জিহান করিম। ২০১৮ সালে এই অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন মিজানুর রহমান চৌধুরী, ২০১৬ সালে রাসেল চৌধুরী, ২০১৪ সালে আয়েশা সুলতানা ও ২০১২ সালে খালেদ হাসান ও মুসারাত রিয়াজী। সামদানী আর্ট অ্যাওয়ার্ডের আন্তর্জাতিক জুরিবোর্ড প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ডেলফিনা ফাউন্ডেশনের পরিচালক এরন সেজার।

দেশি শিল্পীদের ১২ দল
সামিটে অংশ নেওয়ার জন্য এ বছর বাংলাদেশের ১২টি দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। দলগুলো হচ্ছে আর্টপ্রো, ব্যাক আর্ট, চারুপীঠ, আকালিকো, গিদরি বাউলি, হিলস আর্টিস্ট গ্রুপ, যথাশিল্প, সাঁকো, শনি মঙ্গল আড্ডা।

ঢাকা আর্ট সামিটের সংবাদ সম্মেলনে শিল্পী বিশ্বজিৎ গোস্বামী, শিল্পকলা একাডেমির সচিব বদরুল আলম ভূঁইয়া, নাদিয়া সামদানী ও রাজীব সামদানী। ছবি: সংগৃহীত
ঢাকা আর্ট সামিটের সংবাদ সম্মেলনে শিল্পী বিশ্বজিৎ গোস্বামী, শিল্পকলা একাডেমির সচিব বদরুল আলম ভূঁইয়া, নাদিয়া সামদানী ও রাজীব সামদানী। ছবি: সংগৃহীত

পরিবেশবান্ধব প্রদর্শনী

ঢাকা আর্ট সামিটকে নান্দনিকভাবে সাজাতে কাজ করেছেন আন্তর্জাতিক গ্যালারির নকশাকারেরা। এ বছর আয়োজন সম্পূর্ণ প্লাস্টিক মুক্ত। বসার আসন থেকে কোথাও প্লাস্টিকের ছোঁয়াচ নেই। পরিবেশবান্ধব দ্রব্য যেমন কাগজ, বাঁশ, বেত ও কাঠ দিয়ে যতটা সম্ভব কাজ চালিয়ে নেওয়া হয়েছে। এমনকি পুরো আয়োজনে বর্জন করা হয়েছে এয়ারকন্ডিশন।

দর্শনার্থীদের জানা দরকার
প্রদর্শনীটি সবার জন্য উন্মুক্ত। এমনকি দরকার হবে না কোনো প্রকার নিবন্ধন। ফেব্রুয়ারির ৭ থেকে ১৫ তারিখ সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত প্রদর্শনী খোলা থাকবে। গ্যালারিতে কোনো খাবার, পানীয় ও তরল পদার্থ নিয়ে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে শিল্পকলা একাডেমির মাঠে থাকবে খাবারের স্টল। নিরাপত্তার স্বার্থে বড় ব্যাগ বহন না করার আহ্বান জানিয়েছেন আয়োজকেরা। ঢাকা আর্ট সামিট ২০২০ আয়োজনে সহায়তা দিচ্ছে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। সামিটের টাইটেল স্পন্সর গোল্ডেন হার্ভেস্ট।