'শ্যাম বেনেগাল আমার সঙ্গে সেলফি তুলেছিলেন'

দিলারা জামান। ছবি: প্রথম আলো
দিলারা জামান। ছবি: প্রথম আলো
>দিলারা জামান। তাঁর জীবনের বার্ষিক ক্যালেন্ডারের পাতা পরিবর্তন হয়েছে ৭৬ বার। ৭৭তম বসন্তকে সামনে রেখেও তিনি চিরসবুজের মতো কাজ করে যাচ্ছেন। তরুণ অভিনয়শিল্পীরা তাঁর কাজের স্পৃহা দেখে প্রেরণা পান। শ্যাম বেনেগালের পরিচালনায় বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীমূলক ছবিতে তিনি হবেন শেখ সায়েরা খাতুন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মা। ছোট আর বড় পর্দার সাম্প্রতিক কাজ আর জীবনযাপন নিয়ে আলাপ গুণী এই অভিনয়শিল্পীর সঙ্গে।

বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীমূলক ছবিতে আপনি বঙ্গবন্ধুর মা চরিত্রে অভিনয় করবেন। অভিনন্দন। কখন কীভাবে জানলেন?

ধন্যবাদ। কাল বিটিভি থেকে ফোন করে জানাল। বলল, আপনি তো বঙ্গবন্ধুর ছবিটার জন্য নির্বাচিত হয়েছেন, একটু আসবেন। আমি তখন তৌকীর আহমেদের ‘রূপালি জোৎস্ন্যা’ নাটকের সেটে। হায়াত ভাইও (আবুল হায়াত) ছিলেন।

অডিশনের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

বাংলাদেশের মোটামুটি সবাই (অভিনয়শিল্পীরা) গিয়েছিলেন। ওরা আগে থেকে আমাকে বলেছিল কম দামি একটা তাঁতের শাড়ি পরে যেতে। গেলাম। একটা ছোট্ট স্ক্রিপ্ট হাতে ধরিয়ে পড়তে বলল। আমি পড়লাম, ‘এখন আর তোমার বাইরে মিটিং করার দরকার নেই। ২০-৩০ জন এখানেই মিটিং করতে পারো...’। তখনই শ্যাম বেনেগালের এডি বললেন, ‘আপ রেহেঙ্গে হাম লোগোকে সাথ’। তো আমি ভেবেছি, এমনিতেই বলেছেন। চা খেলাম। শ্যাম বেনেগাল এসে আবার আমার সঙ্গে সেলফি তুললেন। তারপর চলে এলাম।

কেমন লাগছে আর কীভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছেন চরিত্রটার জন্য?

জানি না ঠিকভাবে করতে পারব কি না। তবে ইতিহাসের অংশ হওয়ার এই সুযোগ পেয়ে আমি খুবই সম্মানিত, আনন্দিত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ছবিটা মন দিয়ে দেখবেন। এত বড় পরিচালক, নিশ্চয়ই আমাকে দিয়ে চরিত্রটা বের করে নেবেন। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়েছি। তাঁর মা–বাবার সাক্ষাৎকার দেখেছি। আমি অপেক্ষা করছি কাজটা করার জন্য।

দিলারা জামান। ছবি:ফেসবুক
দিলারা জামান। ছবি:ফেসবুক

কেমন চরিত্র আপনার মনে আরাম দেয়?
এইতো সম্প্রতি একটা কাজ করলাম। সাব্বির আহমেদের পরিচালনায় বাংলাদেশ সরকারের অনুদানের একটা ছবি। গাজীপুরের ভেতর, বৃদ্ধাশ্রমে। আমি আর শর্মিলা আহমেদ। দুজনই অবহেলিত মা। ছোট্ট চরিত্র। কিন্তু শট শেষে দেখি, সেটের সবার চোখে পানি। এই দৃশ্য ধারণের জন্য সিনেমার দলসহ আগের দিন রাতে গেলাম বৃদ্ধাশ্রমে। সেদিনই সেখানকার একজন মা মারা গেলেন। তাঁর মেয়েকে ফোন করা হলো। তিনি জানিয়ে দিলেন, আসতে পারবেন না, লাশ নেবেন না। দাফন করে ফেলতে বললেন। সকালে বৃদ্ধাশ্রমের লোকেদের সঙ্গে সিনেমার দলের সবাই মিলে জানাজা পড়া হলো। শুটিং শুরু হতে হতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। কেমন জীবন বলোতো? এগুলো মেনেই বাঁচতে হয়।

আর কী কাজ করলেন সম্প্রতি?
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ওপর একটা স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র করলাম। ফজলে আজিম জুয়েলের পরিচালনায়। লিখেছেন হারুন-অর-রশীদ। নাম, ‘আমার বাবার নাম’। ছয় ঘণ্টা জার্নি করে গেলাম নোয়াখালির সুবর্ণচরে। ওখানে আমি একটা গ্রামের বুড়ি। এমনিতেই তো আমি বুড়ি। তো সেই বুড়ি বঙ্গবন্ধুর জন্য দুশ্চিন্তা করে, রোজা রাখে, দোয়া করে।

আপনি না কিছুদিন আগে ইংরেজি একটা লাইফস্টাইল ম্যাগাজিনের ‘প্রচ্ছদকন্যা’ হলেন, তবুও নিজেকে বুড়ি বলবেন?

আরে সে তো আমাকে শার্ট–প্যান্ট পরিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল। আর আমার বয়স ৭৬ শেষ, ৭৭ চলছে। যখন ১৯ ছিল, তখন আমি কলেজে পড়তাম। ফরিদা মজীদ আমার বান্ধবী। আমাদের স্যার নূরুল মোমেন তখন নাটক লিখতেন, নির্দেশনা দিতেন। সে রকমই একটা নাটকে আমি হলাম ফরিদার নানি। আমি তো তখন থেকেই বুড়ি।

মেয়েরা দেশের বাইরে, খারাপ লাগে না?

হ্যাঁ। আমিও গিয়েছিলাম আমেরিকায়। কিন্তু থাকতে পারিনি। ওখানে কত সুবিধা। ওখানে ওষুধপত্র সব ফ্রি। এখানে তো মাসে আমার দশ–বারো হাজার টাকার ওষুধেই চলে যায়। কিন্তু দেশ ছেড়ে থাকতে পারি না। মায়া লাগে। এই দেশ, মাটি, এত ভালোবাসা ছেড়ে থাকা যায়? আমি পারব না। আমার নাতি বলে, ‘নানুকে শুধু পে করলে হবে? তাঁকে কমফোর্ট দিতে হবে। তোমাকে সিনসিয়ার হতে হবে। শি ইজ অ্যালোন দেয়ার!’ এত পাকা পাকা কথা বলে, যেন মনে হয় কেউ শিখিয়ে দিয়েছে। ওদের জন্য আবার মন পোড়ে।

এত মানুষের ভালোবাসা পেলেন, একুশে পদক পেলেন, জাতীয় পুরস্কার পেলেন, জীবন থেকে আর কী চাওয়ার আছে আপনার?

কিছু পাওয়ার জন্য কি কাজ করি? মনের আনন্দের জন্য কাজ করি। অভিনয় না করে থাকতে পারি না, তাই করি। আমার বিয়ের পর তো আট–নয় বছর বাচ্চা হলো না। তারপর দেশ স্বাধীন হলো। আর স্বাধীন দেশে আমি প্রথমবার মা হলাম। সেই অনুভূতি যে জানে, তাঁর আর কিচ্ছু চাওয়ার থাকতে পারে না। আর এত মানুষ আপন করে নিয়েছে, আর কী চাওয়ার আছে জীবন থেকে?