সৃজিত-মিথিলা যেভাবে সৃজিলা হলেন

সৃজিত ও মিথিলা। সাজ: অরা বিউটি লাউঞ্জ। ছবি: কবির হোসেন
সৃজিত ও মিথিলা। সাজ: অরা বিউটি লাউঞ্জ। ছবি: কবির হোসেন

ফেসবুকে তিন সপ্তাহের আলাপের পর প্রথমবার মিথিলার সঙ্গে দেখা করতে ঢাকায় এসেছেন সৃজিত। ঘটনা কোনো বাইশে শ্রাবণ–এর নয়, ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসের। বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে এক গাড়িতে সৃজিত, মিথিলা আর মিথিলার ছোটবেলার বন্ধু আইরিন। একজন অল্প পরিচিত মানুষের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার অস্বস্তি কাটাতেই বন্ধুকে সঙ্গে নিয়েছিলেন মিথিলা। গাড়িতে সৃজিত বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়েই সেদিন আইরিনকে জিজ্ঞেস করে বসলেন, ‘ডিসেম্বরে ফ্রি আছেন তো? ওই সময় আমাদের (সৃজিত–মিথিলার) বিয়ে।’ শুনে দুই বান্ধবীর চোখ ছানাবড়া! বলতে গেলে কথাটা একদম হাওয়ায় ছুড়েছিলেন সৃজিত, কিন্তু নিয়তির টানে বিয়েটা ডিসেম্বরেই হলো। বাংলাদেশের অভিনেত্রী রাফিয়াত রশীদ মিথিলা ও ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা সৃজিত মুখার্জি গাঁটছড়া বাঁধলেন গত ৬ ডিসেম্বর।

বিয়ের পর প্রথমবারের মতো নিজেদের গল্প বলতে প্রথম আলোর কার্যালয়ে এসেছিলেন এই আলোচিত দম্পতি। নিজেদের গল্প নিয়ে সিনেমা বানাতে বললে কোন দৃশ্য দিয়ে শুরু করবেন সৃজিত? এই প্রশ্নের জবাবেই ওপরের গল্পটা জানা গেল। বিয়ের ঠিক দুই মাস পর, অর্থাৎ ৭ ফেব্রুয়ারি এক দীর্ঘ আড্ডায় মিথিলা–সৃজিতের গল্পের আরও অনেক অজানা অধ্যায় জানা গেল। তারই কয়েকটি গল্প থাকল এই লেখায়।

সবুকে ‘হাই’
মিথিলা ও সৃজিতের দাবি, তাঁদের আলাপ–পরিচয়ের পেছনে হাত আছে মার্ক জাকারবার্গের। এই মার্কের বানানো ফেসবুকেই একটা ছোট্ট ‘হাই’ দিয়ে শুরু হয় সম্পর্ক আর বিয়ের মধ্য দিয়ে সেই সম্পর্ক পায় স্বীকৃতি। মিথিলার কথায় বোঝা যায়, প্রথম বন্ধুত্বের প্রস্তাব, ইনবক্সে প্রথম ‘হাই’ আর সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার প্রথম আহ্বানটা এসেছিল সৃজিতের দিক থেকেই। চারবার ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া সৃজিত তাঁর স্ত্রীর কথায় দ্বিমত করলেন না। আত্মপক্ষ সমর্থন করে বললেন, ‘“পিপল ইউ মে নো” নামে ফেসবুকের অ্যালগরিদম কিছু অচেনা মানুষকে বন্ধু বানানোর জন্য নাম প্রস্তাব করে। সেখানেই একটানা কয়েক দিন ধরে মিথিলার নাম আসছিল। ঘন ঘন এই প্রস্তাব দেখে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টটা পাঠিয়েই দিলাম।’

সৃজিত যখন এই গল্প শোনাচ্ছিলেন, পাশ থেকে মিথিলা বারবার বলে যাচ্ছিলেন, ‘এটা একটা কন্সপিরেসি থিওরি। বিরাট ষড়যন্ত্র হয়েছে। আর নয়তো শুরু থেকেই কেন ডিসেম্বরেই বিয়ে হবে বলে ও (সৃজিত) নিশ্চিত ছিল!’ সৃজিত ঠান্ডা মাথার মানুষ। কোনো ‘ষড়যন্ত্র’–এর অপবাদেই ভ্রুক্ষেপ নেই তাঁর। 

একটু ছেলেমানুষি, একটু বড়মানুষি!

