'মুভি মোগল' জাহাঙ্গীর খান আর নেই

এ কে এম জাহাঙ্গীর খান। ছবি: সংগৃহীত
এ কে এম জাহাঙ্গীর খান। ছবি: সংগৃহীত

‘নয়নমণি’, ‘শুভদা’, ‘কি যে করি’, ‘সওদাগর’, ‘সূর্যকন্যা’, ‘সীমানা পেরিয়ে’, ‘আলিঙ্গন’, ‘তুফান’, ‘রঙিন রূপবান’, ‘আলী বাবা ৪০ চোর’সহ আরও অনেক জনপ্রিয় ও ব্যবসাসফল সিনেমার প্রযোজক এ কে এম জাহাঙ্গীর খান মারা গেছেন। আজ শনিবার দুপুর পৌনে ১২টায় রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। জাহাঙ্গীর খানের মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন তাঁর মেয়ে সংগীতশিল্পী ঝুমু খান।

ঝুমু খান প্রথম আলোকে জানান, মূলত বার্ধক্যজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন তাঁর বাবা। অক্টোবর থেকেই টুকটাক অসুস্থতা শুরু হয়েছিল। বড় কোনো রোগ ছিল না। গত কয়েক দিন শারীরিক অবস্থা ক্রমান্বয়ে খারাপ হতে থাকে। অবশেষ আজ সকালে চলে গেলেন তিনি। আজ এশার নামাজের পর মুগদাপাড়ায় স্থানীয় মসজিদে জানাজা শেষে সেখানকার পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে। এর আগে মাগরিবের নামাজের পর গুলশানের ভোলা মসজিদে প্রথম জানাজা হবে।

স্বাধীনতার পর যে কজন দাপুটে প্রযোজক বাংলাদেশে চলচ্চিত্রশিল্পকে এগিয়ে নিতে কাজ করেছেন, তাঁদের অন্যতম এ কে এম জাহাঙ্গীর খান। ১৯৭৮ সালে ‘চিত্রালী’ সম্পাদক প্রয়াত আহমদ জামান চৌধুরী তাঁকে ‘মুভি মোগল’ খেতাব দেন। তখন থেকে তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি ঢাকার চলচ্চিত্রজগতে এ নামেই পরিচিত হয়ে আসছেন।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে জাহাঙ্গীর খানের অবদান অনেক। তিনি চলচ্চিত্র প্রযোজনায় এসেছিলেন ১৯৭৩ সালে তাঁর বাবা মারা যাওয়ার পর। তবে তারও আগে থেকে সিনেমার পরিবেশক ছিলেন। বাবুল চৌধুরীর ‘সেতু’ সিনেমা দিয়ে ডিস্ট্রিবিউশন শুরু করেন তিনি। মূলত ‘মা’ ছবি দিয়ে তাঁর প্রযোজনা শুরু হয়। ১৯৮৬ সালে তাঁর প্রযোজিত ও চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘শুভদা’ ছবিটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ১৩টি সম্মাননা অর্জন করে অনন্য রেকর্ড গড়ে। ১৯৭৬ সালে প্রথম তিনি প্রযোজনা করেন ‘নয়নমণি’ ছবিটি। এর আগে ১৯৭৩ সালে তাঁর প্রথম পরিবেশিত ছবি ছিল ‘যাহা বলিব সত্য বলিব’। ৪৩টি ছবির প্রযোজক ও পরিবেশক তিনি। এ মুভি মোগল প্রযোজিত সিনেমা টানা ২৫ সপ্তাহ, ৮১ সপ্তাহ, এমনকি ১০৩ সপ্তাহ ধরে প্রদর্শিত হয়েছে। অর্থাৎ রজতজয়ন্তী, সুবর্ণজয়ন্তী, হীরকজয়ন্তী ছুঁয়ে সগৌরবে চলেছে। বাংলাদেশে প্রথম যে ছবিটি টানা ১০৩ সপ্তাহ চলার রেকর্ড গড়েছিল, সেটি হলো আমজাদ হোসেন পরিচালিত ‘নয়নমণি’। ১৬ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ ছবিটি এক কোটি টাকার ব্যবসা করে। আর এ ছবির প্রযোজক হলেন জাহাঙ্গীর খান। ২০১৬ সালে এ কে এম জাহাঙ্গীর খান তাঁর প্রযোজনা সংস্থা আলমগীর পিকচার্সের ব্যানারে নির্মিত ৪৩টি ছবির প্রিন্ট, পোস্টার, ফটোসেট, অ্যালবাম বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভকে প্রদান করেছেন।

এ কে এম জাহাঙ্গীর খান। ছবি: ফেসবুক
এ কে এম জাহাঙ্গীর খান। ছবি: ফেসবুক

১৯৩৯ সালের ২১ এপ্রিল কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম চিওড়া কাজীবাড়ি মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পুরো নাম আবুল খায়ের মো. জাহাঙ্গীর খান। জীবদ্দশায় বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, শৈশবে বেশ দুরন্ত স্বভাবের ছিলেন তিনি। মাত্র ছয় বছর বয়স থেকে সিনেমা দেখা শুরু করেন। সিনেমা দেখা তাঁর কাছে একটি আদর্শের বিষয় মনে হতো। কানন দেবীর ছবির ভক্ত ছিলেন তিনি। শরৎচন্দ্রের ‘মেজদিদি’র চলচ্চিত্রায়ণ দেখে সিনেমার প্রতি অনুপ্রাণিত হন। সত্যজিৎ রায়ের ছবি তাঁকে চলচ্চিত্রজগতে আসতে উৎসাহিত করে।

১৯৫৮ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস, ১৯৬০ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে আইএসসি ও ১৯৬২ সালে বিএসসি পাস করেন। ১৯৬৩ সালে জাপানে ফুজি কোম্পানিতে ইঞ্জিনিয়ারিং সেক্টরে যোগ দেন।


ঢাকাই চলচ্চিত্রের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’-এর নির্মাতা আবদুল জব্বার খানের দেশীয় সংস্কৃতির প্রতি হৃদয়ের টান জাহাঙ্গীর খানকে মুগ্ধ করেছিল বলেই চলচ্চিত্রে নিজেকে যুক্ত করাটা তাঁর পক্ষে সহজ হয়েছিল বলে এক সাক্ষাৎকারে জানান তিনি।


জাহাঙ্গীর খানের সর্বশেষ নির্মাণ ছিল ১৯৯৮ সালে তাঁর প্রযোজিত ‘রঙিন নয়নমণি’ ছবিটি। মাঝে দীর্ঘদিন চলচ্চিত্র প্রযোজনা থেকে দূরে ছিলেন। প্রায় ২০ বছর পর আবার একসঙ্গে তিনটি চলচ্চিত্র নির্মাণের ঘোষণা দিয়ে ফেরেন তিনি। ‘স্বাধীনতা’, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’ ও ‘রাধারমণ’ সিনেমা তিনটির মহরত হয়েছিল গেল অক্টোবর।