'হুমায়ূন আহমেদের চরিত্রটা আমার করার কথা ছিল'

কথা বলছেন অঞ্জন দত্ত। ছবি আশরাফুল আলম।
কথা বলছেন অঞ্জন দত্ত। ছবি আশরাফুল আলম।

কে বলে সিনেমার দর্শক নেই? চেয়ারে বসে, জায়গা না পেয়ে নিচে বসে, দাঁড়িয়ে মানুষ সিনেমা দেখে। সিনেমা শেষে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে হাততালি দেয়। তারপরও উঠে চলে যায় না। গালে হাত দিয়ে পরিচালকের কথা শোনে। পরিচালকের কাছে প্রশ্ন পৌঁছে দেওয়ার জন্য পুরোটা সময় হাত তুলে রাখে, নামায় না। অত্যুৎসাহীরা তো দুহাত তুলে দাঁড়িয়ে থেকেছেন, তবু সময় মাইক্রোফোন নিয়ে যেতে দেয়নি এমন অনেকের কাছে। কারণ, সিনেমার নাম ফাইনালি ভালোবাসা। আর আগেই জানানো হয়েছিল, উপস্থিত থাকবেন এই ছবির পরিচালক ও মূল অভিনয়শিল্পীদের একজন, খুব চেনা, অঞ্জন দত্ত।

গতকাল বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্র সংসদ আয়োজিত ১৯তম ‘আমার ভাষার চলচ্চিত্র উৎসব-১৪২৬’–এর আয়োজনে টিএসসির অডিটরিয়ামে এমন এক দৃশ্যের দেখা মিলল, যা কদাচিৎ দেখা মেলে। সিনেমা শুরুর ১০ মিনিট আগেই হলের ওপর–নিচ ভর্তি। যতক্ষণে সিনেমা শুরু হলো, ততক্ষণে তিলধারণের জায়গা নেই। ওপরতলায় কোনোরকমে জায়গা পাওয়ায় বেশ দূর থেকে দেখতে হয়েছে ছবিটি। তবু প্রতিটি দৃশ্যের সঙ্গে দর্শক সংযোগ করতে পেরেছে। পর্দায় সৌরসেনী মৈত্রা কিংবা অনির্বাণ ভট্টাচার্য ডায়ালগ বলার আগেই দর্শকসারি থেকে বলে দিয়েছেন অনেকে। গানে গলা মিলিয়েছেন। একাধিক দৃশ্যে পড়েছে হাততালি।

নিজের চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। ছবি আশরাফুল আলম।
নিজের চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। ছবি আশরাফুল আলম।

তাই দেখে সিনেমা শেষে পরিচালক অঞ্জন দত্ত স্টেজে উঠে দর্শকদের আক্ষরিক অর্থেই টুপিখোলা অভিনন্দন জানালেন। তবে মঞ্চে এই পরিচালক, অভিনেতা ও সংগীতশিল্পী একা আসেননি। সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন এই ছবির গুরুত্বপূর্ণ অভিনয়শিল্পী সুপ্রভাত দাসকে। তিনিও পরিচালকের দেখাদেখি উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানালেন দর্শকদের। কলকাতায় নাকি দর্শকদের এমন সাড়া পাননি এই পরিচালক। তাই বললেন, ‘তোমরা যে হিউমার বুঝে রি–অ্যাক্ট করলে, সেটা কলকাতায় দেখিনি আমি। কেবল বাণিজ্যিক ছবিতে নয়, এ ধরনের ভিন্ন রকমের ছবিতেও যে মুহুর্মুহু তালি পড়তে পারে, তা তোমরাই দেখালে।’

শুরু হলো প্রশ্নোত্তর পর্ব। এক ভক্ত জানতে চাইলেন, বাংলাদেশের সিনেমায় অভিনয় করবেন না? উত্তরে এই বৈচিত্র্যময় গুণের অধিকারী মানুষটা জানালেন, কেবল অভিনয়ই নয়, তিনি বাংলাদেশের ছবি পরিচালনাও করতে চান। দুবার অভিনয়ের বিষয়ে আলাপ হলেও ছবি হয়নি। বাংলাদেশে নাকি তাঁর একজন প্রিয় পরিচালক আছেন। কে তিনি? নাম না নিয়ে কেবল বললেন, ‘যে “টেলিভিশন” বানিয়েছে।’ দর্শকসারি থেকে বলে উঠল, ‘মোস্তফা সরয়ার ফারুকী’।