সৃজিতের বয়স ৪২। জানুয়ারিতে প্রেমের শুরু, ডিসেম্বরে বিয়ে—সব একটু চটজলদি হয়ে যাওয়ার কারণ নাকি এই বয়সটাই। বললেন সৃজিত, ‘একটা সময় মানুষের একধরনের পরিপক্বতা আসে, যখন সে আরেকজনকে চিনতে পারে, বুঝতে পারে। মিথিলার সঙ্গে পরিচয় হতেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম, ওর সঙ্গেই বিয়েটা হচ্ছে। তাই শুরুতেই ডিসেম্বর ঠিক করে ফেলেছিলাম। বয়স তো আর কম হয়নি। অনেক তো হলো।’ সৃজিত নিজেকে যতই বয়সী হিসেবে দাবি করুন না কেন, মিথিলা তাঁর বয়সের তুলনা করলেন আয়রার (মিথিলার ৭ বছর বয়সী মেয়ে) সঙ্গে। বললেন, ‘আয়রার থেকে ওর বয়সের দুরত্ব খুব একটা বেশি নয়।’

ছেলেমানুষি যে কিছুটা এই দম্পতির মধ্যে আছে, তা আমরা আঁচ করতে পারি। তা না হলে মাত্র তিন সপ্তাহ ফেসবুকের আলাপ থেকেই কি আর কেউ আরেক দেশে ছুটে আসে? প্রথম দেখাতেই ঠিক করে ফেলে বিয়ের দিনক্ষণ!

কিন্তু দিন যত গড়ায়, সৃজিত–মিথিলার সম্পর্ক পরিণত হতে থাকে। এখনো হচ্ছে। তাঁদের মধ্যে দেশ, জাতি, ধর্মের যে ফারাক, তা তাঁরা মেটাতে পেরেছেন শুধু পরিণত মানসিকতার কারণেই। এই অল্প সময়ের সম্পর্কেই তো বেশ চড়াই–উতরাই দেখে ফেললেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় উঠল, হলো বিতর্ক, বাংলাদেশ–ভারতের গণমাধ্যমও তো রীতিমতো ব্যতিব্যস্ত ছিল মিথিলা–সৃজিতের প্রেম নিয়ে। 

মিথিলা ও সৃজিত
মিথিলা ও সৃজিত

লোকে বলুক লোকের কথা

প্রেম পর্বের শুরু থেকেই শুনতে হয়েছে কটূক্তি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লোকে কিছু আর বলতে বাদ রাখেনি। অনেকে আঙুল তুলেছেন মিথিলার দিকে, আঘাত করে কথা বলতে বাধেনি কারও। বিবাহবিচ্ছেদের পর একজন একা মা কেন আবার প্রেমে পড়বেন, কেন আবার বিয়ে করবেন, বিয়ে করলেও কেন সৃজিতের মতো ভিনদেশের একজনকে—এমন কত অভিযোগ! এর মধ্যে আবার সাবেক প্রেমিকের সঙ্গে মিথিলার কিছু অন্তরঙ্গ ছবি ফাঁস হয়ে যায়। শুরু হয় আরেক দফা বিতর্কের ঝড়, আবার সেই বাজে কথার হিড়িক। এই সবের মধ্যে মিথিলা–সৃজিতের মধ্যে কী চলছিল? 

সৃজিত বলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়ায় আমার প্রোফাইলটা হচ্ছে আমার বসার ঘরের মতো। আমি রোজ সকালে উঠে এটা ঝাড় দিই, পরিষ্কার করি। কোনো তেলাপোকা আমার জায়গা নোংরা করলে আমি ঝাড় দিয়ে তাকে বের করে দিই। তার করা নোংরামি আমি মুছে ফেলি, পরিষ্কার করি। ওই সময়টায় আমি মিথিলাকেও এমনটা বলেছিলাম। বাইরের লোকে কী বলল, এসব আমাদের প্রভাবিত করতে পারে না। আমরা আমাদের জায়গায় দৃঢ় থাকলেই হলো।’ তবে মিথিলা এমনটা ভাবতে পারেন না। এখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেউ তাঁকে কোনো বাজে কথা বললে চিন্তায় পড়েন। তবে সেই চিন্তা নিজেকে নিয়ে নয়, যিনি বাজে কথা বলছেন, তাঁকে নিয়ে। মিথিলা বলেন, ‘মাঝেমধ্যে আমি সেই সব মানুষের প্রোফাইলে ঢুকে দেখি, মানুষগুলো কেমন, তাঁদের বন্ধু, তাঁদের মা–বাবা–ভাই–বোনেরা কেমন? যাঁরা এত অকথ্য ভাষা ব্যবহার করতে পারেন, যাঁরা ভার্চ্যুয়াল জগতে এত বর্বর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলেন, তাঁদের দেখে আমার মায়া হয়। 

