অস্কার তুমি কার?

১৯৯৯ সালে অস্কারের ৭১তম আসরে ইতালীয় সিনেমা লাইফ ইজ বিউটিফুল জেতে সেরা বিদেশি ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্রের পুরস্কার। সেই ছবির একটি দৃশ্য
১৯৯৯ সালে অস্কারের ৭১তম আসরে ইতালীয় সিনেমা লাইফ ইজ বিউটিফুল জেতে সেরা বিদেশি ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্রের পুরস্কার। সেই ছবির একটি দৃশ্য

দুটি ছবির নাম দিয়ে শুরু করি। চিলড্রেন অব হ্যাভেন ও লাইফ ইজ বিউটিফুল। চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে গেল শতাব্দীতে তৈরি ছবি দুটি কিছু ক্ষেত্রে ‘ক্ল্যাসিক’ ছবির মর্যাদা পেয়ে থাকে। ১৯৯৯ সালে অস্কারের ৭১তম আসরে ছবি দুটি বিদেশি ভাষার সেরা চলচ্চিত্রের বিভাগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। ইতালীয় লাইফ ইজ বিউটিফুল সেরা ছবি হওয়ার লড়াইয়ে মনোনয়ন পেলেও মাজিদ মাজিদির চিলড্রেন অব হেভেন পায়নি। শেষতক ইরানের ছবিটিকে ফিরতে হয় খালি হাতেই। আর লাইফ ইজ বিউটিফুল বিদেশি ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্রে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি পেলেও সেরা ছবির লড়াইয়ে হেরে যায় শেক্​সপিয়ার ইন লাভ নামের ছবিটির কাছে। 

একাডেমি অ্যাওয়ার্ডসের সাম্প্রতিক আসরের আগ পর্যন্ত এই ছিল বিদেশি ভাষার গন্তব্য। আলোচিত হবে, প্রশংসিত হবে, কিন্তু ‘সবার সেরা’ তকমা দূরেই রয়ে যাবে। বং জুন-হো পরিচালিত দক্ষিণ কোরিয়ার ছবি প্যারাসাইট সেই আক্ষেপ দূর করেছে। সেরা চলচ্চিত্র, সেরা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রসহ মোট চারটি অস্কার ট্রফি জিতেছে প্যারাসাইট। কিন্তু এই একমাত্র ব্যতিক্রমকে হিসাব থেকে বাদ দিয়ে অস্কারের ৯২ বছরের ইতিহাসের দিকে চাইলে প্রশ্ন জাগবে, অস্কার তুমি কার? ইংরেজির নাকি সবার? 

‘লোকাল’ অস্কার
অস্কারের জন্ম হলিউডে। যে দেশে এই পুরস্কারের আঁতুড়ঘর, সেখানে ইংরেজিই মূল ভাষা। কিন্তু অস্কারকে বিশ্বব্যাপী তার চেয়েও বৃহৎ দৃষ্টিতে দেখা হতো সার্বিকভাবে। হতো বলছি; কারণ, এই দৃষ্টিভঙ্গিতে কিছুটা পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। সেই পরিবর্তনের সুর পাওয়া যায় সদ্য অস্কারজয়ী বং জুন-হোর কণ্ঠে। অস্কারের মঞ্চে বাজিমাত করার আগেই তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, একাডেমি অ্যাওয়ার্ডসের আসর এখন আর আন্তর্জাতিক মানে নেই, এটি এখন ‘ভেরি লোকাল’। এই কথার মূল কারণ হলো—ইংরেজি ভাষা, সাদা চামড়া ও পুরুষ জাতের প্রতি অস্কার কর্তৃপক্ষের অন্ধ পক্ষপাত। ফলে নামে (পড়ুন খ্যাতিতে) ‘ইন্টারন্যাশনাল’ হলেও কাজের দিক থেকে অস্কার হয়ে যাচ্ছে ‘লোকাল’, অর্থাৎ মার্কিন ও ইংরেজি–ঘেঁষা।

প্যারাসাইট ছবির জন্য জেতা অস্কার পুরস্কার হাতে পরিচালক বং জুন–হো
প্যারাসাইট ছবির জন্য জেতা অস্কার পুরস্কার হাতে পরিচালক বং জুন–হো