অঞ্জন দত্ত বলতে থাকলেন, ‘ওর “ডুব” সিনেমায় হুমায়ূন আহমেদের চরিত্রটা আমার করার কথা ছিল। কিন্তু সময় মেলেনি। তাই আমিই ওকে ইরফান খানকে নেওয়ার জন্য বললাম। বললাম, ও চরিত্রটা ভালো করতে পারবে। দেখি, ওর সঙ্গে ভবিষ্যতে কাজ করা যায় কি না। আর “গণ্ডি” সিনেমায় যে চরিত্রটা সব্যসাচী করল, সেটিও আমার করার কথা ছিল। পরিচালক গিয়েছিল আমার বাসায়। আমি তো খুবই আগ্রহী। ছবিটার জন্য ওজন বাড়াতেও রাজি হলাম। কিন্তু ওই এক সমস্যা। কিছুতেই সময় মিলছিল না।’

সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন এ ছবির গুরুত্বপূর্ণ অভিনয়শিল্পী সুপ্রভাত দাসকে। ছবি: প্রথম আলো
সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন এ ছবির গুরুত্বপূর্ণ অভিনয়শিল্পী সুপ্রভাত দাসকে। ছবি: প্রথম আলো

বেশ কয়েকবার মন্ত্রমুগ্ধের মতো অঞ্জন দত্তের কথা শুনতে থাকা মানুষ হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়েছে। এই ধরুন, একজন হয়ত প্রশ্নের মধ্যে বলল, আপনি এত সফল মানুষ...মাঝখানে তাঁকে থামিয়ে দিয়ে অঞ্জন দত্ত টুপি খুলে মাথা দেখিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘আমি কীভাবে সফল হলাম?’ অর্থাৎ, মাথার চুল পড়ে গেছে, তাই সফলতাও আর নেই। সেইসঙ্গে জুড়ে দিলেন, ‘গান, সিনেমা করে কিছু মানুষ চেনে আমাকে, অল্প কিছু টাকা যে হয়নি তা–ও নয়, তাই বলে সফল বলা যাবে না আমাকে।’ আরেক দফা হাসির রোল ছড়িয়ে পড়ল মিলনায়তনের এপাশ থেকে ওপাশ।

আপনার ছবিতে কেমন যেন একটা একাকিত্ব, দুঃখবোধ। কেন? প্রথম আলোর এ প্রশ্নের জবাবে অঞ্জন দত্ত বললেন, দাঁত বের করা হাসির চেয়ে চুপ করে নীরবে কাঁদার দৃশ্য বেশি ভালো লাগে। আরও বললেন, ‘একজন শিল্পীর জন্য যন্ত্রণা জিইয়ে রাখা জরুরি। একাকিত্বের চর্চা করাও।’ একই সঙ্গে তিনি যে তরুণসমাজের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারছেন, সেটি বলতে ভুললেন না। বললেন, ‘৬৭ বছর বয়সেও তিনি যে “স্টিল ইন দ্য গেইম”, তার কারণ সেটিই।

জানালেন, মেইনস্ট্রিমের ধারণা বদলে দেওয়ার সময় এসেছে। যে তরুণদের চোখে নির্মাতা হওয়ার স্বপ্ন, তাঁদের উদ্দেশে ছোট্ট করে শুধু বললেন, কেবল গল্প নয়, গল্পটা কীভাবে বলা হচ্ছে, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। ক্যামেরার পেছনে দাঁড়িয়ে সহজ কথা সহজে বলা যাবে না। বলতে হবে ঘুরিয়ে, পেঁচিয়ে আর শৈল্পিকভাবে।

অঞ্জন দত্ত জানালেন, মেইনস্ট্রিমের ধারণা বদলে দেওয়ার সময় এসেছে। ছবি: প্রথম আলো
অঞ্জন দত্ত জানালেন, মেইনস্ট্রিমের ধারণা বদলে দেওয়ার সময় এসেছে। ছবি: প্রথম আলো

সময় গড়িয়ে যায়। ঘড়ির কাঁটা পরবর্তী ছবি নাসির উদ্দীন ইউসুফ পরিচালিত ‘আলফা’ প্রদর্শনের সময় ছুঁয়ে ফেলে। কিন্তু দর্শকদের ওঠার কোনো তাড়া দেখা গেল না। বাধ্য হয়ে অঞ্জন দত্ত উঠে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে বললেন, ‘এবারের মতো ছেড়ে দিন। আরেকটা চমৎকার ছবি দেখুন।’ এটুকু বলেই একফাঁকে মিলনায়তনে থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি।
সর্বশেষ: আজ বৃহস্পতিবার কলকাতার উদ্দেশে যাত্রা করেছেন অঞ্জন দত্ত।