আয়রার ‘বু’ সৃজিত

মিথিলার কাছে জানতে চাই, মেয়ে আয়রা ও স্বামী সৃজিতের সম্পর্কের রসায়ন কেমন? ‘দুজনে হলো টম অ্যান্ড জেরি। এই খুনসুঁটি, এই আবার দারুণ ভাব। যখন খুব মন–কষাকষি চলে বা আবদার করে কিছু পাওয়া যায় না, তখন আয়রার কাছে সৃজিত শুধুই সৃজিত। কিন্তু যখন সৃজিতের ফোনটা আয়রার চাই, তখন খুব ভাব, তখন আয়রার কাছে সৃজিত হয়ে যায় “বু”।’ বু ডাকটা এসেছে আব্বু থেকে, ভেঙে বুঝিয়ে দিলেন সৃজিত। 

আয়রাকে ঘিরে সৃজিতের কিছু অন্য রকম অনুভূতির গল্প আছে, যে অনুভূতিগুলো তাঁর কাছে একেবারেই নতুন, একেবারেই আনকোড়া। যেমন: আয়রার গলায় সৃজিতের সিনেমার গান। কিছুদিন আগেই মুক্তি পেয়েছে সৃজিতের নতুন সিনেমা দ্বিতীয় পুরুষ। এই ছবি এখন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে রেকর্ডভাঙা ব্যবসা করছে, পাচ্ছে নানাজনের প্রশংসা। কিন্তু এসব তো সৃজিতের আগের ছবিগুলোর বেলাতেও হয়েছে। তবে ছোট্ট–মিষ্টি কণ্ঠে নিজের ছবির গান শুনে ঘুম ভাঙার অভিজ্ঞতা সৃজিত মুখার্জির ঝোলায় আগে ছিল না। আয়রা নাকি প্রায়ই গুনগুন করে দ্বিতীয় পুরুষ–এর ‘যে কটা দিন’ গুনগুন করে গায়।

এই যে আয়রার সহজভাবে মিশে যাওয়া, ‘বু’–কে নিয়ে ভালো থাকা—এসবের জন্য সৃজিত কৃতিত্ব দিলেন আয়রার বাবা তাহসান ও মা মিথিলার লালনপালনকে, প্যারেন্টিংকে। সৃজিত বললেন, ‘আয়রা খুব সুন্দরভাবে মানিয়ে নেয়, বুঝতে পারে। কারণ, তাঁর সামনে তাহসান ও মিথিলা আমাকে যেভাবে সম্বোধন করেন, মিথিলা যেভাবে আমাকে ও তাহসানকে ট্রিট করে, এটাই আয়রার কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে। এ জন্য আমি তাহসান–মিথিলাকে সাধুবাদ জানাই। কারণ, আমি ব্রোকেন ফ্যামিলিতে বড় হয়েছি, আমি জানি মা–বাবার সেপারেশন সন্তানের ওপর কতটা প্রভাব ফেলে।’

আরও নানা বিষয়ে আমাদের আড্ডা চলতে থাকে। এর মধ্যে পাশের ঘর থেকে আসে নির্মাতা রেদওয়ান রনির ডাক। মিথিলা ও সৃজিত অংশ নেবেন রনির উপস্থাপনায় প্রথম আলোর বিশেষ অনুষ্ঠান ‘রসায়ন’–এ। লম্বা প্রস্তুতি নিয়ে প্রস্তুত রনি। তাই ডাক আসামাত্রই নবদম্পতি চলে যান স্টুডিওতে। সেখানে মজার এক আয়োজনে যোগ দেন তাঁরা। অনুষ্ঠানটি দেখা যাবে প্রথম আলো অনলাইন, ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলে। সেখানেও জানা যাবে মিথিলা–সৃজিতের প্রেম ও বিয়ের আরও অনেক গল্প।