মার্কিন মুলুকে এগিয়ে যাচ্ছে এশীয় সিনেমা
বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিদেশি ভাষার ছবির স্বীকৃতি দেওয়ার মধ্য দিয়েই অস্কার এবং হলিউডের চলচ্চিত্রশিল্প সত্যিকারের আন্তর্জাতিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়ে উঠতে পারবে। এখন পর্যন্ত হলিউডের ছবিগুলো এশিয়াসহ অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখছে শুধুই ব্যবসার খাতিরে। অ্যাভেঞ্জারস বা স্টার ওয়ারস সিরিজের মার মার কাট কাট ছবিগুলোর পরিবেশক যে চাই! সে অনুযায়ী ভিনদেশি ছবিগুলোকে সাদরে গ্রহণ করা হচ্ছে না। কিন্তু বিশ্বব্যাপী চলচ্চিত্রের বাজারের মোড় ঘুরতে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্র সেই বাজারের শীর্ষে থাকলেও, দ্বিতীয় স্থানে চলে এসেছে চীন। ২০১৮ সালে চীনা চলচ্চিত্রশিল্পের আয় ছিল প্রায় এক হাজার কোটি ডলার। সাবটাইটেল দিয়েও ইংরেজি ভিন্ন অন্য ভাষার ছবিগুলো খোদ মার্কিন মুলুকে বেশ ব্যবসা করছে। প্যারাসাইট শুধু উত্তর আমেরিকাতেই আয় করেছে সাড়ে তিন কোটি ডলারের বেশি। আর এই ছবির মোট আয় ছাড়িয়ে গেছে সাড়ে ১৬ কোটি ডলার।

একই অবস্থা ইংরেজি ভিন্ন অন্য ভাষার ছবির কলাকুশলীদের ক্ষেত্রে। এশীয়রা যেন একটু বেশিই অবহেলার শিকার হচ্ছেন। এশিয়ার অভিনেতা-অভিনেত্রী, গায়ক-গায়িকা, সুরকার, পরিচালক—সবাই-ই যেন অচ্ছুত! অস্কারের এত এত বছরের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, পুরস্কার জয়ের হিসাবে পড়ে আছে গুটিকতক নাম। আর গবেষণা বলছে, হলিউডের চলচ্চিত্রগুলোয় এশিয়ার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অংশগ্রহণের পরিমাণ চরিত্রের বিচারে মোটে সাড়ে ৩ শতাংশ। এই হিসাব ২০১৭ সালের। গত দুই বছরে তাতে নাটকীয় পরিবর্তন এসে গেছে, সেটি ভাবারও কোনো কারণ নেই।

দাগ মোছার অপেক্ষায় অস্কার
অবশ্য নিন্দুকেরা এ-ও স্বীকার করে নিচ্ছেন যে অস্কারে গত দুই আসর ধরেই কিছু পরিবর্তন আসছে। তবে সেই বদলের গতি খুবই ধীর। এতটাই যে কচ্ছপও দৌড়ে নাম লেখালে জিতে যেতে পারে! বলা হচ্ছে, অস্কারকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নিরপেক্ষ করতে নতুন ভোটার নেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। এক হিসাবে দেখা গেছে, একাডেমি অ্যাওয়ার্ডসের নতুন এই ভোটারদের ৩৯ শতাংশ আসছে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে থেকে। সাম্প্রতিক নতুন ভোটারদের মোট সংখ্যা প্রায় ৮৫০ এবং তাঁরা এসেছেন ৫৯টি দেশ থেকে। অস্কার কর্তৃপক্ষের আশা, এই নতুন ভোটাররাই সোনালি ট্রফিতে লেগে থাকা কালো দাগ মুছে দেবেন। 

মোদ্দা কথা, বিশ্বায়নের এই যুগে গণ্ডিবদ্ধ আচরণ করার সুযোগ অস্কারের নেই। আর সেটি যদি চলতেই থাকে, তবে আর আন্তর্জাতিক খ্যাতির চূড়ায় থাকা হবে না। শোনা যাচ্ছে, এবারের অস্কার আসরই নাকি গতবারের তুলনায় ঢের দর্শক হারিয়েছে। অর্থাৎ সংকেত সুবিধের নয়। সময়ই বলে দেবে, অস্কার যাবে কোন দিকে। 

সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট, শিকাগো ট্রিবিউন, সিএনএন, নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট ও হলিউড রিপোর্টার